ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আজ বিশ্ব আদিবাসী দিবস

আদিবাসীদের করোনা প্যাকেজ, খণ্ডকালীন চাকরি দাবি

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ৯ আগস্ট ২০২০

আদিবাসীদের করোনা প্যাকেজ, খণ্ডকালীন চাকরি দাবি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার ভিন্ন পরিবেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ‘আদিবাসী দিবস’। ‘আদিবাসী’ হিসাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি থেকে সরে যায়নি দেশের ৪৫টি সংখ্যালঘু জাতিসত্তা। সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে সরকার ও আদিবাসী নেতৃবৃন্দ। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে আদিবাসী জনগণকে ইতোমধ্যে ‘উপজাতি, নৃ-গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা সম্প্রদায়’ হিসেবে অভিহিত করেছে বর্তমান সরকার। সরকারী ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন আদিবাসী নেতৃবৃন্দ। তারা অভিযোগ করেন, নানাভাবে ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালনে নিরুৎসাহিত করে যাচ্ছে সরকার। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালন করার জন্য সকরারের কাছে দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস)সহ বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ রবিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব আদিবাসী দিবস। আদিবাসীদের জন্য করোনাকালীন আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজের পাশাপাশি খ-কালীন কর্মসংস্থানের দাবি জানিয়েছেন আদিবাসী নেতৃবৃন্দ। আদিবাসী নেতৃবৃন্দ জানান, বাংলাদেশে ৪৫টি জাতিসত্তার প্রায় ৩০ লাখ আদিবাসী রয়েছে। আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে পাহাড়ী ও সমতল অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে একের পর এক কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছে তারা। সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটির কাছে তারা নিজেদের দাবি-দাওয়া পেশ করেন। স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় তারা বুক বেঁধে ছিলেন। কিন্তু আদিবাসীদের দাবি এড়িয়ে যায় সরকার। গত ২০১২ সালে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের আদিবাসী স্বীকৃতি দিতে নাকচ করে দেয়ার বক্তব্যের প্রতিবাদ করে আদিবাসীরা। তারই ধাবাবাহিকতায় ২০১২ সালে একই বক্তব্য দেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। ‘আদিবাসী’ বিষয়ে বর্তমান সরকারের অবস্থান তুলে ধরতে গত ২০১২ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটা করে বিদেশী কূটনীতিক ও উন্নয়ন সহযোগী গোষ্ঠী এবং দেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের পৃথক পৃথকভাবে ব্রিফিং করেন। ব্রিফিংয়ে তিনি দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসমূহকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করতে বারণ করেন এবং পক্ষান্তরে তাদের ‘জাতিগত সংখ্যালঘু’ বা ‘উপজাতি’ (ট্রাইবাল) আখ্যায়িত করতে পরামর্শ দেন। ২০১২ সালে এই দু’ মন্ত্রীর বক্তব্য যেন কাগজকলমে রূপ পায়। পরবর্তীতে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে ৩০ লাখ আদিবাসী জনগণকে ‘উপজাতি, নৃ-গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা সম্প্রদায়’ হিসেবে অভিহিত করে বর্তমান সরকার। তবে তা প্রত্যাখ্যান করেছে আদিবাসীরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) জনকণ্ঠকে জানান, সংবিধানে আদিবাসীদের উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আদিবাসী জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। তিনি অভিযোগ করেন, আদিবাসীদের বিলুপ্ত করার চেষ্টা করছে শাসকগোষ্ঠী। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে সব সময়ই আদিবাসীদের প্রতি বৈরী মনোভাব কাজ করে। সংবিধান সংশোধন করে আদিবাসী জাতিসমূহের স্বীকৃতি প্রদান করতেই হবে। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও সরকার কখনও রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসী দিবস উদ্যাপন করেনি। সরকার উগ্র জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আদিবাসী জনগণের আত্ম পরিচয়ের অধিকার অস্বীকার করেছে, যা দেশে বিদেশে রাষ্ট্রের মর্যাদা ক্ষুণœ করেছে। তিনি আরও বলেন, দেশের আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভাল নয়। তাদের ওপর সাম্প্রায়িক হামলা, তাদের ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদ, ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণসহ সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনে সরকার এ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি, আদিবাসীদের মতামতও নেয়া হয়নি। উন্নয়ন, পরিকল্পনা পরিকল্পনা প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আদিবাসীদের সিদ্ধান্ত নির্ধারণী কোন ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয় না সরকার। বরং উন্নয়নের নামে আদিবাসী জীবনধারা বিপর্যস্ত করে তোলা হয়। সন্তু লারমা আরও অভিযোগ করেন, নানা কৌশলে দেশের আদিবাসীদের পেছনে রেখে দেয়া হচ্ছে। ‘আদিবাসী’ পরিচয় নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। সংবিধানে কোথাও বলা নেই যে, আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ বলা যাবে না। তারপরও প্রশাসনে এবং সরকারী পর্যায়ে এ ধারণা প্রবলভাবে প্রচার করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে আদিবাসী নেই। কেউ ইচ্ছে করলেই কোন জাতিসত্তার পরিচয় বদলে দিতে পারে না। দেশে আদিবাসী ভূমি দখলের উৎসব চলছে। তিনি আরও বলেন, দেশে আদিবাসী ঘোষণাপত্রের আলোকে আদিবাসীদের উন্নয়নে পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে স্বীকৃত আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার সরকার সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে চলেছে। আদিবাসীদের জন্য করোনাকালীন আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজের পাশাপাশি খ-কালীন কর্মসংস্থানের দাবি জানিয়ে ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, সারাবিশ্ব আজ করোনাভাইরাসে জর্জরিত। করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার। আদিবাসী জনগণ দরিদ্রদের মধ্যেও প্রান্তিক। তারা ঐতিহাসিকভাবে শোষণ, বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। করোনার কারণে তাদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। করোনায় কর্মহীন হয়ে অনাহারে অর্ধাহারে জীবনযাপন করছে দশ হাজারের বেশি আদিবাসী পরিবার। করোনাকালেও আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভাল নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার হীন উদ্দেশে আদিবাসীদের ওপর সাম্প্রদায়িক হুমকি, আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদ, আদিবাসী নারী ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণসহ নৃশংস সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, এ করোনাকালীন সময়ে আদিবাসীদের প্রণোদনা প্যাকেজের জোর দাবি জানাচ্ছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৩ বছরের পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে এবং সমতলের আদিবাসীদের প্রথক ভূমি কমিশন দাবিতে সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। আদিবাসীদের সমতাভিক্তিক অধিকার দিতে পারলে বাঙালী গর্বিত হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাওয়ায় আদিবাসীদের পণ্যগুলো অবিক্রীত অবস্থায় রয়ে যাচ্ছে। ফলে আদিবাসীরা বেকায়দায় পড়েছে। আদিবাসীদের জীবন খুবই সঙ্কটাপন্ন। গারো গৃহকর্মী ও বিউটিশিয়ানদের কর্ম সংকুচিত হওয়ায় তাদের গ্রামে ফিরে যেতে হয়েছে। কিন্তু গ্রামেও তাদের কর্মসংস্থান মিলছে না। করোনাকালীন দুঃসময়ে আদিবাসীদের অবশ্যই প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, মানবিক, বিজ্ঞানমনস্ক, ভাষা নিরপেক্ষ, জাতি নিরপেক্ষ, অসম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে, যেখানে আদিবাসী বাঙালী সমান অধিকারে থাকতে হবে।
×