ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে

প্রকাশিত: ২২:০০, ১০ আগস্ট ২০২০

দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ প্রায় এক বছর পর আবারও জোরালোভাবে আলোচনায় এসেছে কিশোর গ্যাং কালচারের বিষয়টি। টানা এক বছর আদালতের হস্তক্ষেপ আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে থেমে ছিল কিশোর গ্যাং কালচারের কর্মকাণ্ড। সম্প্রতি উত্তরায় এক প্রকৌশলীকে মারধরের ঘটনায় টিকটক অপু গ্রেফতারের পর আবারও আলোচনায় এসেছে কিশোর গ্যাং। একের পর এক অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, মাদক কারবার, হুমকি-ধমকি, গুলিসহ নানা অপরাধের পাশাপাশি খুনের মতো মারাত্মক অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে গ্যাং সদস্যরা। অপরাধ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, মাদকের প্রভাব, শিক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটি ও পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় না থাকাসহ নানা কারণে দেশে কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে উঠছে। ভবিষ্যতে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিশোর গ্যাং কালচারের রাশ টেনে ধরতে না পারলে সমাজে ধর্ষণ, খুন, ছিনতাই ও মাদকের বিস্তারসহ নানা ধরনের অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যেতে পারে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যও বড় ধরনের হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। গত ২ আগস্ট রবিবার সন্ধ্যায় উত্তরার সড়ক দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন প্রকৌশলী মেহেদি হাসান রবিন। ওই সময় সড়ক অবরোধ করে টিকটক অপু ও তার সহযোগীরা টিকটকের জন্য ভিডিও তৈরি করছিল। প্রকৌশলী রাস্তা ছেড়ে দিতে হর্ন বাজাচ্ছিলেন। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে টিকটক অপু ও তার সহযোগীরা প্রকৌশলীকে বেধড়ক মারধর করে। এ বিষয়ে প্রকৌশলী মামলা দায়ের করেন। পরদিন গত ৩ আগস্ট টিকটক অপুকে গ্রেফতার করে উত্তরা পূর্ব থানা পুলিশ। পরে নাজমুল নামে আরও একজনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ বলছে, মামলায় এজাহারনামীয় আসামিদের প্রায় সবাই বয়সে কিশোর। টিকটকার ইয়াসিন আরাফাত অপু ওরফে ‘টিকটক অপু’ ওরফে ‘অপু ভাই’ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। তারা তাদের গ্যাংকে আরও বড় করার চেষ্টা করছিল। অপুর বাড়ি নোয়াখালী। মাদ্রাসার ছাত্র ছিল। অভাবের কারণে ঢাকায় একটি সেলুনে কাজ করত। সেলুনের বন্ধুরা তাকে ভিডিও শেয়ারিং এ্যাপ টিকটক ও লাইকির কথা জানালে সে ভিডিও তৈরি করতে শুরু করে। তার ভিডিওগুলো নির্দিষ্ট কোন গল্প বা বিষয় নিয়ে তৈরি করত না। এমনিতে বিভিন্ন ইস্যুতে নিজের মতামত দিত সে। এছাড়া তার সমালোচকদের ভিডিওর মাধ্যমে জবাব দিত। সে রাস্তায়, অন্যের বাসার ছাদে, খেতে, বাসের ভেতরেও টিকটক বানাত। তার টিকটকে দেড় লাখ ও লাইকিতে ১০ লাখ ফলোয়ার হয়। এজন্য সে গত দুই মাসে শুধু ভিডিও তৈরি করে ৫০ হাজার টাকার মতো আয় করে। এরপর সে পেশাদার টিকটকার হিসেবে ঢাকার যে কোন রাস্তায় টিকটক তৈরির জন্য ভিডিও করা শুরু করে। তার সঙ্গে থাকতো কিশোর বয়সের একটি দল। অনেক কিশোর ছেলে তার সঙ্গে থাকায় সে নিজেকে কিশোর গ্যাংয়ের লিডার ভাবত। তার সহযোগীদের অধিকাংশই ভবঘুরে, ঢাকার বিভিন্ন বস্তি, হোটেলে বেয়ারা, মোটরসাইকেল মেরামতের দোকানে কাজ করত। যাদের সবাই কিশোর। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উত্তরা পূর্ব থানার এসআই আজিজুর তালুকদার জানান, অপু তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ স্বীকার করেছে। তদন্তে অপুর কিশোর গ্যাং প্রতিষ্ঠার বিষয়টি উঠে এসেছে। ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) নাবিদ কামাল শৈবালও জানান, অপু ও তার সঙ্গীরা কিশোর গ্যাং তৈরি করে নিজেদের আত্মপ্রকাশের জোর চেষ্টা করছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। শেষ পর্যন্ত অপু ও মামুনের আইডি বাতিল করেছে লাইকি কর্তৃপক্ষ। এ ধরনের অশালীন ভিডিও তৈরি ও প্রচারের বিরুদ্ধে তথ্য মন্ত্রণালয় সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করেছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য মোতাবেক, ২০১৫ সালে মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে এক মহিলাকে মোটরসাইকেল দিয়ে পিষে হত্যা এবং ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি ঢাকার উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের কাছে সন্ধ্যায় ট্রাস্ট স্কুল এ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র আদনান কবিরকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। দুইটি ঘটনায় আট জন করে ১৬ জন গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে ঢাকার বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় কিশোর গ্যাং থাকার সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। পুলিশের নথিপত্র মোতাবেক, ঢাকার প্রায় প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং আছে। তবে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে ওঠেছে উত্তরায়। নাইন স্টার ও ডিসকো বয়েজ নামের দুইটি কিশোর গ্যাং খুবই সক্রিয় উত্তরায়। এ দুইটি গ্যাংয়ের সদস্যদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনায় আদনান নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনটি মারামারি এবং একটি ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ নাইন স্টার নামের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে খুন হয় আদনান। র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জানান, আদনান কবির হত্যায় জড়িত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে উত্তরাসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় থাকা কিশোর গ্যাং সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যায়। পরবর্তীতে র‌্যাবের অভিযানে শতাধিক কিশোর গ্যাং সদস্য গ্রেফতার হয়। তাদের অনেককেই সাজা দেয় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিশোর গ্যাং সম্পর্কে সজাগ থাকতে এবং তাদের গ্রেফতার করতে পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ সারাদেশের প্রতিটি পুলিশ ইউনিটকে কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনায় পুলিশ প্রধান কিশোর গ্যাং সদস্যদের গ্রেফতার ছাড়াও তাদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করার কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমানের ভাষ্য মোতাবেক, নানা কারণে কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠে। যার মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক কারণ ছাড়াও শিক্ষাগত কিছু কারণও আছে। বিশেষ করে পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় নিম্ন আয়ের পরিবারের কিশোররা নানা কারণে শিক্ষা থেকে অনেক সময় বঞ্চিত হয়। আবার স্কুল থেকেই ঝরে পড়ে। অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে এসব কিশোরদের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হয়। প্রথম প্রথম এসব কিশোররা হতাশা ভুলে থাকতে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মাদক সেবনের কারণে তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপন ব্যাহত হয়। পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রায়ই গালমন্দ করেন। একদিকে লেখাপড়া বা স্কুলে যাওয়ার কোন তাড়া থাকে না। তারপর পরিবারের সদস্যদের কাছে গালমন্দ খেতে খেতে তাদের মধ্যে হতাশা পুরোপুরি ভর করে। তারা মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে সবকিছু ভুলে থাকার চেষ্টা করতে থাকে। পরিবারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আস্তে আস্তে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আর মাদক সেবনকালে স্বাভাবিক কারণেই সমবয়সী কিশোরদের সঙ্গে এদের সম্পর্ক হয়। এরপর তারা নিজেরাই সংঘবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলছে গ্যাং। এরা মাদকের টাকা জোগাড় করতে ছিনতাই, মাদক বিক্রিসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে এক ধরনের হিরোইজম কাজ করে। তারা পাড়া মহল্লার বিভিন্ন জায়গায় বসে ইভটিজিং করে। পাড়া মহল্লায় নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে একসঙ্গে অনেক কিশোর বিকট শব্দে মোটরসাইকেলের বিকট হর্ন বাজিয়ে এলাকা দাপিয়ে বেড়ায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারই তাদের আশপাশে থাকা বা উচ্চবিত্ত আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে চায়। এসব পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মতো নামীদামী স্কুলে পড়াতে চায়। গাড়ি হাঁকিয়ে স্কুলে পাঠাতে চায়। কিছু দিন সেই ধারা ধরে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত তারা টিকতে পারে না। এ সময় তারা ছিটকে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সন্তানদের লেখাপড়াও অধিকাংশ সময় থমকে যায়। পড়াশোনায় ছন্দপতন ঘটায় ওইসব কিশোররাও আস্তে আস্তে পাড়ার বখাটে কিশোরদের সঙ্গে মিশতে থাকে। তারাও আস্তে আস্তে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। পরবর্তী সময়ে আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়ে কিশোর গ্যাংয়ে। আর উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। পরিবারের অঢেল টাকা থাকায় এবং বড় ব্যবসা বাণিজ্য থাকায় আগাগোড়াই তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ কম থাকে। যদিও ব্যতিক্রমও আছে। এসব পরিবারের কিশোররা সাধারণত ইংরেজী মাধ্যমে পড়াশোনা করে। ইংরেজী মাধ্যমে নিয়মিত ক্লাস করার রীতি না থাকায় তারা বাড়তি সময় পায়। সেই সময় তারা বন্ধু বা বান্ধবী বা সমবয়সীদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। তারা পার্টি করে বেড়ায়। পার্টির আড়ালে চলে মাদকের আসর। এক সময় তারা মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এসব পরিবারের অনেক সন্তানদের মধ্যেই ব্যবসা করতে উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন নেই বলে, এক ধরনের ধারণা কাজ করে। এই ধারণাই তাদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধা হিসেবে কাজ করে।
×