ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাঘব বোয়ালরা অধরাই ॥ মানব পাচার

প্রকাশিত: ২২:৩২, ৯ আগস্ট ২০২০

রাঘব বোয়ালরা অধরাই ॥ মানব পাচার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ মানবপাচারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় পাচার হওয়াদের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ধাপে ধাপে প্রায় চারশ’ জনকে দেশে ফেরত আনা হচ্ছে। দেশে ফিরে তারা দালালদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছেন। মামলার তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে দালালসহ দুই থেকে তিন ধাপ উপরে থাকা মানব পাচারে জড়িতদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তারপরে আর সম্ভব হয় না। মানব পাচারে যোগসূত্র থাকার তথ্য মিললেও অকাট্য তথ্য প্রমাণাদির অভাবে রাঘব বোয়ালদের চার্জশীটভুক্ত আসামি করা যায় না। জঙ্গীদের মতো কাট আউট পদ্ধতিতে ধাপে ধাপে মানব পাচার হওয়ার কারণেই রাঘব বোয়ালরা অধরাই থেকে যাচ্ছে। তদন্তে তাদের নাগাল মিলছে না। মানব পাচার সংক্রান্ত মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এমন তথ্যই পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সূত্রটি বলছে, সম্প্রতি মানব পাচারের বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন অপরাধের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখানোর ঘোষণা দিয়েছেন। পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে মানবপাচার সংক্রান্ত মামলা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্তের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সে মোতাবেক শুধু সিআইডি পুলিশই সারাদেশে প্রায় এক হাজার মানব পাচার মামলার তদন্ত করছে। তদন্তে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশ পাঠানোর নামে সহজ-সরল মানুষদের আকাশ, স্থল ও জলপথে পাচার করা হচ্ছে। সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কূটনৈতিক সম্পর্কসহ নানা দিক থেকে যোগাযোগ করে পাচারকৃতদের ফেরত আনা অব্যাহত আছে। যদিও প্রতিবছর দেশ থেকে কত মানুষকে বিদেশ পাঠানোর নামে পাচার করা হচ্ছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। সিআইডি বলছে, মানব পাচারে রাঘব বোয়ালরা জড়িত। তবে অকাট্য প্রমাণাদি না থাকায় এবং দায়েরকৃত মামলার আসামি না হওয়ায় তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। বহু ধাপে মানব পাচারের ঘটনাটি ঘটাই এর অন্যতম কারণ। পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা দেশে আসার পর গ্রামের বা শহরের দালালদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। কারণ আর্থিক লেনদেনও ওইসব দালালদের মাধ্যমেই হয়। এসব দালালরা একবারে প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ করে। দালালদের নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিটি থানায় থাকা বিশেষ দালাল চক্র। থানা পর্যায়ের দালালরা জেলা পর্যায়ের এবং জেলা পর্যায়ের দালালরা ঢাকার দালাল বা রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। এটি একটি বিশাল চেনের (শিকল) মতো। ঢাকা থেকে বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে মানব পাচার হয়ে থাকে। এজেন্সিগুলোর সঙ্গে দেশ-বিদেশের আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্র, বিমানবন্দর, সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশস্থ দূতাবাস, ইমিগ্রেশন বিভাগ, সমুদ্র বন্দরের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। তারাই মানুষকে বিদেশে পাঠানোর নাম করে পাচার করে দেয়। এমন দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে প্রান্তিক পর্যায়ের দালালদের সঙ্গে দেশী-বিদেশী আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্র বা রিক্রুটিং এজেন্সির সরাসরি যোগাযোগ হয়না। পাচারের শিকার হওয়াদের সঙ্গে মূল পাচারকারীদের কোন সময়ই যোগাযোগ বা দেখা সাক্ষাত হয় না। অত্যন্ত সুকৌশলে ধাপে ধাপে বলতে গেলে অনেকটাই জঙ্গীদের মতো কাট আউট পদ্ধতিতে নিজেদের আড়াল করে মানব পাচারের ঘটনাটি ঘটায়। এটি পাচারকারীদের কৌশল। পাচারকারীরা নিজেদের আড়ালে রাখতে কমিশনের ভিত্তিতে এই চক্রটি তৈরি করে। গ্রামে যে ব্যক্তির কাছ থেকে মালয়েশিয়ার যাওয়ার জন্য ৩/৪ লাখ টাকা নেয়া হয়, মূল রিক্রুটিং এজেন্সি তা থেকে হয়তো অর্ধেক টাকা পায়। বাকি টাকা বিভিন্ন ধাপে দালালরা পেয়ে থাকে। সূত্রটি বলছে, মামলার তদন্তে প্রান্তিক পর্যায়ের দালাল, থানা পর্যায়ের দালাল, জেলা পর্যায়ের দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সি সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু মামলায় রিক্রুটিং এজেন্সিকে আসামি না করায় এবং তাদের বিরুদ্ধে পাচারের অকাট্য প্রমাণাদি না থাকায় তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। আবার অনেক রিক্রুটিং এজেন্সি ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যবসা করে থাকে। সারাদেশে অসংখ্য মানব পাচার সিন্ডিকেট রয়েছে। পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ পুলিশের প্রতিটি ইউনিট প্রধানকে মানব পাচার সংক্রান্ত মামলা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনতে লিখিত চিঠি দিয়েছেন। পুলিশের তরফ থেকে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সিআইডির সূত্রটি বলছে, ইরান, থাইল্যান্ড, লিবিয়া ও মালয়েশিয়াসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আনা হচ্ছে পাচারের পর উদ্ধারকৃতদের। ফেরত আনাদের মধ্যে ১ হাজার ৪৯৪ জন বাংলাদেশীকে অবৈধভাবে প্রবেশের দায়ে গ্রেফতার করেছিল থাইল্যান্ড পুলিশ। এর মধ্যে ৯১৯ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়। তাদের পর্যায়ক্রমে দেশে ফেরত আনা হয়। অন্যদের পরিচয় শনাক্ত করে দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলমান আছে। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে একের পর এক গণকবর আবিষ্কৃত হওয়া ও লিবিয়ায় গুলি চালিয়ে ৪৪ বাংলাদেশীকে হত্যার ঘটনা আবারও মানব পাচারের ঘটনাকে আলোচনায় এনেছে। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, আজ পর্যন্ত কত মানুষকে বিদেশ পাঠানোর নামে বা সত্যি সত্যিই পাচার হয়েছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান জানা যায়নি। তবে ২০১৪ সালেই শুধু সিআইডির তরফ থেকেই সংঘবদ্ধ অপরাধ সংক্রান্ত ৩১শ’ মামলার তদন্ত করা হয়। যার মধ্যে দুই হাজারেরও বেশি ছিল মানব পাচারের মামলা। প্রতি বছর গড়ে সারাদেশে এক হাজারের বেশি মানব পাচারের মামলা হয়। মানব পাচারের মামলায় গত সাত বছরে ২০ হাজারের বেশি জনকে আসামি করে চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। চার্জশীটভুক্ত আসামিদের অধিকাংশই দালাল। আসামিদের অধিকাংশই দেশে বা বিদেশে পলাতক। সারাদেশের সব থানায়ই মানব পাচার সংক্রান্ত মামলা আছে। তবে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে কক্সবাজার জেলার থানাগুলোতে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে উত্তরাঞ্চলের থানাগুলোতে। সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার সৈয়দা জান্নাত আরা জনকণ্ঠকে জানান, লিবিয়ায় পাচারের পর গুলি করে বাংলাদেশী হত্যার ঘটনায় সিআইডি ১৫টি মামলা করেছে। সব মিলিয়ে সিআইডি সদর দফতরে শতাধিক মানব পাচারের মামলা তদন্তাধীন আছে। সারাদেশেই সিআইডির টিম, থানা পুলিশ, র‌্যাব ও ডিবি পুলিশ মানব পাচার মামলার তদন্ত করছে। সিআইডি গত বছর ও চলতি বছর পাচার হওয়াদের মধ্যে অনেককেই ফেরত আনতে সক্ষম হয়েছে। যার সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি।
×