ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক রূপ পাচ্ছে ওসমানী বিমানবন্দর

প্রকাশিত: ২৩:১০, ১১ আগস্ট ২০২০

পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক রূপ পাচ্ছে ওসমানী বিমানবন্দর

আজাদ সুলায়মান ॥ সিলেটের এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে সাজানো হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক রূপে। দু’হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইতোমধ্যে বিমানবন্দরটির সংস্কার ও সম্প্রসারণের জন্য আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের জোর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। আগামী মাসের মধ্যে যে কোন মূল্যে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের লক্ষ্যে সাজানো হয়েছে ব্যাপক কর্মশালা। পৃথিবীর অষ্টম বৃহৎ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চীনের বিইউসিজি নামের কোম্পানি এরই মধ্যে গ্রাউন্ডওয়ার্ক শুরু করেছে। মাস পাঁচেক আগে এ প্রকল্পের কার্যাদেশ পেয়ে ওই কোম্পানি অন্তত এক ডজন বিশেষজ্ঞ এখন ঢাকা ও সিলেটে অবস্থান করছেন। কোভিড বিপর্যয় দেখা না দিলে এতদিনে প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়ে যেত। তারপরও থেমে নেই প্রকল্পের কাজ। বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, সিনিয়র সচিব মহিবুল হক ও বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান ইতোমধ্যে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক মনিটর করছেন। তারা চাইছেন করোণা তা-বকে উপেক্ষা করে যে কোন মূল্যে প্রকল্পটির আনুষ্ঠাকি যাত্রা শুরু করতে। দেশের তৃতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে সিলেটকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও চাচ্ছেন যথাসময়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ শুরু ও শেষ করতে। যাতে আন্তর্জাতিক এভিয়েশনেও ওসমানী বিমানবন্দর একটা নিজস্ব অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। বর্তমানে সিলেটে লন্ডন থেকে আগত আান্তর্জাতিক ফ্লাইট ল্যান্ড করতে পারলেও চার শতাধিক আসনের সুপরিসর বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ প্রয়োজনীয় জ্বালানি ও পূর্ণ আসনের যাত্রী নিয়ে উড্ডয়ন করতে পারছে না। রানওয়ের তেমন সক্ষমতা নেই। যদিও লন্ডন থেকে এ পরিমাণ যাত্রী ও জ্বালানি নিয়ে ওই উড়োজাহাজ রওনা হয়ে সিলেটে অবতরণ করতে পারছে। এটা সম্ভব হচ্ছে- লন্ডন থেকে যখন উড়োজাহাজটি সিলেটে আসে ততক্ষণে সব জ্বালানি শেষে ঢাকায় ফেরার মতো লোডে থাকে। নতুন প্রকল্পটিতে এখানে রয়েছে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ফুয়েলিং সিস্টেম অর্থাৎ সুবিশাল জেট-১ ফুয়েল ডিপো। দেশের তৃতীয় বৃহৎ এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণ কাজ আগামী তিন বছরের মধ্যেই শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে তৎপর রয়েছে বেবিচক। বর্তমান সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার এই প্রকল্প সম্পর্কে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী সোমবার দৈনিক জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর যাত্রী ও কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতার মান ও পরিধি বৃদ্ধির লক্ষ্যেই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হাতে নিয়েছে বেসরকারী বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। ইতোমধ্যে দুটি মেগা প্রকল্পসহ ২০ হাজার কোটি টাকার বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। আরও কয়েকটি প্রকল্পের দরপত্রের কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পগুলোর কাজ আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে শেষ হবে। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হলেই বদলে যাবে বিমানবন্দরগুলোর চেহারা। তার মধ্যে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও কক্সবাজার বিমানবন্দরের সংস্কার, সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ সমাপ্ত করার তাগিদ দিয়েছেন। এর মধ্যে থার্ড টার্মিনালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার প্রায় ৫ শতাংশ কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় প্রকল্প হিসেবে সিলেটের ওসমানীকে পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক রূপ দিতে এরই মধ্যে কার্যাদেশ দেয়া হয়ে গেছে বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চীনের বেইজিং আরবান কনস্ট্্রাকশন গ্রুপ তথা (বিইউসিজি)কে। এরই মধ্যে কোম্পানির বিশেষজ্ঞরা করোনা মহামারী উপেক্ষা করে ঢাকায় এসে ডিটেইলড ডিজাইনের খুঁটিনাটি চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। আমাদের টার্গেট আগামী তিনমাসের মধ্যে যে কোন মূূল্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা। এ ছাড়া কক্সবাজারের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রথম দরপত্র দুর্ভাগ্যজনকভাবে পিছিয়ে গেছে। সব কিছু ঠিক থাকার পরও তা বাতিল হয়ে গেছে। যা ছিল অনাকাক্সিক্ষত। সব কিছু যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেও যদি চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে সেটা বাতিল হয়ে যায় তাহলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে কিভাবে? এখন কক্সবাজার রিটেন্ডার করা হলে প্রকল্পের সময় যেমন বাড়বে ব্যয়ও বেড়ে যাবে অনেক। অথচ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে কোল ঘেঁষে নীলাভ জল রাশির মাঝে বিশাল এ৩৮০-এর মতো উড়োজাহাজ অবতরণ করবে এমন স্বপ্ন দেখেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। এ বিষয়ে সিনিয়র সচিব মহিবুল হক বলেন, এখন শোকের মাস। নইলে এ মাসেই হয়তো শুভ উদ্বোধন করা যেত। তারপরও আমরা আগামী মাসের শুরুতে যাতে উদ্বোধন করা যায় সেভাবে চিঠি পাঠানো হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে এটা উদ্বোধন করবেন বলে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, বর্তমানে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিনন্দন টার্মিনাল ও কন্ট্রোল টাওয়ারের নির্মাণ কাজ। টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের সঙ্গে এয়ারফিল্ড গ্রাউন্ড লাইট এপ্রোন স্থাপনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। সব কিছু যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই চীনের স্বনামধন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিইউসিজিকে গত ২৪ মার্চ কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। প্রকল্পের বিস্তারিত জানতে চাইলে বেবিচক প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মালেক জানান, বিইউসিজি বিগত তিন দশক ধরে সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাতিকমানের বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন নির্মাণ কাজ করে আসছে। তারা নির্মাণ প্রকৌশল, রিয়েল-এস্টেট, ডিজাইন, ইনভেস্টমেন্ট, প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি বিষয়ক ৬টি মূল ব্যবসা পরিচালনা করছে- যার মাধ্যমে তাদের বার্ষিক মুনাফার পরিমাণ প্রায় ৫৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে, বিইউসিজি ১২০ টিরও বেশি কর্পোরেট শাখা, ২৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পত্তি ও ২৫ হাজারের অধিক জনবল নিয়ে বিভিন্ন দেশে কাজ করে যাচ্ছে- যার স্বীকৃতিস্বরূপ ভূষিত হয়েছে একাধিক সনদে। ইতোমধ্যে তারা সফলভাবেই বেজিং ক্যাপিটাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, মালদ্বীপ ভেলেনা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিকমানের কাজ সম্পন্ন করেছে। এসব বিবেচনায় সিলেট ওসমানি বিমানবন্দরের কাজের জন্য বিইউসিজিকে কার্যাদেশ প্রদান করে। জানা গেছে, এই প্রকল্পের আওতায় একটি পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক টার্মিনালের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নতুন বোর্ডিং ব্রিজ, ব্যাগেজ হ্যান্ডেলিং সিস্টেম, ফ্লাইট ইনফরমেশন ডিসপ্লে সিস্টেমসহ অন্যান্য অত্যাধুনিক টার্মিনাল বিল্ডিং সম্পর্কিত সকল ধরনের যন্ত্রপাতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যার ফলশ্রুতিতে বিমান বন্দরের যাত্রী সেবার মান বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। বিমানবন্দর টার্মিনালে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহের জন্য এই প্রকল্পের আওতায় পৃথক সাবস্টেশন স্থাপনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এছাড়াও বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম এবং স্বাচ্ছন্দ্যে টার্মিনাল ব্যবহারের জন্য সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সিএএবি কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সদস্যদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। সম্প্রতি এটি বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক নিরাপত্তাযন্ত্র ক্রয় করে। এর মধ্যে ছিল বিশ্বমানের ইডিএস সিস্টেম। কার্গোতে ইডিএস ও আরএথ্রি এরিয়া সংযোজনের মাধ্যমে কার্গো স্ক্যানিং আরও নিখুঁত এবং সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত করা হয়। যাত্রী সেবার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে লিফট এস্কেলেটর, এয়ারপোর্ট সাইনেজ এবং নজরদারি জোরদার করার জন্য সিসিটিভি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি উড়োজাহাজের জেট-১ জ্বালানি সরবরাহের জন্য অত্যাধুনিক ফুয়েল হাইড্রান্ট সিস্টেম স্থাপন করা হবে। এতে সকল ধরনের উড়োজাহাজ খুব সহজে ও নিরাপদে বিমানবন্দর থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করতে পারবে। তাছাড়া বিমানবন্দর টার্মিনাল ব্যবহারকারী যাত্রীদের নিরাপদ পানি সরবরাহের লক্ষ্যে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ও কার্যকর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। উড়োজাহাজের পাইলট এবং এয়ারট্রাফিক কন্ট্রোলারদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে ও নিরাপদ বিমান উড্ডয়নের জন্য সম্পূর্ণ ভয়েস কন্ট্রোল কমিউনিকেশন্স সিস্টেম ও ভয়েস রেকর্ডিং রাডার সিস্টেম স্থাপন করা হবে। সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে এবং বিদ্যমান রানওয়েকে শক্তিশালী ও প্রশস্তকরণের পাশাপাশি নির্ভরযোগ্য লাইটিং সিস্টেমে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। রানওয়ের কাজ শেষ হলে এবং জ্বালানি ডিপো চালু হলে সিলেট থেকে সরাসরি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের অপারেট করা যাবে। প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর ভাষ্যমতে-প্রতিবছরই বেবিচকের রাজস্ব আয় বাড়ছে। চলতি প্রকল্পগুলো শেষ হলে একদিকে যেমন উন্নত হবে দেশের সার্বিক বিমান চলাচল ব্যবস্থা অন্যদিকে তেমনি বৃদ্ধি পাবে দেশের রাজস্ব আয়। এ লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর সর্বোচ্চ জোর দিয়ে কাজ করছে।
×