ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আইন-আদালত-বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অভিজ্ঞতা ও ভাবনা

প্রকাশিত: ২১:০৬, ১১ আগস্ট ২০২০

আইন-আদালত-বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অভিজ্ঞতা ও ভাবনা

(গতকালের পর) বঙ্গবন্ধু কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৩৭) বর্ণনা করেছেন বিত্তবান ও প্রভাবশালী হাজতি-কয়েদিরা জেলের ডাক্তারকে অর্থ দিয়ে ম্যানেজ করে কিভাবে অসুস্থ না হয়েও হাসপাতালে ভর্তি হয়ে জামিন লাভের জন্য ‘অসুস্থতার প্রত্যয়নপত্র’ সংগ্রহ করে। কারাগারের এ চিত্র ও অভিযোগ আজও বিদ্যমান। বঙ্গবন্ধু আইনের শাসন ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় গভীরভাবে বিশ^াসী ছিলেন। নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে তিনি সব সময় ছিলেন সোচ্চার। কারণ এই আইনের অপপ্রয়োগে দীর্ঘদিন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিনাবিচারে আটকে রাখা হতো। বিনাবিচারে আটকের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সব সময় সোচ্চার ও প্রতিবাদী। ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ গণপরিষদের অধিবেশনে সেফ্টি এ্যান্ড প্রিভেন্টটিভ ডিটেনশন এ্যাক্ট-এর ওপর সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু স্পীকারের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘স্যার....। আমরা ইসলামিক প্রজাতন্ত্র অফ পাকিস্তান দিয়ে শুরু করেছি। এটা ভাল নাম এবং অবশ্যই আমরা এতে খুশি। কিন্তু আমি কি তাঁকে (বিলটির উপস্থাপক) অনুরোধ করব এটা দেখাতে যে, ইসলামিক আইনে কাউকে বিনা বিচারে শাস্তি দেয়া যায়? আমি যতদূর জানি, বিচার ব্যতীত কাউকে শাস্তি দেয়া যায় না। যদি তাই হয়, তাহলে এটা হবে জনগণকে ধোঁকা দেয়া।....। আমি মাওলানা আতাহার আলী ও জনাব ফরিদ আহমেদকে জিজ্ঞাসা করতে চাই- তাঁরা কি বলতে পারবেন ইসলাম বিনা বিচারে একজন ব্যক্তির আটককে সমর্থন করে? স্যার, বিগত সাত বছরে পূর্ব বাংলায় এই বিশেষ আইন ক্ষমতাসীন দল তাদের বিরোধীদের দমন করার জন্য ব্যবহার করেছে, যা ইতিহাসে নজিরবিহীন। যে জনগণ পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম, ত্যাগ স্বীকার, জীবন বিপন্ন এবং নিজেদের ভবিষ্যতকে নষ্ট করেছে তাদের বিরুদ্ধে এই বিশেষ আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু কেন? শাসক মুসলিম লীগের কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্য।......। এখন পর্যন্ত আইনসভার সদস্য আব্দুস সামাদ, মান্নান, মফিজুল ইসলামসহ অনেকেই কারাগারে আটক এই আইনে।.......। স্যার, এটা আপনার ও আমাদের জন্য অপমান নয়?....। স্যার, আমরা পূর্ব বাংলায় মানুষের কাছে এই আইন বাতিলের জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলাম; এটা সংবিধানের অংশ হতে পারে না। কারো বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলে, আমরা আদালতে যাব, আমাদের বিচার ব্যবস্থা আছে। আমরা বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ করব, শাস্তি দিতে পারি, ফাঁসি দিতে পারি; আমাদের তা করার অধিকার আছে, কিন্তু কেন এই কালো আইন, ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের কথা বলে বিনাবিচারে আটক। স্যার, ২১ দফা কর্মসূচীতে ‘সেফটি এ্যান্ড প্রিভেনটিভ ডিটেনশন’ আইন বাতিলের কথা উল্লেখ আছে এবং বিনাবিচারের আটককৃত সকলকে মুক্তি এবং প্রকাশ্য আদালতে বিচার করার কথা উল্লেখ ছিল।.... । স্যার, আমরা যদি জনগণকে সাংবিধানিক কর্মকা- করতে না দেই, তাহলে জনগণ অসাংবিধানিক পথ বেছে নিবে। স্যার এটাই ইতিহাস। জনগণকে সংবিধান অনুযায়ী চলতে দিন, অন্যথায় তারা অসাংবিধানিক উপায়ে সরকারকে উৎখাত করবে। জনগণকে সংবিধান অনুসারে চলতে, সংঘটিত ও মতামত প্রকাশের সুযোগ দিন, নতুবা তারা গুপ্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। স্যার, এটাই ঘটবে। (মূল বক্তব্যটি ইংরেজিতে ছিল; অনুবাদ নিজের)। বঙ্গবন্ধু দীর্ঘদিন বিভিন্ন পর্যায়ে কারাগারে থেকে আটক বিভিন্ন শ্রেণীর বন্দীদের (হাজতি-কয়েদি ও নিরাপত্তা আইনে আটক) খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাদের দুঃখ, কষ্ট, হয়রানি, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, বন্দিদের সংসার ভেঙ্গে যাওয়া, কারাগারের অভ্যন্তরের ঘুষ-দুর্নীতি, আইন আদালত ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতায় প্রভূত সমৃদ্ধ হয়েছিলেন। সেকারণে-স্বাধীনতার পর তাঁর প্রত্যয় ছিল আইন আদালত ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কার করে এটাকে সহজতর করা, যাতে বিচার প্রার্থীদের দ্রুত ও সহজে বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা বঙ্গবন্ধুকে সব সময় পীড়া দিত এবং বিষয়টি নিয়ে তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত। বঙ্গবন্ধু তাঁর উপলব্ধি বর্ণনা করেছেন এই ভাবে, ‘যদি কেহ অন্যায় করে থাকে, বিচার করো তাড়াতাড়ি। এই জেলে অনেক লোক আছে যারা দুই তিন বৎসর হাজতে পড়ে আছে সামান্য কোন অপরাধের জন্য। যদি বিচার হয় তবে ৬ মাসের বেশি সেই ধারায় জেল হতে পারে না। বিচারের নামে একি অবিচার। আমার মনের অবস্থা আপনারা যারা বাইরে আছেন বুঝতে পারবেন না। কারাগারে এই ইটের ঘরে গেলে বুঝতে পারতেন।’ (রোজনামচা, পৃষ্ঠা-১৩৬) বিচারের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন, ‘একটা কোর্টে বিচার গেলে একটা যদি সিভিল মামলা হয়; আপনি তো উকিল, স্পীকার সাহেব। আল্লাহর মর্জি যদি একটা মামলা সিভিল কোর্টে হয়, ২০ বছরেও সে মামলা শেষ হয় বলতে পারেন আমার কাছে? বাপ মরে যাবার সময় বাপ দিয়ে যায় ছেলের কাছে। আর উকিল দিয়ে যায় তার জামাইর কাছে সেই মামলা। আর ক্রিমিনাল কেস হলে এই লোয়ার কোর্ট, জর্জ কোর্ট- বিচার নাই। জাসটিস ডিলেড জাসটিস ডিনাইড- উ হ্যাভ টু মেইক এ কমপ্লিট চেইঞ্জ এবং সিস্টেমের মধ্যে পরিবর্তন করতে হবে। মানুষ যাতে সহজে বিচার পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বিচার পায়। ব্যাপক পরিবর্তন দরকার।’ বঙ্গবন্ধু একই দিন সংসদের অপর অধিবেশনে বলেছিলেন, ‘নতুন স্বাধীন দেশ। স্বাধীন মতবাদ, স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করতে হবে। সেখানে জুডিসিয়াল সিস্টেমের অনেক পরিবর্তন দরকার।’ ২৬ মার্চ ১৯৭৫ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু উপরোক্ত বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বিচার বিভাগকে নতুন করে গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে ঘোষণা দিয়েছিলেন- ইংরেজ আমলের বিচার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে মানুষ যাতে এক বছর, দেড় বছরের মধ্যে বিচার পায়, তার বন্দোবস্ত করার। একক জাতীয় দল ‘বাকশাল’ করার পর ২১ জুলাই ১৯৭৫ নবনিযুক্ত জেলা গবর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আর, বিচার ব্যবস্থা তাড়াতাড়ি বদলে ফেলা দরকার। বিচারের নামে অবিচার আর চলে না। এবার নতুন একটা কাঠামো করুন। সোজাসুজি বিচার হয়ে যাক।.......। দেখুন গিয়ে লোকে জেলের মধ্যে ফিফটি ফোর-এর আসামি হয়ে ছয় মাস, এক বছর পড়ে থাকে, কিন্তু তার পনেরো দিন জেল হয়। জীবনভর আমি জেল খেটেছি, কয়েদিদের সঙ্গে জীবন কাটিয়েছি। আমি জানি তাদের কি দুঃখ, কি কষ্ট। বিচার হোক, জেল খাটুক। কিন্তু বিচার হয় না, হাজতে থাকে। ফিফটি ফোর-এর এক বছর দু-বছর হাজত খেটে এক মাস জেল হয়। আর, এই যে এক বছর এগারো মাস গেল, তার ক্ষতিপূরণটা কে দেয়? আবার অনেক সময় খালাস হয়ে যায়।’ ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন- ‘শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। শাসনতন্ত্রে প্রশাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ পৃথকীকরনের নিশ্চয়তা থাকবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বজায় রাখার মতো চরিত্রবান, জ্ঞানবান এবং ন্যায়বান ব্যক্তিরাই যাতে বিচার বিভাগের সদস্য হতে পারেন শাসনতন্ত্রে সেইরূপ বিধান রাখা হবে।’ বঙ্গবন্ধু ঘোষণাপত্রে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ ও এর স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিচারকগণের যোগ্যতার বিষয়টিও উল্লেখ করেছিলেন। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭২-এ গৃহীত নতুন সংবিধানের অধীনে সুপ্রীমকোর্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল, ‘আদালতের অধিকারের হস্তক্ষেপ করা হবে না’ এবং ‘দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবেই’। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৩)-এ মৌলিক অধিকার হিসেবে ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারের অধিকার নিশ্চিতের বিধান করা হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২২-এ রাষ্ট্রকে রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সংবিধানে অনুচ্ছেদ ১১৬ক সংযোজন করে বিচার-কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণকে বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কারাগার, আইন-আদালত ও বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অভিজ্ঞতা, মূল্যায়ন, ভাবনা ও প্রত্যয়সমূহ বর্তমান সময় হতে ৬০/৭০ বছর আগের। কিন্তু তাঁর ঐসব মূল্যবান অভিজ্ঞতা, মূল্যায়ন, দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যয়সমূহকে যদি বর্তমান সময়ের আইন-আদালত-বিচার ব্যবস্থা সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়, তবে বলতে দ্বিধা হওয়ার কথা নয় যে, বঙ্গবন্ধু যেন বর্তমান সময়ের বাস্তবতাকেই লিখে গেছেন। আরো বলতে দ্বিধা নেই যে, আইন শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার প্রার্থীর ন্যায়বিচার-স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সঙ্গে নিশ্চিত করার জন্য ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অঙ্গীকার’ পূরণে এখনও অনেক করণীয় রয়েছে, যার দায়ভার মূলত রাষ্ট্রের নির্বাহী ও বিচার বিভাগের। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে সংশ্লিষ্ট সকলকে বিষয়টি গভীর আন্তরিকতা ও অঙ্গীকার নিয়ে ভাবতে হবে। প্রণয়ন করতে হবে যথাযথ কর্ম-কৌশলÑ জনকের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাঁর রক্ত ঋণ পরিশোধের জন্য। (সমাপ্ত) লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগ এবং সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১, বাংলাদেশ
×