ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শোকের বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে আগস্ট

বুকের গভীরে প্রাচীন ক্ষত, চির বেদনা, জেগে উঠছে নতুন করে

প্রকাশিত: ২২:৫১, ৯ আগস্ট ২০২০

বুকের গভীরে প্রাচীন ক্ষত, চির বেদনা, জেগে উঠছে নতুন করে

মোরসালিন মিজান ॥ আগস্ট আর যদি ফিরে না আসত, যদি ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে মুছে ফেলা যেত মাসটিকে, বাঙালী বেদনাবোধ অনুশোচনা কিছুটা হয়তো কমতো। এত করে মনে পড়ত না। জোর করে ভুলে থাকার চেষ্টা করতেন অনেকে। কিন্তু হায়! সে সুযোগ নেই। যথানিয়মে আসে আগস্ট। বাঙালীকে কাঁদিয়ে যায়। ব্যথায় জর্জরিত করে যায়। এবারও সে এসেছে। এক সপ্তাহের বেশি হলো। কিন্তু করোনাকাল চলছে। কভিড-১৯-এর ঘায়ে গোটা বিশ্ব তছনছ হয়ে গেছে। বাংলাদেশও এ মহামারীর বাইরে নয়। প্রতিদিন সংক্রমিত হচ্ছে মানুষ। মারা যাচ্ছেন অনেকে। এ অবস্থায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ খুব জরুরী। তাই আগস্টের শোক প্রকাশের ছবিটা অতো সামনে আসছে না। তবে বাঙালীর বুকের গভীরে যে প্রাচীন ক্ষত, যে দগদগে ঘা নতুন করে জেগে উঠছে ঠিকই। প্রতিবারের মতো এবারও যারপর নাই ভারাক্রান্ত মন। পিতৃহত্যার গ্লানি আজও কুরে কুরে খাচ্ছে বাঙালীকে। চোখের জলে তাই প্রায়শ্চিত্য করার চেষ্টা। ফুলে গানে কথা কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাওয়ার আকুতি। সারা মাস ধরেই চলবে অর্ঘ্য নিবেদন। নানা আয়োজনে মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে জাতি। গভীর ভালবাসা প্রকাশ করবে। আজ থেকে বহু বছর আগের সেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বুকটাই যার বাংলাদেশ, সেই বুকে গুলি চালিয়েছিল একদল বিশ্বাসঘাতক। বর্বর পাকিস্তানীরা মুজিবকে ভয় দেখাতে পারেনি। আদর্শ থেকে একচুল বিচ্যুত করতে পারেনি। অথচ নিজ দেশের সেনাবাহিনীর কয়েকজন বিপথগামী অফিসার ছুটে এসেছিল হায়েনার মতো। ঘাতকের দল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে হামলা চালায়। বাড়ি ভর্তি মানুষ। নির্বিচারে গুলি ছোড়া হয় তাদের ওপর। এননকি নারীর এমনকি শিশুর শরীর নির্মম নিষ্ঠুরভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। তবে মূল টার্গেট একজনই ছিলেন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির জনকের দিকে বুলেট ছুড়তেও দ্বিধা করেনি ওরা। ব্রাশফায়ারে মহান নেতার মৃত্যু নিশ্চিত করার সব চেষ্টা করেছে। আর তারপর আজ ২০২০ সালের বাংলায় আমরা দেখছি, বাংলাদেশ বিরোধী অপশক্তির উদ্দেশ্য সফল হয়নি। কাপুরুষের দল মুজিবকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। বরং বুকে বিদ্ধ হওয়া প্রতিটি বুলেট নেতার দেশপ্রেমের সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে। যতদিন যাচ্ছে ততই উজ্জ্বল হচ্ছে এই নাম। সূর্যের মতো আলো ছড়াচ্ছে। সারা বছর নানাভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে বাঙালী। আগস্টে এসে আরও গাঢ় হয় আবেগ। চলে মাসব্যাপী আয়োজন। এবার করোনার কারণে দৃশ্যমান উদ্যোগ কম হলেও থেমে নেই। অনলাইনে নানা আয়োজনের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হচ্ছে। ‘শতাব্দীর মহানায়ক’ শিরোনামে মাসব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে শিল্পকলা একডেমি। গত ২ আগস্ট অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানের বিভিন্ন দিনে গানে গানে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা জানান শিল্পী মিতা হক, সাজেদ আকবর, ফকির শাহাবুদ্দিন, অনুপমা মুক্তি প্রমুখ। কবিতায় মুজিবের কথা বলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বাচিক শিল্পী আশরাফুল আলম। আজ রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে ‘পড়ি বঙ্গবন্ধুর বই/সোনার মানুষ হই’ শীর্ষক পাঠ কার্যক্রম। ঢাকা মহানগরের ১০টি বেসরকারী গ্রন্থাগার মিলে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ১৫০ জন শিক্ষার্থী কার্যক্রমে অংশ নেবে। জাতির জনকের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’ পাঠ করবে তারা। শোকের মাসে চলছে বিশেষ পুস্তক প্রদর্শনীও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা বাংলা ও ইংরেজী বইয়ের বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে শাহবাগের পাঠক সমাবেশ কেন্দ্র। ‘জাতির জনককে জানুন’ শীর্ষক আয়োজনে প্রদর্শিত হচ্ছে তিন শতাধিক বাংলা ও ইংরেজী গ্রন্থ। থাকছে জীবনী, প্রবন্ধ, কবিতা, তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণসহ নানা রচনা। বিদেশ থেকে প্রকাশিত কিছু দুর্লভ ইংরেজী বইও রয়েছে। ১৫ আগস্ট ঘিরে থাকছে আরও অনেক কর্মসূচী। কর্মসূচী বলতে হয় তাই বলা, আসলে পিতার প্রতি ভালবাসা অনুরাগ প্রকাশ করবে কৃতজ্ঞ জাতি। বইয়ের ভাষায় কথা কবিতা গানে অর্ঘ্য নিবেদন করবে। ঢাকায় নয় শুধু, সমগ্র বাংলাদেশে উচ্চারিত হবে মুজিব নামটি। কবি লিখেছিলেন : তার ছায়া দীর্ঘ হ’তে-হ’তে/মানচিত্র ঢেকে দ্যায় সস্নেহে, আদরে...। আর গীতিকবি গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের কথাটি তো আরও বেশি হৃদয় ছোঁয়া, যেখানে তিনি বলছেন : একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রণি...। এক মুজিব আজ ছড়িয়ে পড়েছেন ৫৬ হাজার বর্গমাইলে। বাংলার জল হাওয়ার সঙ্গে মিশে আছেন। আগস্ট তাই শুধু বেদনার নয়, হারাবার নয়, ফিরে পাওয়ার। প্রতি ১৫ আগস্ট নতুন করে জন্ম নেন মুজিব। এবারও নিশ্চয়ই এর ব্যতিক্রম হবে না।
×