ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে ঘিরে ব্লু ইকোনমি জোন

প্রকাশিত: ২৩:১০, ৮ আগস্ট ২০২০

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে ঘিরে ব্লু ইকোনমি জোন

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ জাপান, চীন এবং ভারতের অর্থায়নে বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের চারটি স্থানে গভীর সমুদ্র বন্দর, অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজ বেশ জোরেশোরে এগিয়ে চলেছে। এসব প্রকল্পে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করছে এ তিন দেশ। এছাড়া প্রকল্পের সঙ্গে গড়ে উঠছে এলএনজি, কয়লা, তাপ বিদ্যুতসহ বিভিন্ন প্রকল্প। জাপান কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে ৩ হাজার ৫শ’ একর অর্থনৈতিক জোনসহ বন্দর ও কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র, মিয়ানমারের রাখাইনে চীন ও ভারত অর্থনৈতিক জোনসহ বন্দর প্রতিষ্ঠার প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের এ অঞ্চলকে ঘিরে ব্লু ইকোনমিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় জাপান, চীন এবং ভারত পিছিয়ে থাকতে চায় না বলেই এ দুই দেশকে ঘিরে ইতোমধ্যে বিপুল অঙ্কের এ বিনিয়োগ বলে বিশেষজ্ঞদের মত রয়েছে। যা আগামী দিনগুলোতে আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, পৃথক দেশ হলেও সাগর সন্নিহিত সীমারেখার অদূরে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভূ-অর্থনীতি এবং কূটনৈতিক তৎপরতার বিষয়টিও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। সূত্র জানায়, বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত গভীর সমুদ্র বন্দর নেই। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব এবং পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়েছিল দীর্ঘ সময় আগে। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর প্রতিষ্ঠায় চীন এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবুজ সঙ্কেত মেলেনি। এর নেপথ্যে ভূ-রাজনীতির কূটনীতি জড়িত বলে ধারণা করা হয়। উল্লেখ্য, ১২ মিটারের বেশি গভীরতার বন্দরকে গভীর সমুদ্র বন্দর বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ১২ মিটারের গভীরতার কোন বন্দর প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। তবে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার দুটি ইউনিয়ন মাতারবাড়ি ও ধলঘাটে গভীর সমুদ্র বন্দর ও পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক বন্দর প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। ধলঘাটে ১৪ কিলোমিটার চ্যানেল বানিয়ে নির্মাণ হচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর। মাতারবাড়িতে নির্মাণ হচ্ছে ১২শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র। এক্ষেত্রে ধলঘাটে নির্মিতব্য বন্দরকে ‘মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর’ নামে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, মহেশখালীতে বিদ্যুত কেন্দ্রে কয়লাবাহী জাহাজ ভেড়াতে জেটি সম্প্রসারণ করে তা পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক বন্দর হিসেবে নির্মিত হবে। এ বন্দরে অন্তত ১৫ মিটার গভীরতা বা ড্রাফটের জাহাজ অনায়াসে প্রবেশ করতে পারবে। মাতারবাড়ি বন্দরের গভীরতা ১৬ মিটার হওয়ায় প্রতিটি জাহাজ ৮ হাজারেরও বেশি কন্টেনার এবং প্রায় ৮০ হাজার টনের কয়লাবাহী জাহাজ সরাসরি ভিড়তে পারবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, বর্তমানে ৯ মিটার গভীরতার জাহাজ চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে প্রবেশ করতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বন্দরে গড়ে জাহাজপ্রতি ১৮শ’ কন্টেনার নিয়ে সাড়ে ৯ মিটার গভীরতার জাহাজ প্রবেশে সক্ষম। চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে বছরে প্রায় ১০ কোটি টন পণ্য ও ৩৩ লাখ কন্টেনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে। এ বন্দর জোয়ার ভাটার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় দিনে চারঘণ্টার বেশি জাহাজ আনাগোনা করতে পারে না। এ কারণে বহির্নোঙ্গরে বিভিন্ন সময়ে অপেক্ষমাণ জাহাজের জট লেগে যায়। বেড়ে যায় আমদানির মালামালের খরচও। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরে জেটি বাড়ানোর সুযোগ নেই জায়গা না থাকার কারণে। ফলে একদিকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর ও পতেঙ্গা বে-টার্মিনাল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। মাতারবাড়ি বন্দর স্থাপনের কাজে প্রায় ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি নৌ চ্যানেল প্রস্তুত হচ্ছে জাইকার অর্থায়নে। প্রধান নেভিগেশনাল চ্যানেল ৩৫০ মিটার প্রশস্ত। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়নে নির্মিত হবে আরও দুটি জেটি। একটি ৩শ’ মিটার সাধারণ পণ্যবাহী ও অপরটি ৪৫০ মিটার কন্টেনারবাহী জাহাজের জন্য। ২০২৬ সালে এসব জেটি চালু হবে বলে প্রস্তাবনায় রয়েছে। এর আগে ২০২৫ সালে চালু হবে ১২শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র। এ কেন্দ্রে কয়লা পবিহনের জন্য এ জেটি নির্মিত হচ্ছে। ৮০ হাজার টন কয়লা নিয়ে ১৪ কিলোমিটার চ্যানেল পাড়ি দিয়ে জাহাজ এ জেটিতে ভিড়তে পারবে। ১৪ কিলোমিটার চ্যানেল তৈরির জন্য সাগরে এবং তীরে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে মাটি ভরাট করা হচ্ছে সঙ্গে দেয়া হচ্ছে বড় আকৃতির পাথরও। যেসব পাথরের ওজন প্রায় ৮০ থেকে ১শ’ কেজি। চট্টগ্রামে বন্দরভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের সূত্রে জানানো হয়েছে, জাপান মাতারবাড়িতে ৩ হাজার ৫শ’ একর অর্থনৈতিক জোনসহ বন্দর ও কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চীন ও ভারত অর্থনৈতিক জোনসহ বন্দর প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ভূ-রাজনৈতিক সুবিধার লক্ষে ধারণা করা হয় ভারতের লক্ষ্য মিজোরাম ও ত্রিপুরা আর চীনের লক্ষ্য ইউনান প্রদেশের কুনমিং নিয়ে। সূত্র জানায়, মাতারবাড়ি বন্দর থেকে রাখাইনের সিটওয়ে বন্দর ২শ’ কিমি এবং কিয়কপিয় বন্দর ৩শ’ কিলোমিটার দূরে। ভারত সিটওয়েতে ১ হাজার একরের অর্থনৈতিক জোনসহ ১২০ মিলিয়ন ব্যয়ে সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে। আর কিয়কপিয়তে চীন ৪ হাজার একরের অর্থনৈতিক জোনসহ ২৫ মিটার গভীরতার বন্দর নির্মাণ করছে, যাতে ব্যয় হচ্ছে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। কালাডান প্রকল্পের আওতায় সিটওয়ে থেকে কালাডান নদীর ২২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মিজোরামে খাদ্যশস্য ইতোমধ্যে পরিবাহিত হচ্ছে। আর চীন পাইপ লাইন বসিয়ে ১ হাজার কিলোমিটার দূরে কুনমিং শহরে তেল নিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে ১২শ’ কি.মি. রেলপথ বসানোর প্রক্রিয়াও শুরু করেছে। এখানে একটি কন্টেনার টার্মিনালও নির্মাণের সিদ্ধান্ত রয়েছে, যদিও মৎস্য চাষ এবং সেগুন বন ধ্বংসের জন্য গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পকে দায়ী করছে মিয়ানমারের পরিবেশবিদরা। চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক কর্মকর্তা প্রকৌশলী সলিমুল্লাহ খানের মতে, মাতারবাড়ির সঙ্গে সড়ক নেটওয়ার্ক সুবিধাজনক নয়। সমুদ্র পথই একমাত্র ভরসা। এছাড়া আমাদের দেশে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হয়ে থাকে বিপরীতে রফতানি কম থাকায় জাহাজযোগে খালি কন্টেনারই যায় বেশি। সূত্রমতে, চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা বন্দরকে কন্টেনার এবং খোলা পণ্য ছোট ছোট লাইটার জাহাজযোগে যোগান দেবে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর। এছাড়া মীরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক জোনে কিছু জেটি নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে আমদানি খরচ অনেকাংশে হ্রাস পাবে। ট্রানজিট দিয়ে মিয়ানমার চীনের কুনমিং, ভারতের মিজোরামকে রাখাইনের সঙ্গে সংযুক্ত করতে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে ট্রান্সশিপমেন্ট দিয়ে কলকাতাকে সংযুক্ত করা গেলে লাভবান হবে বাংলাদেশ। সূত্র জানায়, সরকার ১শ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ প্রক্রিয়ায় তিন থেকে চার মিটার গভীরতার ছোট ছোট নদী বন্দর নির্মাণ করা গেলে অর্থনৈতিক তৎপরতা যেমন বাড়বে, তেমনি পণ্যের সরবরাহ পথও সুগম হবে। পাশাপাশি এক্ষেত্রে বেসরকারী বিনিয়োগ অনেকাংশে বেড়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
×