ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ওসি প্রদীপকে দেখানো দালিলিক প্রমাণই কাল হয় সিনহার

প্রকাশিত: ২২:০৪, ১০ আগস্ট ২০২০

ওসি প্রদীপকে দেখানো দালিলিক প্রমাণই কাল হয় সিনহার

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ও কক্সবাজার ॥ দ্রুত পরিকল্পনার মাধ্যমে টেকনাফের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদকে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যার নেপথ্যে মূল ভূমিকায় ছিলেন টেকনাফ থেকে প্রত্যাহত ও পরবর্তীতে সাময়িক বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। এছাড়া আরও অভিযোগ উঠেছে, এ ঘটনার সঙ্গে জেলা পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তা এবং টেকনাফে অবস্থানরত বাংলা চলচ্চিত্রের ফাইটিং মাস্টারখ্যাত ইলিয়াস কোবরারও নেপথ্য সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। যদিও ইলিয়াস কোবরা রবিবার গণমাধ্যমকে বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার এবং প্রত্যাখ্যান করেছেন। এদিকে ৩১ জুলাই হত্যাকাণ্ডের পর নীলিমা রিসোর্ট থেকে গ্রেফতার সিনহার সহযোগী শিপ্রা দেবনাথকে রবিবার কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে জামিন দেয়া হয়েছে। অপর গ্রেফতারকৃত সহযোগী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের জামিন শুনানি হয়েছে অপর একটি আদালতে। উক্ত আদালত আজ সোমবার আদেশে দেবেন বলে জানিয়েছেন। অপরদিকে সিনহা হত্যার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তদন্ত সংস্থা র‌্যাবের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া কারাগার থেকে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, কিলার এসআই লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দলাল রক্ষিতকে রবিবার র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে নেয়নি। সোমবার র‌্যাব হেফাজতে তাদের নেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে জেলগেটে দ্বিতীয় দিনের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে গ্রেফতার হওয়া অপর চারজনকে। বিভিন্ন সংস্থা ও গণমাধ্যম কর্মীদের অনুসন্ধানে রবিবার পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, টেকনাফ নিয়ে ডকুমেন্টরি করতে গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা ও তার দলের হাতে ধরা পড়ে সেই অঞ্চলে মাানব ও মাদক পাচারের ভয়াবহ চিত্র। যেখানে আরও উঠে আসে পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থার সরাসরি সংশ্লিষ্টতা। এসব চিত্র ধারণের পর মেজর সিনহা সর্বশেষ সাক্ষাতকার নেন ৩১ জুলাই দিনে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ দাশের। মেজর সিনহা তার সঙ্গে কথা বলার সময় ইয়াবাসহ মাদক পাচারের কিছু সচিত্র প্রমাণ ও ভিডিও ফুটেজ দেখিয়েছিলেন, যা দেখে ওসি ভড়কে যান। এসব ঘটনার সঙ্গে তার সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ উঠে আসে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ওসির সঙ্গে সাক্ষাতকার গ্রহণের সময় এসব দালিলিক প্রমাণ ওসি প্রদীপ কুমার দাশ অস্বীকার করতে পারেননি। ৩১ জুলাই বিকেল ৪টা নাগাদ মেজর সিনহা তার সঙ্গী সিফাতকে নিয়ে ওসি কক্ষ ত্যাগ করেন। নিজ গাড়িতে উঠে তিনি চলে আসেন বাহারছড়ার সন্নিহিত মারিসবুনিয়ায়। এ ঘটনার পর ওসি প্রদীপ অনেকটা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। যোগাযোগ করেন তার সহযোগী অনেকের সঙ্গে, যার মধ্যে রয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রের ফাইটিং মাস্টারখ্যাত ইলিয়াস কোবরা। এই ইলিয়াস কোবরা এলাকায় মাদক প্রতিরোধ কমিটির সভাপতির পদেও আসীন রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ইয়াবা চালান, পুলিশের এনকাউন্টারসহ বিভিন্ন অপকর্মের পুলিশের একজন শীর্ষস্থানীয় দালাল হিসেবে কাজ করে আসছেন। যদিও এই ইলিয়াস কোবরা রবিবার বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছেন। উল্টো বলেছেন, মেজর সিনহা নামে কাউকে চেনেন না, এমনকি নামও শোনেননি। সিনহার ডকুমেন্টরিতে টেকনাফে পুলিশ, জনপ্রতিনিধিসহ অনেকের কুকর্মের চিত্র ধারণ হওয়ার পর উৎফুল্ল ছিলেন মেজর সিনহা। কারণ এটি তার ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ পেলে তিনি সুনামের অধিকারী হবেন। ৩১ জুলাই থানা থেকে বের হয়ে আসার পর তিনি ইলিয়াস কোবরার পরিকল্পিত ফাঁদে আটকা পড়েন। অর্থাৎ তাকে মারিসবুনিয়ার পাহাড়ে ইলিয়াস কোবরার বাগানবাড়ি পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘুরেফিরে সেখানে সময় কাটানোর জন্য উৎসাহিত করেন আর ভেতরে ভেতরে সিনহা যে সেখানে আছেন সে তথ্য ওসি ও তার বাহিনীকে নিশ্চিত করতে থাকেন। এ ঘটনার পর ওসি প্রদীপ মারিসবুনিয়ার সেই পাহাড় থেকে নেমে যাওয়ার যেসব পথ রয়েছে সবদিকে তার বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করেন। শুধু তাই নয়, এলাকার কয়েকজনকে দায়িত্ব দেন এই বলে যে, ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করে এ সেনা কর্মকর্তাকে আটকে যেন গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। কিন্তু এক সময়ের চৌকস এই সেনা কর্মকর্তা পরিস্থিতি কিছু আঁচ করতে পেরে তার সহযোগী সিফাতকে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে চলে আসেন মূল সড়কে। সেখানে রেখে যাওয়া তার প্রাইভেটকারে উঠে তার রিসোর্ট অভিমুখী হন। প্রথমে তিনি একটি বিজিবি চেকপোস্টের মুখোমুখি হন। সেখানে পরিচিতি নিশ্চিত করার পর পার পেয়ে এগিয়ে যান বাহারছড়া পুলিশ চেকপোস্টে। সেখানে পুলিশ সদস্যরা তার গাড়ি আটকায়। গাড়ি তল্লাশি ও নেমে আসার কথা শোনার পর মেজর সিনহা কিছুটা ক্ষুব্ধ হন। এরপর আসেন কিলার এসআই লিয়াকত আলী। তিনি হাত ওপরে তুলে সিনহাকে নেমে আসতে বললে সিনহা গাড়ির দরজা খুলে দুপা মাটিতে নামিয়ে হাত উপরে তোলার পর্যায়ে একটি গুলি করেন। এরপর পর পর আরও কয়েকটি গুলি করেন। পরে অনুমান ১০ মিনিটের মধ্যে ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে হাজির হন এবং অর্ধমৃত সিনহার শরীরে কয়েকটি লাথি মারেন। এসব বিবরণ প্রদর্শক্ষদর্শীদের। এরপর একটি ‘ছারপোকা’ নামের একটি গাড়িতে তুলে সদর হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ইলিয়াস কোবরার বিরুদ্ধে পুলিশের শীর্ষস্থানীয় দালাল; মানব ও মাদক পাচারকারিদের মধ্যে মিডিয়া হিসাবে কাজ করে এই ইলিয়াস কোবরা কাড়ি কাড়ি অর্থ অর্জন করেছেন বলে এলাকায় চাউর হয়ে আছে। রবিবার তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের বলেছেন, তার এলাকায় ইয়াবার কোন ব্যবসায়ী নেই। ভাল একটি বাড়িও নেই। কিলার এসআই লিয়াকতের সঙ্গে তার পরিচয় আছে বলে স্বীকার করেন। মেজর সিনহার মৃত্যুর দিনও লিয়াকতের সঙ্গে কথা হয়েছে বলে জানান। তিনি জানিয়েছেন, তাদের এলাকায় একটি বস্তা পাওয়া গেছে। যেটি খবর দেয়ার পর এসআই লিয়াকত নিয়ে গেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, ইলিয়াস কোবরার বাড়ি টেকনাফের বাহারছড়া শাপলাপুরে। মেজর সিনহা যেখানে রাতের দৃশ্য ভিডিও করতেন সেই মারিসবুনিয়া এলাকায় ইলিয়াস কোবরার একটি বাগাড় বাড়ি রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। প্রদীপের সম্পদের অনসুন্ধানে দুদক ॥ টেকনাফ থানা থেকে বরখাস্ত ও পরবর্তীতে মেজর সিনহা হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি দাশের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে দুদক। দুদক সূত্রে রবিবার জানানো হয়েছে, এ পর্যন্ত তারা প্রদীপের নামে বেনামে যেসব সম্পত্তির খোঁজ পেয়েছেন তন্মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের লালখান বাজারে একটি ফ্ল্যাট, কোতোয়ালি থানায় একটি ভবন, কক্সবাজারে দুটি হোটেলের মালিকানা, বোয়ালখালীতে স্ত্রী চুমকির নামে বিপুল অঙ্কের সম্পদ, মুরাদপুরে মোটা অঙ্কের জমিসহ আরও নানা সম্পদ। ব্যাংকে রয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ। ভারত এবং অস্ট্রেলিয়াতেও তার বাড়ি রয়েছে বলে প্রচার আছে। অপরদিকে ওসি প্রদীপের আয়কর নথিতে শুধু বেতন ভাতা, শান্তিরক্ষা মিশন থেকে পাওয়া ভাতা ও জিপিএফ থেকে সুদপ্রাপ্ত টাকার বর্ণনা ব্যতীত এসব সম্পদের কোন বিবরণ নেই।
×