ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বৈরুতে যেভাবে পৌঁছায় ভয়াবহ বিস্ফোরকের চালান

প্রকাশিত: ০৯:৫০, ৮ আগস্ট ২০২০

বৈরুতে যেভাবে পৌঁছায় ভয়াবহ বিস্ফোরকের চালান

অনলাইন ডেস্ক ॥ লেবানন সরকার বৈরুত বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণের জন্য বন্দরের গুদামঘরে ২ হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মজুতে আগুন ধরে যাওয়াকে দায়ী করেছে। এত বিশাল পরিমাণ ভয়ানক দাহ্য পদার্থ ছয় বছরের ওপর শহর কেন্দ্রের এত কাছে কোন নিরাপদ ব্যবস্থা না নিয়ে এভাবে গুদামঘরে কীভাবে রেখে দেয়া হল তা নিয়ে দেশটির জনগণ ক্ষোভে ফুঁসছে। তারা এটা বিশ্বাস করতে পারছেন না। যে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে বন্দর নগরীর বিস্তীর্ণ জনপদ তার উৎসের নাম সরকার করছে না; কিন্তু এটা জানা যাচ্ছে যে মলডোভিয়ান পতাকাবাহী কার্গো জাহাজ এমভি রোসাস ২০১৩ সালের নভেম্বরে ঠিক ওই পরিমাণ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিয়ে বৈরুতে নোঙর করেছিল। রাশিয়ার মালিকানাধীন জাহাজটি জর্জিয়ার বাটুমি থেকে যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে। সেটির গন্তব্য ছিল মোজাম্বিকের বেইরা। জাহাজটিতে ছিল ২ হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। এই রাসায়নিক সাধারণত আসে ছোট গোল টুকরোর আকারে। কৃষিকাজে সারের জন্য এই রাসায়নিক ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তবে জ্বালানি তেলের সঙ্গে মিশিয়ে এটা দিয়ে বিস্ফোরক তৈরি করা যায়; যা খনিতে বিস্ফোরণের কাজে এবং নির্মাণ শিল্পে ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগর দিয়ে যাওয়ার সময় রোসাস জাহাজটিতে কিছু ‘কারিগরি ত্রুটি’ ধরা পড়ে এবং জাহাজটি বৈরুত বন্দরে নোঙর করতে বাধ্য হয়। এই তথ্য এসেছে জাহাজ শিল্পের সাথে জড়িত ২০১৫ সালের একটি প্রতিবেদনে, যেটি শিপিংঅ্যারেস্টেডডটকম নামে একটি নিউজলেটারে প্রকাশিত হয়েছিল। ওই প্রতিবেদন লিখেছিলেন জাহাজের কর্মীদের পক্ষের লেবানিজ আইনজীবীরা। বৈরুত বন্দরের কর্মকর্তারা রোসাস জাহাজটি পরিদর্শন করেন এবং সেটিকে ‘সমুদ্র যাত্রার জন্য নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করেন বলে জানান আইনজীবীরা। জাহাজের বেশিরভাগ কর্মীকে তাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। পাঠানো হয়নি শুধু জাহাজের রুশ ক্যাপ্টেন বরিস প্রোকোশেফ এবং আরও তিনজনকে, যারা ইউক্রেনিয়ান। প্রোকোশেফ বৃহস্পতিবার রয়টার্স বার্তা সংস্থাকে বলেন, রোসাস-এ লিকেজের কিছু সমস্যা হচ্ছিল; কিন্তু জাহাজটির সমুদ্র যাত্রার জন্য কোন সমস্যা ছিল না। তিনি বলেন, জাহাজটির মালিক জাহাজটিকে বৈরুতে পাঠান সেখান থেকে ভারী যন্ত্রপাতির বাড়তি কিছু মাল জাহাজে তোলার জন্য। উদ্দেশ্য ছিল দেশটির অর্থনৈতিক অসুবিধার মধ্যে তাদের সহায়তা করা। কিন্তু জাহাজের কর্মীরা ওইসব ভারী যন্ত্রপাতি নিরাপদে জাহাজে তুলতে পারেননি। এরপর জাহাজের মালিক বন্দরের যে ভাড়া তা যখন দিতে ব্যর্থ হন, তখন লেবাননের কর্তৃপক্ষ জাহাজটি সেখানে জব্দ করে সেটি বসিয়ে দেয় বলে তিনি জানান। এর অল্প কিছুদিন পর, রোসাস-এর মালিক জাহাজটি সেখানে পরিত্যাগ করেন। আইনজীবীরা বলছেন, মালবাহী জাহাজটি যারা চার্টার বা ভাড়া করেছিলেন এবং জাহাজটি নিয়ে যারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন; তারা সব পক্ষই জাহাজটি নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পাওনাদারদের দিক থেকেও নানাধরনের আইনী দাবিদাওয়া ছিল। ইতোমধ্যে জাহাজের ভেতর তখনও যেসব নাবিক ও কর্মী ছিলেন তাদের রসদ ও খাবার দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। আইনজীবীরা বলেছেন, তারা বৈরুতের জরুরিকালীন বিচারকের কাছে আবেদন করেন, যাতে ওই ক্রু-দের নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। আইনজীবীরা বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলেন, ওই জাহাজে যে রাসায়নিক রয়েছে তা খুবই ‘বিপজ্জনক’ প্রকৃতির এবং ক্রুরা জাহাজে ঝুঁকির মধ্যে থাকছেন। বিচারক শেষ পর্যন্ত ক্রুদের জাহাজ থেকে নামার অনুমতি দেন এবং ২০১৪ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজ থেকে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের চালান ‘১২ নম্বর ওয়্যারহাউসে স্থানান্তরিত করেন। ওই গুদামঘরটি ছিল বিশাল শস্য গুদামগুলোর পাশে। আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, ওই রাসায়নিকের চালান হয় নিলামে তোলার অথবা যথাযথভাবে নষ্ট করে ফেলার অপেক্ষায় ছিল। ‘ওই রাসায়নিক ছিল চরম বিস্ফোরক পদার্থ। সে কারণেই আমরা যখন জাহাজে ছিলাম সেগুলো জাহাজের মধ্যেই রাখা ছিল...ওই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট খুবই উচ্চ ঘনত্বের ছিল’— বলেন প্রোকোশেফ। তিনি আরও বলেন, এই বিস্ফোরণে যারা হতাহত হয়েছেন তাদের জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু স্থানীয় কর্তৃপক্ষের, দায়ী লেবানিজদের এর জন্য শাস্তি হওয়া উচিত। তারা এই মাল নিয়ে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি, মোটেও মাথা ঘামায়নি। বন্দরের জেনারেল ম্যানেজার হাসান কোরায়েতেম এবং লেবাননের শুল্ক বিভাগের মহাপরিচালক, বদরি দাহের, দু’জনই বুধবার বলেন, তারা এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা বিচারবিভাগকে সেখানে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুত রাখার বিপদ সম্পর্কে বারবার সতর্ক করে দিয়েছেন এবং সেখান থেকে এগুলো সরিয়ে ফেলার প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার বলেছেন। অনলাইনে যেসব নথিপত্র পোস্ট করা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে শুল্ক কর্মকর্তারা বৈরুতের জরুরিকালীন বিচারকের (জাজ অব আর্জেন্ট ম্যাটার্স) কাছে চিঠি লিখে কীভাবে ওই চালান বিক্রি করে দেয়া যায় বা নষ্ট করে ফেলা যায় সে বিষয়ে নির্দেশ চেয়েছেন। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তারা অন্তত ছয়বার এ ব্যাপারে চিঠি লিখেছেন। স্থানীয় টিভি চ্যানেল ওটিভিকে কোরায়েতেম বলেছেন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিভাগও সতর্ক বার্তা দিয়ে চিঠি লিখেছিল। গণপূর্ত মন্ত্রী মিশেল নাজির, যিনি এ বছরের শুরুতে দায়িত্ব নেন, তিনি আলজাজিরাকে বলেছেন, এ বছরের জুলাইয়ের শেষ দিকে তিনি প্রথম বন্দরে এই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের উপস্থিতির কথা জানতে পারেন। তিনি সোমবার কোরায়েতেমের সাথে এ নিয়ে কথা বলেন। এর পর দিন মঙ্গলবার অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের ওই গুদামে আগুন থেকে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এই বিস্ফোরণে অন্তত ১৫৭ জন এখন পর্যন্ত মারা গেছেন, আহতের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। আরও বহু মানুষ এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন বলেছেন, রোসাস মালবাহী জাহাজের জব্দ করা কার্গো মোকাবেলায় এই ব্যর্থতা ‘অগ্রহণযোগ্য’ এবং ‘দোষী ব্যক্তিদের ও যাদের গাফিলতি এজন্য দায়ী তাদের বিচারের এবং তাদের সর্বোচ্চ কঠোর শাস্তির’ প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। তদন্ত কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট গুদামজাত করার এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে যেসব কর্মকর্তা ছিলেন তাদের গৃহবন্দী করার নির্দেশ দিয়েছে দেশটির সরকার। -বিবিসি বাংলা
×