ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভাড়া ডাকাতির মহোৎসব

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ১২ আগস্ট ২০২০

ভাড়া ডাকাতির মহোৎসব

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দেশের বিভিন্ন জেলায় গণপরিবহনে রীতিমতো চলছে ভাড়া ডাকাতির মহোৎসব। বেসরকারী পরিবহন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থার বিআরটিসি পর্যন্ত নেমেছে বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রতিযোগিতায়। দুই আসনেই যাত্রী পরিবহনসহ ৬০ থেকে প্রায় শতভাগ বাড়তি ভাড়া আদায় করছে আন্তঃজেলার বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানি। সাধারণ যাত্রীদের জিম্মি করে এই অরাজকতা চলছে ঈদের পর থেকেই। তেমনি ঢাকাসহ সারাদেশের গণপরিবহনে বালাই নেই স্বাস্থ্যবিধির। বাসের ভেতরে মোড়ায় বসিয়ে এমনকি দাঁড়িয়ে পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে একেবারেই নির্বিকার। রাষ্ট্রীয় পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিআরটিএ) নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। এদিকে ৬০ ভাগ বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথম চীনে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। চলতি বছরের আট মার্চ দেশে প্রথম শনাক্ত হয় করোনা ভাইরাসের রোগী। এরপর ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটির পাশপাাশি গণপরিবহন লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। অর্থনীতির গতি সচল রাখা ও মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সচল রাখার কথা বলে ৩১ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি তুলে নেয়ার পাশাপাশি সীমিত পর্যায়ে বেশকিছু শর্ত সাপেক্ষে চালু করা হয় গণপরিবহন। শর্ত ছিল প্রতিটি বাসে যাত্রী সুরক্ষায় বারবার স্যানিটাইজ করে দূষণমুক্ত করা, চালকসহ হেলপারের মাস্ক বাধ্যতামূলক, অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চালানো, যাত্রীর গায়ের তাপমাত্রা মাপা, নতুন ভাড়ার তালিকা প্রদর্শন প্রভৃতি। গণপরিবহন চালুর এক সপ্তাহের মধ্যে আস্তে আস্তে সবকিছু শিথিল হতে থাকে। এখন একেবারেই কোনকিছু নেই বললেই চলে। নিয়ম বা নির্দেশনা যা আছে সবই কাগজে কলমে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বারবার গণপরিবহনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত হলেও যা হয়েছে তা নামেমাত্র। অর্থাৎ মোবাইল কোর্ট বা সরকারী নজরদারি বাড়ানোর কারণে পরিবহন সেক্টরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চিত্র খুব একটা চোখে পড়ে না। করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর মধ্যে সবকিছুতেই যেন ঢিলেঢালা ভাব। নেত্রকোনা থেকে শাহজালাল পরিবহনে আসা যাত্রী কামাল জানান, ঈদের পর থেকে এই কোম্পানিটি রীতিমতো অরাজকতা চালিয়ে আসছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ঈদের পর টিকেট নিয়ে সিন্ডিকেট করে কাউন্টারের বাইরে বাড়তি দামে বিক্রি করেছে। সাধারণ যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে প্রতিদিন। ঈদের তৃতীয় দিন তিনি ফের ঢাকায় আসেন। তখন যত আসন তত যাত্রী বসিয়ে বাস ছাড়ে। কিন্তু প্রত্যেক যাত্রীর কাছ থেকে রাখা হয় বর্ধিত ৪৫০ টাকা ভাড়া। যাত্রী প্রতিবাদ করলে কাউন্টার থেকে বলা হয়, সরকারী নির্দেশ অনুযায়ী তারা বাস চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, সাধারণ সময়ে ভাড়া ২৫০ টাকা। ৬০ ভাগ বর্ধিত করা হলে ৩৯৫ টাকার পরিবর্তে রাখা হয় ৪৫০ টাকা। অর্থাৎ যাত্রী প্রতি সরকার নির্ধারিত ভাড়ার বাইরে ৫৫ টাকা বেশি রাখা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা তারেক জানান, তিনি ঈদের তৃতীয় দিন নেত্রকোনা থেকে ঢাকা আসেন। তখন বিআরটিসি ঈদ স্পেশাল সার্ভিস হিসেবে সব বাস প্রতি আসনে যাত্রী নিয়ে ৬০০ টাকা করে ভাড়া আদায় করে। বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসলে সোমবার নেত্রকোনায় নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসক কাজি মো. আবদুর রহমান শাহজালাল এক্সপ্রেসে অভিযান চালান। আসন প্রতি যাত্রী তোলা, বাড়তি ভাড়া ও স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে বাসপ্রতি ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহের শেরপুর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ থেকে মহাখালীতে আসা বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির যাত্রীরা বাড়তি বাস ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেন। তেমনি কোন রকম স্বাস্থ্যবিধি না মানায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। এর বাইরে চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ হ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন রুটের যাত্রীরা বাড়তি বাস ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেন। স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক দূরত্ব কোনটাই মানা হচ্ছে না কুমিল্লার গণপরিবহনগুলোতে। বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে প্রতিটি বাস ও মিনিবাসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচলের সরকারী নির্দেশনা থাকলেও জেলার শাসনগাছা, চকবাজার এবং জাঙ্গালিয়া বাস টার্মিনালের কোন পরিবহনে তা মানতে দেখা যায়নি। তবে ৬০ শতাংশ বর্ধিত ভাড়া ঠিকই নেয়া হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। পাশাপাশি দুই জনের সিটে একজন বসার বিধান থাকলেও এখন কোন পরিবহন সেই নিয়ম মানছেন না। এছাড়া জীবাণুনাশক স্প্রে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার কোন কিছুরই ব্যবহার করছেন না পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। শতভাগ যাত্রী পরিবহনের বিষয়ে তিশা পরিবহনের চালকের সহকারী সিফাত জানান, কোরবানির ঈদের আগ থেকেই তারা শতভাগ যাত্রী নিয়ে ঢাকা-কুমিল্লায় আসা-যাওয়া করছেন। যাত্রীরা অতিরিক্ত ভাড়ায় অনীহা প্রকাশ করায় পরিবহন মালিকদের নির্দেশে সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মানা যাচ্ছে না। দূরপাল্লার এবং আঞ্চলিক পরিবহনগুলো চলাচলে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক দূরত্ব না মানার বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা বাস মালিক সমিতির মহাসচিব মো. তাজুল ইসলাম জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে প্রশাসনের নানা প্রচারণার পরও কোন পরিবহন সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক দূরত্ব মানছেন না। আমরা পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছি সরকারের নির্দেশনা মেনে চলাচল করার জন্য। কিন্তু, তারা জানায় অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচলে তাদের লোকসান হচ্ছে। তারপরও আমরা বসে নেই। করোনা সংক্রমণ রোধের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করব। পরিবহনে সামাজিক দূরত্ব মানার বিষয়ে কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন জানতে চাইলে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর জানান, স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাচলের জন্য কুমিল্লার সকল পরিবহনের সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে। যারা মানছেন না তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি না মানা ও বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে সোমবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, কোথাও কোথাও গণপরিবহন স্বাস্থ্যবিধি এবং মালিক-শ্রমিকদের প্রতিশ্রুতি সমন্বয় করা ভাড়া মানছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, যা প্রত্যাশিত নয়। পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক সংগঠনগুলো এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিলেও ভাড়া আদায় এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে গাড়ি চালানোয় কেন তারা ব্যর্থ হচ্ছেন? পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিআরটিএকে যেসব পরিবহন সরকারী নির্দেশনা প্রতিপালনে ব্যর্থ হবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সক্রিয় থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। সতর্কতার সাথে ঈদের পর গাড়ি চালানোর অনুরোধ করা হলেও তারা তা মানেননি। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণেই ঘটছে দুর্ঘটনা। জনগণকে আর কতদিন এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে? ঈদের সময় অনেক পরিবহন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেনি। অর্ধেক আসন খালি রাখার কথা থাকলেও অনেক পরিবহন তা মানেনি। এমনকি এখনও সমন্বয় করা ভাড়া না মানার অভিযোগ আছে। জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, আমরা কিছু পরিবহন কোম্পানির বিরুদ্ধে বাড়তি ভাড়া ও স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গের অভিযোগ পাচ্ছি। তাদের মালিক সমিতির পক্ষ থেকে সতর্ক করা হচ্ছে। ৬০ ভাগ বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহার দাবি ॥ করোনাভাইরাস সঙ্কটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন পরিচালনার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার অজুহাতে একলাফে বাসের ৬০ শতাংশ বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ দাবি জানান। বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন, এখন দেশের কোনো গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। যেসব শর্ত অনুসরণ করে বর্ধিত ভাড়া আদায়ের কথা বলা হয়েছিল, তার কোনোটাই মানা হচ্ছে না। সেই পুরনো কায়দায় গাদাগাদি করে যাত্রী বহন করা হচ্ছে। আবার এই করোনাকালীন ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য সরকারের বর্ধিত ৬০ শতাংশ ভাড়ার চেয়েও অধিকাংশ রুটে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এতে করোনা সংকটে কর্মহীন ও আয় কমে যাওয়া দেশের সাধারণ মানুষের যাতায়াত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। উল্লেখ্য, সরকার যাত্রী প্রতিনিধি বাদ দিয়ে মালিকদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে করোনার এই মহাসঙ্কটে থাকা দেশের অসহায় জনগণের ওপর একচেটিয়াভাবে বাসের ভাড়া ৬০ শতাংশ বর্ধিত করে অযৌক্তিকভাবে চাপিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে দেশব্যাপী চলাচলরত বাস-মিনিবাসের সঙ্গে লেগুনা, হিউম্যান হলার, টেম্পো, অটোরিক্সা, প্যাডেলচালিত রিক্সা, ইজিবাইক, নসিমন-করিমন, টেক্সিক্যাবসহ সকল প্রকার যানবাহনের ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এতে যাত্রীস্বার্থ চরমভাবে উপেক্ষিত হয়, ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানিতে আরেক দফা উসকে দেয়া হয়। তৎসময়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে এই ভাড়া বৃদ্ধির তীব্র বিরোধিতা করা হলেও তা আমলে নেয়া হয়নি। বিবৃতিতে অনতিবিলম্বে স্বাস্থ্যবিধির নামে গণপরিবহনের বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহার করে দেশের প্রতিটি রুটে বর্ধিত ভাড়া পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব।
×