ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তিমির মজুমদার

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আদিবাসী হতে চাওয়ার প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যত ভাবনা

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ১১ আগস্ট ২০২০

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আদিবাসী হতে চাওয়ার প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যত ভাবনা

(গতকালের পর) ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আদিবাসী আখ্যায়িত করলে অসুবিধা কি? অনেককেই এটি বলতে শোনা যায় যে, আদিবাসী বললে যদি ওরা খুশী হয় বা খুশী থাকে তাহলে সমস্যা কি? বিভিন্ন লেখা এবং দুই একটি সরকারী প্রজ্ঞাপনে এমনকি কোর্টের রায়ে পর্যন্ত অবচেতনভাবে তাদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এ থেকে কোন সমস্যা হবে না বলে মনে হতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে ‘ইস্ট তিমুর’ কিংবা ‘সাউথ সুদান’ এর মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে, তার দায়ভার নিতে কি আমাদের সেই সব বুদ্ধিজীবী এবং মিডিয়া আদৌ প্রস্তুত আছেন? সকলের জ্ঞাতার্থে এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ‘ইস্ট তিমুর’ এবং ‘সাউথ সুদান’ এর মতো একই পরিস্থিতি কাশ্মীর, চেচনিয়া, ফিলিপিন্সের মিন্দানাও এবং পৃথিবীর আরও কিছু স্থানে বিরাজ করলেও সেখানে গণভোট অনুষ্ঠিত করে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি এবং হবার কোন সম্ভাবনাও নেই। তাছাড়া স্বাধীনতার পরপরই পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর একটি অংশ স্বাধীন ‘জম্মুল্যান্ড’ স্থাপন করার জন্য এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে পড়ে। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর একান্ত চেষ্টায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তারিখে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হলেও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর একাংশ এখনও জেএসএস, ইউপিডিএফ এবং জেএসএস (সংস্কার) এর নামে তাদের সশস্ত্র কার্যক্রম চালু রেখেছে। কাজেই ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি আদায় করতে পারলে জাতিসংঘ ঘোষণা অনুযায়ী তারা ‘জম্মুল্যান্ড’ দাবি করবে, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। কেননা, ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র- ২০০৭’ অনুযায়ী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করলে সেই অনুযায়ী তাদের স্বায়ত্তশাসন, রাজনৈতিক, আইনী, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা প্রদান করার বাধ্যবাধকতা থাকবে। বিশেষ করে এই ঘোষণার ধারা ৩০ অনুযায়ী ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি কিংবা ভূখণ্ডে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না উপযুক্ত জনস্বার্থের প্রয়োজনে যুক্তিগ্রাহ্য হবে, অন্যথায় যদি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় সম্মতিজ্ঞাপন বা অনুরোধ না করে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তার সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিশেষ কোন জনগোষ্ঠীর ভূমি বা ভূখণ্ড ব্যবহারের আগে যথাযথ পদ্ধতি ও বিশেষ করে তাদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিশেষ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে অনুমতি গ্রহণ করার বিষয়টি সেই রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আর যদি তারা ‘স্বেচ্ছায় সম্মতি জ্ঞাপন’ না করে তাহলে কি হবে? যদি কোন বিশেষ গোষ্ঠী বহির্বিশ্বের কারও সঙ্গে কোন অশুভ আঁতাত করে? যদি বহির্বিশ্ব থেকে ওই অঞ্চল আক্রান্ত হয় তবে সরকার কি সামরিক কার্যক্রম গ্রহণে ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠী কারও সম্মতির অপেক্ষায় নিষ্ক্রিয় থাকবে? যদি ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর নেতৃত্ব সম্মতি না দেয় তাহলে কি হবে? বিশেষ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ অথবা এর কোন অঙ্গ সংগঠনের মত অনুযায়ী যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত না হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করতে পারে। এছাড়াও বাংলাদেশে কমবেশি ৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব ‘মালিকানাধীন’ ভূমি আছে এবং তারা যদি সেই ভূমি বা ভূখ- ব্যবহারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ওপর এত বিধিনিষেধ আরোপ করে, তাহলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের কী হবে? এই সকল প্রশ্নের গুরুত্ব অনুধাবন করত সকলকে এই বিষয়টিতে সতর্ক হতে হবে এবং ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’দের ‘আদিবাসী’ বলা বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও প্রচুর চাকমা, ত্রিপুরা ও অন্যান্য ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী রয়েছে। তারা সেখানে উপজাতি বা ঝপযবফঁষব ঈধংঃ হিসেবে পরিচিতি এবং সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। সেখানকার কোন মিডিয়া কিংবা বুদ্ধিজীবী তো তাদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার আন্দোলন করছে না। উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা আমাদের মোট ভূখ-ের দশ ভাগের একভাগ (১৩,২৯৫ বর্গ কিঃ মিঃ/৫,১৩৩ বর্গমাইল) এবং এখানে মোট জনসংখ্যার মাত্র শতকরা এক ভাগ (২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী ১৫,৯৮,২৯১ জন) মানুষ বাস করে। এ এলাকায় জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করে বিচ্ছিন্নতাবাদকে যারা অবচেতনে উস্কে দিচ্ছেন, তারা কি জানেন যে, এখানে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার অর্ধেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং বাকি অর্ধেক বাঙালী। মাত্র দশ বছর আগে থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের দাবিকৃত আদিবাসী হবার প্রবল ইচ্ছা আসলে জাতিসংঘের ২০০৭ সালের ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রে’র বিভিন্ন ধারা থেকে ভবিষ্যতে ফায়দা লোটার অপকৌশল। এই কৌশলের ফাঁদে পা দেয়া ভয়ঙ্কর এবং বিপজ্জনক। কারণ, তাদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ তার এক দশমাংশ ভূমির মালিকানা হারাতে পারে, যার সঙ্গে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির ভৌগোলিক অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িত। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই ভূখণ্ডের একদশমাংশ ছেড়ে দিতে কি আমরা প্রস্তুত? যার উত্তর অবশ্যই ‘না’। কাজেই সকলকে সতর্ক হতে হবে এবং এদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ‘আদিবাসী’ বলা বন্ধ করতে হবে। আশা করা যাচ্ছে যে, এই রচনা পাঠ করার পর যে কেউ সজ্ঞানে বা অবচেতনে বাংলাদেশে বসবাসরত ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’দের ‘আদিবাসী’ সম্বোধন করা থেকে বিরত থাকবেন। (সমাপ্ত) লেখক : শিক্ষাবিদ ও উন্নয়নকর্মী
×