ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তিমির মজুমদার

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আদিবাসী হতে চাওয়ার প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যত ভাবনা

প্রকাশিত: ২২:৪৪, ১০ আগস্ট ২০২০

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আদিবাসী হতে চাওয়ার প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যত ভাবনা

(গতকালের পর) এখন পর্যবেক্ষণ করা যাক বাংলাদেশের জন্য ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬১তম অধিবেশনের ÔUnited Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples’ বা ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র’টি কতটা প্রযোজ্য। ঘোষণাপত্রটির উদ্দেশ্য মহৎ হলেও এটি অনেক ক্ষেত্রে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা বা সার্বভৌমত্বের দৃষ্টিকোন থেকে এর গ্রহণযোগ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ। এই ঘোষণাপত্রের নিম্নোক্ত ধারাগুলো বিশেষভাবে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন : Article 3 Indigenous peoples have the right to self-determination. By virtue of that right they freely determine their political status and freely pursue their economic, social and cultural development. অর্থাৎ, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার বলে তারা তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা নির্ধারণ করতে এবং অবাধে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রাখতে পারবে। Article 4 Indigenous peoples, in exercising their right to self-determination, have the right to autonomy or self-government in matters relating to their internal and local affairs, as well as, ways and means for financing their autonomous functions. অর্থাৎ, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার চর্চার বেলায় তাদের অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন বা স্ব শাসিত সরকারের অধিকার থাকবে এবং তাদের স্বশাসনের কার্যাবলীর জন্য অর্থায়নের পন্থা ও উৎসের ক্ষেত্রেও অনুরূপ অধিকার থাকবে। Article 5 Indigenous peoples have the right to maintain and strengthen their distinct political, legal, economic, social and cultural institutions, while retaining their right to participate fully, if they so choose, in the political, economic, social and cultural life of the State. অর্থাৎ, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী যদি পছন্দ করে তাহলে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের পূর্ণ অধিকার রেখে নিজস্ব জাতিগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, আইনী, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান অক্ষুণ্ন রাখা ও শক্তিশালীকরণের অধিকার থাকবে। Article 10 Indigenous peoples not be forcibly removed from their lands or territories. অর্থাৎ, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে তাদের ভূমি বা ভূখণ্ড থেকে জোর করে অন্য কোথাও সরানো যাবে না। Article 30 Military activities shall not take place in the lands or territories of indigenous peoples, unless justified by relevant public interest or otherwise freely agreed with or requested by the indigenous peoples concerned. অর্থাৎ, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি কিংবা ভূখণ্ডে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত উপযুক্ত জনস্বার্থের প্রয়োজনে যুক্তিগ্রাহ্য হবে অথবা যদি সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় সম্মতিজ্ঞাপন বা অনুরোধ করে। জাতিসংঘ সনদগুলোর বর্তমান অবস্থা কি? Indigenous and Tribal Populations Convention-1957 (No. 107) ১৯৫৭ সালে পাস হলেও এ পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ২৭টি দেশ এই কনভেনশনটি র‌্যাটিফাই করেছে। ১৯৭২ সালের ২২ জুন বাংলাদেশও কনভেনশন- ১০৭ র‌্যাটিফাই করেছিল। পরবর্তীতে কনভেনশন-১৬৯ পাস হবার পর কনভেনশন ১০৭ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তামাদি হয়ে গেছে এবং বাংলাদেশ অদ্যাবধি কনভেনশন-১৬৯ র‌্যাটিফাই করেনি। তাই এটি বাংলাদেশের জন্য অবশ্য পালনীয় নয়। এখানে লক্ষণীয় যে, ইতোমধ্যে ৮টি দেশ এই কনভেনশনকে নিন্দা করে তা থেকে বেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে Indigenous and Tribal Populations Convention-1989 (No.169), , ১৯৮৯ সালে পাস হলেও এখন পর্যন্ত বিশ্বের মাত্র ২২টি দেশ এই কনভেনশনটি র‌্যা টিফাই করেছে। এই উপমহাদেশের একমাত্র নেপাল ছাড়া আর কোন দেশ এই কনভেনশনটি র‌্যাটিফাই করেনি। অন্যদিকে, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে জাতিসংঘের ৬১তম অধিবেশনে আদিবাসী বিষয়ক যে ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে ভোটদানের সময় ১৪৩টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে, ৪টি দেশ বিপক্ষে, ১১টি দেশ বিরত এবং ৩৪টি দেশ অনুপস্থিত থাকে। বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকে। বিরুদ্ধে ভোট দেয়া দেশগুলো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র। অথচ এই দেশগুলোতে আদিবাসীরাই ছিল এক সময়ে মূল জনগোষ্ঠী এবং জাতিগতভাবে যাদের সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। বিস্ময়কর অথবা পরিহাসের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের আদিবাসীদের রক্ষায় খুব সোচ্চার ও পৃষ্ঠপোষক দেশগুলোর বেশিরভাগই কিন্তু নিজ দেশের জন্য আইএলও কনভেনশন- ১০৭ বা ১৬৯ ও জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রের স্বাক্ষরকারী নয়, পক্ষে ভোট দেয়নি এবং র‌্যাটিফাইও করেনি। কাজেই তাদের কুমিরের অশ্রু বর্ষণের কারণ ও মতলব বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হবার প্রয়োজন নেই। এসব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর উপজাতি, আদিবাসী কিংবা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য এই মায়াকান্নার পেছনে মূলত ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি অধিপত্যবাদী স্বার্থই প্রকাশ্যে কিংবা অবচেতনে প্রবলভাবে কাজ করেছে, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাহলে বাংলাদেশে সত্যিকার আদিবাসী কারা? নিঃসন্দেহে বাঙালী ও বাংলা ভাষাভাষীরা এদেশের সত্যিকারের আদিবাসী। কারণ এরাই প্রোটো-অষ্ট্রেলিয়েড (Proto Astroloid) নামের আদি জনধারার অংশ এবং তারাই একমাত্র আদিবাসী বা Son of the Soil বলে দাবি করতে পারে। এর পেছনে জাতিতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রমাণও রয়েছে। বাংলাদেশের এই অঞ্চলে বাঙালীরা বসবাস করে আসছে চার হাজার বছরেরও পূর্বে থেকে। বিক্রমপুর, ওয়ারি-বটেশ্বর, সোনারগাঁও কিংবা মহাস্থানগড় থেকে প্রাপ্ত নৃতাত্ত্বিক প্রমাণাদি এসব বিষয় নিশ্চিত করে। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান উপজাতি চাকমাদের আদি বাসস্থান ছিল আরাকানে, ত্রিপুরাদের আদি বসবাস ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে এবং মার্মা জনগোষ্ঠী এসেছে বার্মা থেকে। সেই অর্থে তারা কেউই বাংলাদেশের আদিবাসী নয়, বরং তারা এদেশে অভিবাসী। তারা বিভিন্ন স্থান থেকে দেশান্তরী হয়ে এদেশের নানাস্থানে অভিবাসিত হয়ে আনুমানিক তিনশ থেকে পাঁচশ’ বছর পূর্ব থেকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাস করতে শুরু করেছে। তাই কোনক্রমেই বাংলাদেশে বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, অন্যান্য ক্ষুদ নৃ-গোষ্ঠী এদেশের আদিবাসী হতে পারে না। যারা তাদের আদিবাসী বলে আখ্যায়িত করছেন তারা শুধু সংবিধান লঙ্ঘন করছেন তা নয়, বরং তারা জেনে শুনে মিথ্যাচার করেছেন। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো যে আদিবাসী নয়, তার প্রমাণ কি? বাংলাদেশের উপজাতীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো যে এদেশের আদিবাসী বা ভূমিপুত্র নয়, তার প্রমাণ প্রখ্যাত উপজাতি গবেষক ও নৃতত্ত্ববিদRobert Henry Sneyd Hutchinson তার বই ‘An Account of Chittagong Hill Tracts’ (1906), Captain Thomas Herbart Lewin তার বই ‘The Chittagong Hill Tracts and Dwellers There in’ (1869), অমেরেন্দ্র লাল খিসা (১৯৯৬) প্রমুখের লেখা, গবেষণাপত্র, থিসিস এবং রিপোর্ট বিশ্লেষণে পাওয়া যায়। তারা সবাই একবাক্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজাতীয়দের নিকট অতীতের কয়েক দশক থেকে নিয়ে মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে এদেশে স্থানান্তরিত বা অভিবাসিত হবার যুক্তি প্রমাণ ও ইতিহাস তুলে ধরেছেন। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ এবং ব্রিটিশ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম জেলা প্রশাসক Captain Thomas Herbart Lewin এর মতে, A greater portion of the hill tribes, at present living in the Chittagong Hills, undoubtedly came about two generations ago from Arracan. This is asserted both by their own traditions and by records in the Chittagong Collectorate (Lewin 1869, 28). অর্থাৎ, মাত্র দুই পুরুষ আগে ব্রিটিশদের সঙ্গে বার্মা যুদ্ধের সময় চাকমারা পার্বত্য অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে, যা চট্টগ্রাম কালেক্টরেট অফিসে রক্ষিত দলিল দস্তাবেজ থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। মারমা বা মগ জনগোষ্ঠীর সদস্যরা ১৭৮৪ সনে এ অঞ্চলে বার্মা থেকে দলে দলে অনুপ্রবেশ করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস শুরু করে (Shelly, 1992 Ges Lewin, 1869)। বিশিষ্ট ব্রিটিশ চাকমা পণ্ডিত অমেরেন্দ্র লাল খিসা ‘অরিজিনস অব চাকমা পিপলস অব হিলট্রেক্ট চিটাগং’এ লিখেছেন, ‘তারা (চাকমারা) এসেছেন মংখেমারের আখড়া থেকে’। পরবর্তীতে আরাকান এবং মগ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে বান্দরবানে অনুপ্রবেশ করেন। আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ বছর পূর্বে তারা উত্তর দিকে রাঙ্গামাটি এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন’। এ বিষয়ে বিশিষ্ট গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুর রব, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ড. খুরশীদা বেগম, বিজয় কী বোর্ডের উদ্ভাবক মোস্তফা জব্বার, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কাজ করেছেন এমন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও গবেষক মেহেদী হাসান পলাশ প্রমুখ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন যে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নয়। এছাড়া মার্মা সার্কেল চীফ অংশু পরু চৌধুরী প্রদত্ত বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য ও সাক্ষাতকার এবং ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের উপজাতি হিসেবে পরিচিতি প্রদান করা হয়েছে ‘আদিবাসী’ হিসেবে নয় (বিস্তারিতঃhttps://www.youtube.com/watch?v=_IlixQ1SS6s)। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ ও উন্নয়নকর্মী
×