ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

বৃষ্টি ও জোয়ারে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ৮ আগস্ট ২০২০

বৃষ্টি ও জোয়ারে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পথে এবার ভাটিতে বন্যার প্রকোপ বাড়ছে। জোয়ারের পানিতে বাধা পেয়ে উপকূলীয় বেশ কয়েকটি জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এর সঙ্গে বৃষ্টিপাত বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, উত্তরের পানি নেমে যাওয়ার সময় ভাটিতে পানির চাপ বাড়ছে। জোয়ারের সময় পানি নামতে না পেরে ফুলে উঠছে। ফলে বরিশাল, ভোলা ও লক্ষ্মীপুরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়ছে। উত্তরের বন্যা পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতি হলে মধ্যাঞ্চলে তা খুবই ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। উত্তরের পানি নেমে আসায় ঢাকার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। তবে উজানের ভারি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসায় নতুন করে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। পানি নেমে যাওয়ার পথে ভাটিতে চাপ পড়ায় কোথাও কোথাও অবনতি হচ্ছে। এটা সাময়িক। পানি সাগরে নেমে গেলে ভাটিতে উন্নতি হবে। গত ২৬ জুনের পর ইতোমধ্যে তিন দফায় বন্যার কবলে পড়েছে দেশ। বন্যার স্থায়িত্ব আজ ৪৩ দিন পূর্ণ হতে চলল। পানি যেভাবে নামছে তাতে বন্যায় উন্নত হতে আরও কয়েক সপ্তাহের বেশি সময় লাগতে পারে। অর্থাৎ মধ্য আগস্টের পর দেশ বন্যামুক্ত হতে পারে। আগস্টের শেষে বৃষ্টিপাত বাড়লে আরেক দফায় বন্যা দেখা দিলে তা স্বল্প মেয়াদী হবে। এদিকে বন্যার পানি কমতে শুরু করায় বানভাসি এলাকায় নানা ধরনের পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে। বাড়ছে নানা দুর্ভোগও। একমাসের বেশি সময় ধরে পানিবন্দী থাকার পর এখন তারা বাড়িঘরে ফেরার উৎকণ্ঠায় রয়েছে। এত বেশি সময় ধরে ঘরবাড়ি পানির নিচে থাকায় তা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে তারা নতুন করে বিপাকে পড়েছে ঘরবাড়ি তৈরি করা নিয়ে। তারপর পানি কমায় নতুন নতুন দুর্ভোগ নিয়েই অনেকে বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। ঘরের বেড়া, মাথার ওপর চাল, খাবার, ওষুধ কিছুই নেই। গরু-ছাগল, পুকুরের মাছ, ক্ষেতের ফসল সব ভেসে গেছে। এছাড়া আয়- রোজগার বন্ধ। সব মিলিয়ে বন্যার্তরা নিরুপায় হয়ে পড়েছেন। বন্যায় আউশ ধান, আমনের বীজতলা ও সবজি ক্ষেত ভেসে গেছে অনেক আগেই। পানি কমতে শুরু করার সঙ্গে দেখা দিয়েছে খাবার পানির সঙ্কট। টিউবওয়েল ডুবে গেছে। আর যেসব টিউবওয়েল জেগেছে সেগুলো দিয়ে পানি ওঠে না। নদী ও খাল-বিলের পানিতে বিভিন্ন আবর্জনা ভাসছে। পানি ফুটিয়ে বা অন্য কোন উপায়ে খাওয়ার উপযোগী করার উপায় নেই। বন্যাকবলিত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন রোগবালাই। আমাশয়, ডায়রিয়ার মতো পানিবাহিত রোগের সঙ্গে রয়েছে চর্মরোগ। বিদ্যুতের খুঁটির গোড়ার মাটি সরে যাওয়ায় সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। এ কারণে একরকম অন্ধকারে আছেন বানভাসিরা। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পানি কমতে থাকায় এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি জেলা বন্যামুক্ত হয়েছে। বর্তমানে ১২ জেলা বন্যায় আক্রান্ত। এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ১২ নদ-নদীর পানি। সমতলে ১৬ স্টেশনের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, ঢাকার আশপাশের নদীর পানি কমছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা সিটি কর্পোরেশন সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি কমছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি কমছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। মনু নদী ছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উজানে মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীর পানি কমছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নাটোর, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। কেরানীগঞ্জ ॥ ধলেশ্বরী ও কালীগঙ্গা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একদিকে চলছে নদী ভাঙ্গনের তা-বলীলা অপর দিকে বন্যার রাহুগ্রাস। হুমকির মুখে রয়েছে কেরানীগঞ্জের ধলেশ্বরী আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ ঢাকা-দোহার-নবাবগঞ্জ সড়কের তুলসীখালী সেতুটিও। এছাড়াও ৩ ইউনিয়নের প্রায় শতাধিক গ্রামের প্রায় ৩০ হাজারের অধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বন্যাকবলিত মানুষগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে নিয়ে যেতে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন। দেশে চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে হুমকির মুখে রয়েছে কেরানীগঞ্জের রুহিতপুর ইউনিয়নে ধলেশ্বরী নদীর তীরে গড়ে ওঠা লাকিরচর আশ্রয়ণ প্রকল্প। যেখানে ১৬০ পরিবারের প্রায় দুই হাজার লোকের বসতি। ধলেশ্বরী নদীর পাড় ধরে গড়ে ওঠা আশ্রয়ণ প্রকল্পটি গত ১ সপ্তাহে ৪০ বাড়ি ও শত শত গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ঘর-বাড়ি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে স্থানীয় বাসিন্দারা। আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাশেই ঢাকা-দোহার-নবাবগঞ্জ সড়কের তুলসীখালী সেতু। লাকিরচরের নদী ভাঙ্গনের ফলে হুমকির মুখে রয়েছে তুলসীখালী সেতুটি। স্থানীয়রা আশঙ্কা করছে যেভাবে নদীর ভাঙ্গন শুরু হয়েছে এতে করে পুরো আশ্রয়ণ প্রকল্পের সঙ্গে সেতুটিও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। অপরদিকে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও কালীগঙ্গা নদীর পানি বাড়ায় কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া ও হযরতপুর ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে কলাতিয়া বেড়িবাঁধ। ফসলি জমি, স্কুল, মাঠসহ ডুবে গেছে হাজার হাজার বাড়িঘর। বন্যার পানির তোড়ে ভেঙ্গে গেছে বেশ কয়েকটি সংযোগ। তারানগর ইউনিয়নের খাসের ভিটা সড়ক, সিরাজনগর-তারানগর সড়ক, বড়ইকান্দি-বটতলী সংযোগ সড়কসহ আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ভেঙ্গে গেছে। এতে জীবন-জীবিকাসহ যোগাযোগ ও গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে আছে হাজার হাজার মানুষজন। দেখা দিয়েছে নানা রকম পানিবাহিত রোগ। এ অবস্থায় ত্রাণ ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে হাহাকার করছে এখানকার বন্যাকবলিত মানুষ। বরিশাল ॥ সন্ধ্যা, সুগন্ধ্যা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর পানি বৃদ্ধিতে গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি চরম অবনতি হয়েছে। নদীবেষ্টিত এ উপজেলার ছয় ইউনিয়নের মধ্যে চারটির নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে দুই দফায় মীরগঞ্জ ফেরিঘাট রক্ষা বাঁধের ৪০ মিটার ধসে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। খবর পেয়ে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ হারুন-অর রশিদ ধসে যাওয়া স্থান পরিদর্শন করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, এর আগে ওই ফেরিঘাট সংলগ্ন রহমতপুর, চাঁদপাশা সংযোগ সড়ক রক্ষার্থে ৩০ মিটার এলাকা জুড়ে বালুভর্তি জিওব্যাগ দিয়ে মেরামত করা হয়েছিল। গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও আড়িয়াল খাঁ নদীর প্রবল স্রোতে বাঁধটির মেরামত করা অংশ দুর্বল হয়ে ফের ভেঙ্গে যায়। লক্ষ্মীপুর ॥ পূর্ণিমার জোয়ার ও সাগরে লঘুচাপের প্রভাবে বৈরী আবহাওয়ায় লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, সদর এবং রায়পুর উপজেলার মেঘনা তীরবর্তী অন্তত ৬০ কিমি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এ সময় বহু এলাকা প্রায় ৫-৬ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। জোয়ারে চার উপজেলার অন্তত ৩০-৪০ গ্রামে ফসল, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ও মাছের ঘেরের ক্ষতি হয়েছে। এতে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে পানি বৃদ্ধি পেতে থাকে। মেঘনা জোয়ারের পানিতে আউশ ধানের মাঠ, আমনের বীজতলা ও রোপা আমন ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। অনেকের পুকুরের মাছ, গবাদি পশু ও বাসস্থান ভেসে যায়। রাগতি উপজেলার চরআলগী ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন লিটন জানান, তার ইউনিয়নের প্রায় আশি শতাংশ এলাকা জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। এলাকাবাসী সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন। বড়খেরী ইউনিয়নও পানির নিচে তলিয়ে গেছে জানান ইউপি চেয়াম্যান মিজানুর রহমান। তলিয়ে গেছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপাঞ্চল চরগজারিয়া। সদর উপজেলার বুড়িরঘাট এলাকার ইতোমধ্যে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে, অনুরূপভাবে তলিয়ে গেছে বুড়িরঘাট, চরমেঘা, পশ্চিম চর রমণী মোহন। এসব চরাঞ্চলের উঠতি আউশ এবং আমন বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন উত্তর চর রমণী মোহন ইউপি চেয়ারম্যান আবু মোঃ ইউছুফ ছৈয়াল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রায়পুর উপজেলার চরকাচিয়া, চরকানিবগা, মোল্লারহাট। নওগাঁ ॥ আত্রাইয়ে নদী-নালা, খাল-বিল ও ফসলের মাঠে থৈ থৈ করছে পানি। যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। সাম্প্রতিক সময়ে ভারি বর্ষণ ও আত্রাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙ্গন এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে প্রতিটি মাঠ প্লাবিত হয়েছে। এসব খাল-বিলে এখন মাছ শিকারে মুখরিত হয়ে উঠেছে এলাকার মৎস্যজীবী (জেলে) পরিবারের সদস্যরা। তারা বিভিন্ন ব্রিজ, কালভার্ট, ও স্রোতের মুখে খড়া জালসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে দিন রাত মাছ শিকার করছেন। আর এ মাছ বিক্রি করে স্বচ্ছন্দ্যে চলছে তাদের পরিবার।
×