ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নামছে বন্যার পানি, বাড়িঘরে ফিরছেন মানুষজন

প্রকাশিত: ২২:৫২, ১২ আগস্ট ২০২০

নামছে বন্যার পানি, বাড়িঘরে ফিরছেন মানুষজন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বন্যার পানি নামতে থাকায় দীর্ঘ দেড় মাস পর বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। পানি কমলেও দুর্ভোগ তাদের পিছু ছাড়ছে না। আক্রান্ত লোকজন জানান, দেড় মাস ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে থাকার কারণে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ফলে নতুন করে মেরামতের দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। দীর্ঘদিন বন্যার কবলে পড়ে কর্মহীন অনেকেই। ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়েছে। এই অবস্থায় নতুন করে বাঁচার সংগ্রাম শুরু করতে হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, এখনও চার জেলা বন্যায় আক্রান্ত। ২৪ ঘণ্টায় এসব জেলায় বন্যার উন্নতি হতে পারে। তবে পানি কমে যাওয়ার সুখবরের মধ্যে আবারও দুশ্চিন্তা ভর করছে। কয়েকদিন ধরে একটানা পানি কমার পর হঠাৎ বাড়তে শুরু করেছে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি। দু’একদিনের মধ্যে যমুনা নদীর পানি বাড়ার আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, আজকের মধ্যে উত্তরের প্রধান নদী যমুনার পানি স্থিতিশীল হয়ে আসবে। এরপরই পানি বাড়তে শুরু করবে। এতদিন ধরে উত্তরের এই দুই প্রধান নদীর পানি কমতে শুরু করেছিল। অনেক স্থানে বিপদসীমার নিচে নেমে এসেছিল পানি। শুধু ব্রহ্মপুত্র, যমুনা নয় অন্য প্রধান নদীর পানি বাড়বে ১৬ আগস্টের পর থেকে। ফলে আরও এক দফা বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে। অধিকাংশ নদীর পানি আবারও বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভুইয়া বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি সমতলে বাড়ছে। এটা অব্যাহত থাকবে। আজকের মধ্যে যমুনা নদীর পানি স্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। এরপরই যমুনা নদীর পানি আবারও বেড়ে যাবে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতলে এখনো কমছে। আগামী আরও কয়েকদিন কমবে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুশিয়ারা নদী ব্যতীত মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি কমছে। আজকের মধ্যে নাটোর, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ীর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। ঢাকার সিটি কর্পোরেশনের নি¤œাঞ্চলেও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, পর্যবেক্ষণকৃত ১০১টি সমতল স্টেশনের মধ্যে মঙ্গলবার পানি বেড়েছে ২৭টিতে, কমেছে ৭২টি পয়েন্টে। বন্যায় আক্রান্ত জেলার সংখ্যা বর্তমানে চারে নেমে এসেছে। বিপদসীমার ওপর দিয়ে এখনও প্রবাহিত হচ্ছে ছয়টি নদীর পানি সাতটি স্থান দিয়ে। তারা জানায় যেসব নদী এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে তার মধ্যে রয়েছে গুড় নদীর পানি সিংড়া এলাকায়, ধলেশ্বরী নদীর পানি এলাসিনে, তুরাগ নদীর পানি রাজধানীর মিরপুর পয়েন্টে, টঙ্গী পয়েন্টে টঙ্গীখালের পানি, কালিগঙ্গা নদীর পানি তরাঘাট দিয়ে, গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। তবে দেশের প্রধান নদীগুলোর মধ্যে পদ্মার পানিই এখনো বিপদসীমা অতিক্রম করে বইছে। যমুনা ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনার পানি আগেই বিপদসীমার নিচে নেমে গেছে। তবে আবারও পানি বাড়লে এসব নদী বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার অতি বৃষ্টির কারণেই বন্যা এত দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। বাংলাদেশের চেয়ে উজানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। উজান থেকে নেমে আসা পানিতে বন্যা পরিস্থিতির যেমন অবনতি হয়েছে, তেনি দেশের ভেতরের বৃষ্টির কারণেও পানি নামতে অনেক দেরি হয়েছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ না করলেও বৃষ্টির কারণে বন্যা প্রায় ৫০ দিন স্থায়ী হয়ে পড়েছে। ফলে এই দীর্ঘ সময় ধরেই বন্যায় আক্রান্ত মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্র বা উঁচু বাঁধে কাটাতে হয়েছে। অবশেষে পানি কমতে থাকায় মানুষজন এখন বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি সেন্টার ও নিয়ন্ত্রণকক্ষের হিসাবে এবার শুরু থেকে এই পর্যন্ত ৩৬ হাজার ২২৩ জন বন্যার কারণে নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন ১৯৩ জন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন নয় হাজার ৮৩৯ জন, আর মারা গেছেন চারজন। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন মাদারীপুরে ১৩ হাজার ১১৫ জন। বন্যায় সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন টাঙ্গাইলে ৩৪ জন। এরপরেই রয়েছে জামালপুরে ২৯ জন। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বন্যায় গত ২৭ জুন থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ৪১ জন মারা গেছেন। বন্যায় এখনও প্রায় সাড়ে ৯ লাখ পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় আছে। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষের অর্ধেক বাড়িতে ফিরে গেছেন। সপ্তাহখানেক আগেও প্রায় ৮০ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ছিল, মঙ্গলবার তা কমে ৪০ হাজারে নেমে এসেছে। এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে মানবিক সহায়তা হিসেবে বিতরণের জন্য ১৯ হাজার ৫১০ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বিতরণ করা হয়েছে ১১ হাজার ৭৫০ টন চাল। বন্যাকবলিত জেলা প্রশাসন থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী নগদ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে চার কোটি ২৭ লাখ টাকা এবং বিতরণ করা হয়েছে দুই কোটি ৭৮ লাখ ৩০ হাজার ৭শ টাকা। শুকনো ও অন্য খাবার বিতরণ করা হয়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার ৩৩৬ প্যাকেট। শিশুখাদ্য সহায়ক হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে ৯১ লাখ ১৩ হাজার ৮৫৬ টাকা। গো-খাদ্য কেনার জন্য বিতরণের পরিমাণ এক কোটি ৭৮ লাখ ১৪ হাজার টাকা। এছাডাও ঢেউটিন বিতরণ করা হয়েছে ১০০ বান্ডিল, গৃহ মজুরি বাবদ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১২ লাখ টাকা এবং বিতরণ করা হয়েছে ৩ লাখ টাকা। এবারের প্রথম থেকে যেসব জেলায় বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে, ঢাকা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ। বন্যাকবলিত উপজেলার সংখ্যা ১৬৫টি এবং ইউনিয়নের সংখ্যা এক হাজার ৮৬টি। আর পানিবন্দী পরিবার সংখ্যা ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৩১৩টি এবং ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৪ লাখ ৫১ হাজার ৫৮৬ জন। বন্যায় এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪১ জন। বন্যাকবলিত জেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এক হাজার ২৯৫টি। আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত লোকসংখ্যা ৪০ হাজার ৩৬০ জন। আশ্রয়কেন্দ্রে আনা গবাদিপশুর সংখ্যা ৬৭ হাজার ৪০৮টি। বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে ৮২৪টি এবং বর্তমানে চালু আছে ২৫৮টি।
×