ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বদলায় উৎসব...

প্রকাশিত: ২১:০৪, ১২ আগস্ট ২০২০

বদলায় উৎসব...

প্রচণ্ড এক ঝড়ো হাওয়া যেন বইছে পৃথিবীতে। তার পরও উৎসব এসেছিল। নিভৃতেই চলে গেছে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে শত তর্ক-অভিযোগ আর উপচে পড়া যানজটের সড়ক পেরিয়েই ছুটেছে মানুষ। সারা বছরের অন্তহীন পথচলার শ্রান্তি মুছে যায় ক’দিনের আনন্দে। প্রিয়জনের দ্বারে পৌঁছে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে। পেছনে পরে থাকে দুঃসময়ের স্মৃতি অন্তত ক’দিনের জন্য হলেও। এবার তার ব্যতিক্রম হলো। আজকের দিনে মানুষের কাজের ব্যস্ততায় বিচ্ছিন্নতা বাড়ে। বিচ্ছিন্নতার সুতাগুলো জোড়া দেয় উৎসব। বারো মাসে তেরো পার্বণের শান্ত গ্রামীণ জীবন পেরিয়ে নগর জীবনে বিচরণ বেড়েছে। ভিন্ন রূপে ফিরেছে পালাপার্বণ। বারো মাসে তেরো না হলেও উৎসবের অভাব নেই জীবনে। কৃষিনির্ভর সমাজে পার্বণের ছুঁতোয় দেখা হতো একের সঙ্গে অন্যের। বিনিময় হতো মনের ভাব। উৎসবকে কেন্দ্র করে এখনও তাই হয়। তবে তা নাগরিক ফর্মে। মিউজিক থেকে ফ্যাশন ট্রেন্ড, কিচেন থেকে টেলিভিশনÑ সবখানে লেগেছে তার ছোঁয়া। ফেস্টিভ মুড এসেছে নগর জীবনে। সবচেয়ে জাগ্রত ভূমিকা টেলিভিশনের। সিনেমা, নাটক, সঙ্গীত, ফ্যাশন রূপ রেসিপি ইন্টেরিয়র কী নেই সেখানে। দর্শকের এক বড় অংশের ফ্যাশন ট্রেন্ডও সেট করছে টেলিভিশন। ভারতীয় সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকারা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের স্টাইল স্টেটমেন্টের ফ্যাশন আইডল। ব্যবসায়ীরা চটজলদি চালু সিরিয়ালের হিট নায়িকার নামে শাড়ি-গয়নার পসরা সাজিয়ে ফেলেন। দারুণ কাটতি দেখা দেয়। দেশীয় বুটিক শপের কর্ণধাররা মন খারাপ করে মুক্তবাজারে প্রতিযোগিতায় কোন রকম টিকে থাকেন। তারা ভরসা করেন রুচিশীল ক্রেতার ওপর। ফ্যাশন ক্যাটালগ দেখে বুটিক শপে ছোটার ক্রেতাও একেবারে কম নয়। নিজস্ব স্টাইল স্টেটমেন্টে বিশ্বাসীরা ওখানেই ভিড় জমান বেশি। আরেক দলের উৎসবে তো থাকেই ব্যান্ডের গান-সঙ্গে নাচ, পিজ্জা হাট বা কেএফসিতে স্পেশাল ডিনার, লং ড্রাইভ বা বন্ধুর আড্ডায় সফট ককটেল পার্টি। এসব কিছু এসে গেছে শহুরে উৎসবে। কোনটাকেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। দেয়ার দরকারই বা কতটা। ১৯৩৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রাদেশিক বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘একদিন কলকাতা ছিল অখ্যাত অসংস্কৃত পল্লী, সেখানে বসল বিদেশী বাণিজ্যের হাট, গ্রামের শ্যামল আবেষ্টন সরিয়ে দিয়ে শহরের উদ্ধত রূপ প্রকাশ পেতে লাগল। সেই শহর আধুনিককালকে দিল আসন পেতে; বাণিজ্য এবং রাষ্ট্রের পথে দিগন্তের পর দিগন্তে সেই আসন বিস্তৃত হয়ে চলল। এই উপলক্ষে বর্তমান যুগের বেগবান চিত্তের সংস্রব ঘটল বাংলাদেশে। বর্তমান যুগের প্রধান লক্ষণ এই যেসব, যে সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতায় বদ্ধ বা ব্যক্তিগত মূঢ় কল্পনায় জড়িত নয়। কী বিজ্ঞানে, কী সাহিত্যে সমস্ত দেশে সমস্ত কালে তার ভূমিকা। ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক সভ্যতা সর্ব মানবচিত্তের সঙ্গে প্রশস্ত মানসিক দেনা-পাওনার ব্যবহার প্রশস্ততর হয়েছে।’ সবই হয়েছে সময়ের দাবি মেনে। আজকের উৎসব উদযাপনের ফর্মের সঙ্গে আগেকার ফর্ম মিলবে না তাই স্বাভাবিক। সাঈদ আহমদ উৎসবের স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে- ‘পায়জামা আর পাঞ্জাবি ছিল সকালের ড্রেস। একটু বেলা গড়ালেই স্ট্রেইট প্যান্ট, শর্ট শার্ট আর টমি বয় জুতা পরে ঘুরতে যেতাম রায়সাহেব ব্রিজে। সেখান থেকে ফুফুর বাড়ি হয়ে সালামি পকেটে পুরে বোস কেবিনে চপ কাটলেট খাওয়ার স্মৃতি এখনও চোখে ভাসছে। বোস কেবিন রূপমহল সিনেমা হলের পাশেই ছিল। এখন উঠে গেছে। আগের দিন একটা আবশ্যিক পর্ব ছিল চুল কাটা। আজকালকার ছেলেরা যেমন রাহুল কাট, শাহরুখ কাট চুল ছাঁটে। আমাদের সময় চালু ফ্যাশন ছিল দিলীপ কাট। তখন দিলীপ কুমারের হেয়ার স্টাইল ফলো করত ছেলেরা। চুল কাটার আরেকটা ফ্যাশন ছিল দশ আনা ছয় আনা। সাইডে ছয় আনা আর সামনে দশ আনা। অর্থাৎ সামনে বড় আর চারপাশে ছোট চুল। ...ত্রিশের দশকে ঢাকা খুব বড় শহর ছিল না। একদিকে বুড়িগঙ্গার সদরঘাট থেকে অন্যদিকে ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন। আরেকদিকে নবাবগঞ্জ থেকে লোহারপুল গে-ারিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। এই এলাকার ভেতরই ঘনবসতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কোর্ট-কাছারি, নবাব-আমলা সবাই বসবাস করতেন। ...শ’খানেক মোটরগাড়ি ছিল ঢাকায় আর যানবাহনের মূল উৎস ছিল ঘোড়ার গাড়ি। রিক্সার কোন বালাই ছিল না। বর্তমান গুলিস্তান, স্টেডিয়াম, মতিঝিল প্রায় সবটাই ময়দান আর ময়দান ছিল।’ এখন শহর বেড়েছে, মানুষ বেড়েছে, পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বেড়েছে। উৎসবের ধরনও বদলেছে। সুদূর আমেরিকার ডালাস থেকে কিংবা কানাডার টরন্টো থেকে প্রবাসী ছেলেমেয়েরা মাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দিন শুরু করে। দিনে আরও কয়েকবার কথা হয় তাদের। শেয়ার হয় আনন্দ। শরীরী উপস্থিতি না থাকলেও বিশ্বময় ছড়িয়ে যায় প্রাণের আনন্দ। দেশের সীমানা সে তো ভৌগোলিক। জীবনে আনন্দ-বেদনার টেক্সট এখন ওয়েবে। পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ- সবখানে ছড়িয়ে গেছে তা। হারিয়ে যাওয়া উৎসব নিয়ে হতাশা বা স্মৃতি তর্পণ সেকালের তথ্যই দিতে পারে শুধু, সেখানে ফেরার কোন উপায় নেই, প্রয়োজন তো নেই-ই। সত্যি বলতে বাস্তব জীবনে অন্য কোন মাত্রা নেই তার। উৎসবের আনন্দ আগের মতোই আছে। আগের প্রজন্মের কাছে তার পাঠ ছিল এক রকম এ প্রজন্মে তা বদলে যাবে সেই তো স্বাভাবিক। পরিবর্তনকে ধারণ করে চলাই জীবনের লক্ষণ। সৈয়দ মুজতবা আলী বলছেন, ‘মা খুব ভোরে উঠে আমাদের খাইয়ে দাইয়ে রোদে বসেছেন। আমরা সকলে শিউলি ফুলের পাপড়ি ছাড়িয়ে লাল বোঁটা একত্র করছি। মা পাশে বসে সেমাই তৈরি করছেন। ...সেমাই ডালার ওপর রেখে মা রৌদ্রে শুকাতে দিলেন। শিউলির বোঁটাও রৌদ্রে দিলেন, তারপর মা কাপড় কেটে পাজামার মাপ নিলেন ...সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গায়ের জামার মাপ। আমাদের কি আনন্দ। ...সন্ধ্যার সময় শিউলি বোঁটা উঠিয়ে মা একটি বোতলের ভেতর রাখলেন আর সেমাই ভর্তি করলেন বিস্কুটের টিনে। ‘...মা রাঁধবেন কোরমা পোলাও। আর জর্দাতে দেবেন ওই শিউলি ফুলের বোঁটার রং-তাতে জর্দার শুধু যে রং খোলতাই হবে তা নয়- চমৎকার ঘ্রাণও বেরুবে। আর সেমাই তৈরি হবে যে সেমাই মা নিজের হাতে সারা মাসভর করেছেন, আমাদের গায়ে উঠবে মার নিজের হাতে সেলাই জামা-পাজামা। মাকে নিয়েই খুশির সব, তাতে রয়েছে মার হাতের স্নেহের পরশ। এ খুশি ভোলার নয়।’ যে কাজগুলো একা মা করতেন তখন আজ তার প্রতিটার দায়িত্ব নিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পেশাদার বিশেষজ্ঞরা। মারও এখন উৎসবে ছুটি মেলে। আর কিছু না হোক টেলি উৎসবের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছেন তিনি নিজেকে। উৎসব এগিয়ে চলে এভাবে সময়ের সঙ্গে রূপ বদলে। [email protected]
×