ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হাওড়ে মরণ ফাঁদ ॥ অরক্ষিত নৌ পরিবহন ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ৮ আগস্ট ২০২০

হাওড়ে মরণ ফাঁদ ॥ অরক্ষিত নৌ পরিবহন ব্যবস্থা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ নেত্রকোনা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটারের বেশি পথ শেষে মদন উপজেলা। সেখান থেকে আরও কিছু পথ পাড়ি দিলেই উচিতপুর। স্থানীয়দের কাছে এই এলাকাটি ‘মিনি কক্সবাজার’ হিসেবে পরিচিত। এখান থেকে খালিয়াজুড়ি উপজেলায় শুকনো মৌসুমে যেতে রয়েছে পাকা রাস্তা। বর্ষায় চলাচলের একমাত্র পথ নৌ-যোগাযোগ। থৈ থৈ জলরাশি। উত্তাল ঢেউ। কয়েকটি হাওড় পাড়ি দিয়ে যেতে হয় সেখানে। স্রোত, ঢেউ আর বাড়তি পানি মিলে বলতে গেলে আষাঢ় আর শ্রাবণে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে গোটা এলাকা। তাই ভ্রমণপিপাসু লোকজন ছুটে আসেন নৌকা ভ্রমণে। উচিতপুর থেকে শতাধিক ট্রলার খালিয়াজুড়িসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত করে। অথচ কোন নৌযানের অনুমোদন নেই। নেই ফিটনেস সনদ। চালকদের প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স বলতে কিছুই নেই। নৌ-নিরাপত্তার কোন রকম ব্যবস্থাই নেই এই জনপদজুড়ে! এবার নেত্রকোনা থেকে ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মোহনগঞ্জ উপজেলা। রেল স্টেশনের সামনেই বিশাল ট্রলার ঘাট। যুগ যুগ ধরে এ ঘাটটি বর্ষায় বেশি সচল হয়। প্রতিদিন এখান থেকেও সুনামগঞ্জসহ ভাটি এলাকার বিভিন্ন গন্তব্যে নৌযান ছেড়ে যায়। কিন্তু নৌ-নিরাপত্তার কোন বালাই নেই। নেই তদারকির কোন ব্যবস্থাও। এটাই সত্যি। বাস্তবতা। স্থানীয় লোকজন জানেনও না, নৌ-নিরাপত্তার জন্য কোন রকম ব্যবস্থাপনা আদৌ রয়েছে। মোহনগঞ্জ থেকে চার কিলোমিটার সামনে গেলেই সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলা। থানা থেকে আধা কিলোমিটারের কম দূরত্বে ট্রলারঘাট। সেখান থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন গন্তব্যে ইচ্ছেমতো যাত্রী বোঝাই করে ট্রলার ছেড়ে গেলেও দেখার কেউ নেই। তিন থেকে চার কিলোমিটার সামনে গেলে কান্দাপাড়া ঘাট। সেখানেও নৌ-নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা নেই। এর এক কিলোমিটার সামনে জয়শ্রি বাজার। সেখান থেকে মালবাহী ও যাত্রীবাহী নৌযান বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে গেলেও কোন নৌযানেই যাত্রী নিরাপত্তার সরঞ্জাম পাওয়া যাবে না। গোটা হাওড়ের জনপদজুড়ে নৌপথে যাত্রী নিরাপত্তার চিত্র ঠিক এরকমই। সব মিলিয়ে যদি বলা হয়- একেবারেই অরক্ষিত অবস্থায় চলছে দেশের হাওড়াঞ্চলের নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা। স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌপরিবহন অধিদফতর কোন পক্ষ থেকে নজরদারি নেই। অথচ অনেক ঘাট জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরকারীভাবে ইজারা দেয়া হলেও জনস্বার্থে কোন পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে হাওড়াঞ্চল অধ্যুষিত জেলার সংখ্যা সাতটি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সারা বছরই কমবেশি নৌ-যোগাযোগ রয়েছে এসব জেলায়। তবে সবচেয়ে বেশি পণ্যবাহী নৌযান শুকনো মৌসুমে চলে। বর্ষায় যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের বড় ভরসাই নৌ-যোগাযোগ। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ঘিরে হাওড়াঞ্চলের অবস্থান। এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ হাওড়াঞ্চল নামে এই এলাকাটি পরিচিত। অথচ গোটা হাওড়াঞ্চলজুড়ে নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে চালকদের ইচ্ছেমতো। যেখানে সেখানে হচ্ছে নৌঘাট। নিজেদের ইচ্ছেমতো নতুন নতুন রুটে চলানো হচ্ছে নৌযান। কোন পথে কোন ধরনের নৌযান চলবে, নৌযান নির্মাণের অনুমতি, চালাচলের উপযোগী কিনা, নৌযানের লাইসেন্স আছে কিনা, চালকের লাইসেন্স আছে কিনা, কোন রকম প্রশিক্ষণ আছে কিনা, নক্সা, ফিটনেস সনদ, নির্মাণ তদারকি এর কোন কিছুর বালাই নেই গোটা অঞ্চলজুড়ে। বিশে^র অন্যান্য দেশে নদীপথ কম থাকায় নতুন করে নদী খনন করে পথ তৈরি করা হয়। চলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। প্রকৃতির আশীর্বাদ হয়ে রয়েছে হাওড়ের বিলাশ জলরাশি। অথচ যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে হাওড়, নদ-নদী সমুদ্র কোন কিছুকেই সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। উল্টো প্রতি বছর কমছে নৌপথে। বন্ধ হচ্ছে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের পথ। হাওড়াঞ্চলে অবিশ^াস্য বাস্তবতা হলো, যাত্রী নিরাপত্তার জন্য ৯৯ ভাগ নৌযানে কোন রকম নিরাপত্তা সরঞ্জাম রাখা হয় না। এছাড়া নৌপথে নেই সতর্ক সংকেতের ব্যবস্থা ও নির্দেশনা। কোন নৌযানে নেই আলোর ব্যবস্থা। অন্ধকারে অন্ধের মতো চলে ট্রলার। তাছাড়া ইচ্ছেমতো নৌকা নির্মাণ করে সঙ্গে ইঞ্জিন যুক্ত করে দেয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী কোন ধরনের নৌযানে কোন ধরনের ইঞ্জিন ব্যবহার করা যাবে, তা ঠিক করার দায়িত্ব সরকারের দায়িত্বশীলদের। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো হাওড়ের সাত জেলার জেলা প্রশাসনের কাছে কত নৌযান, নৌঘাট রয়েছে এর সুনির্দিষ্ট তালিকা পর্যন্ত নেই। এই পরিস্থিতির মধ্যে গোটা হাওড় এলাকাজুড়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে কমপক্ষে অর্ধলক্ষাধিক নৌযান! দু’একটি জেলায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নৌপরিবহন অধিদফতর বা বিআইডব্লিউটিএ অফিস কিংবা পরিদর্শক থাকলেও তাদের দৃশ্যমান কোন কার্যক্রম নেই। নানা অজুহাতে মাঠে যান না নৌযান পরিদর্শকরা। তেমনি নৌপুলিশ গঠন হলেও হাওড় এলাকায় তাদের কার্যক্রম অদৃশ্য। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনও এ ব্যাপারে নির্বিকার। পুরো নৌ সেক্টর পরিচালনার দায়িত্বে কার্যত কেউই নেই বলা যায়। নিজ দায়িত্বে সবাই চলাচল করেন! এটা কি আদৌ সম্ভব? চালক আর নিজ দায়িত্বে নৌপথে চলাচল করার কারণে বুধবার নেত্রকোনার উচিতপুরে এক মর্মান্তিক নৌদুর্ঘটনায় ১৮ জনের শলীল সমাধি ঘটল। পর্যটকবাহী এই ট্রলারটি প্রচ- ঢেউয়ে উল্টে যায়। মুহূর্তের মধ্যে কালো মেঘে ছেয়ে যায় আনন্দ ভ্রমণ। হাওড়জুড়ে নেমে আসে বিষাদের ছায়া। স্বজনহারা মানুষের কান্নার রোলে ভারি হয়ে ওঠে আকাশ বাতাস। অথচ নৌকাটিতে কোন ধরনের নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছিল না। ঘটনা ঘটনার পর সেখানে পর্যটকবাহী নৌ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। অথচ বছরের পর বছর এরকম অরক্ষিত অবস্থায় চলেছে নৌযান। যা কখনই স্থানীয় প্রশাসন গুরুত্বের সঙ্গে দেখেনি। এ দুর্ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল হাওড়ের নৌপথে নিরাপত্তা ব্যবস্থা একেবারেই না থাকার বিষয়টি। তাই দায়িত্বশীলদের নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কেন হলো। জানতে চাইলে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক মঈন উল ইসলাম বৃহস্পতিবার বিকালে জনকণ্ঠকে বলেন, উচিতপুর ইতোমধ্যে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। আশপাশের জেলা উপজেলা থেকেও অনেকে নৌকায় প্রতিদিন এখানে বেড়াতে আসেন। তাই এই পয়েন্টে ‘হাওড় বিলাস’ নামে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী বছর পর্যটন কেন্দ্রের কাজ শেষ হলে সেখানে নৌযান তদারকির জন্য নিয়মিত পুলিশ মোতায়েন করা হবে। তিনি বলেন, বুধবারের নৌকাডুবিতে ১৮ জনের মৃত্যুর পর আমরা নৌ-নিরাপত্তার রোধে অনেক সতর্ক। তাই ভবিষ্যতে এরকম দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তিনি জানান, উচিতপুর নৌঘাটের ইজারদারকে ইতোমধ্যে বেশকিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নৌযানে যাত্রী ও পরিবহন নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিশ্চিত করা, ধারণ ক্ষমতার বাড়তি যাত্রী পরিবহন করা যাবে না, নৌযানের তালিকা করা, কোন নৌযান কত যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যায় এর তথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি জানান, বুধবারের নৌ-দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তীতে জেলায় নৌ-নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান। বলেন, খালিয়াজুড়ির লেপসিয়া নৌঘাটে যাত্রী নিরাপত্তার স্বার্থে একটি পুলিশ ফাঁড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। নেত্রকোনা বলে কথা নয়, হাওড় এলাকাজুড়ে বর্ষা মৌসুমে প্রায় সময় নৌ-দুর্ঘটনার খবর আসে। স্থানীয় লোকজনসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত তদারকির অভাব ও সরকারী নিয়মে নৌপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব না হওয়ায় এসব ঘটনা ঘটছে। জানা গেছে, নেত্রকোনা জেলার মদন, খালিয়াজুড়ি, আটপাড়া, মোহনগঞ্জ ও কলমাকান্দা এই পাঁচ উপজেলা হাওড় অধ্যুষিত। বর্ষার ছয় মাস এসব উপজেলায় যাতায়াত একেবারেই নৌকা নির্ভর। তখন ছোট ছোট নৌকায় ইচ্ছেমতো ইঞ্জিন যুক্ত করে চালানো হয়। জেলার মোহনগঞ্জ, উচিতপুর, খালিয়াজুড়ি, বোয়ালি, লেপসিয়া, ডিঙ্গাপোতা, ঠাকুড়াকোনা, নেত্রকোনার শহরের পাটপট্টি, ছেছড়াখালীসহ ২০টির বেশি স্থান থেকে নিয়মিত নৌযান যাতায়াত করে। অথচ ২০টির মধ্যে একটি ঘাটেরও কোন তদারকি হয় না। জেলায় ৫২টি হাওড় আছে। তেমনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও সরাইল উপজেলা হাওড় অধ্যুষিত। কাজলাবিল, ধারনচি বিল, শাপলা বিলসহ সাতটি হাওড় আছে দুটি উপজেলা মিলে। আশুগঞ্জ, নাসিরনগর, সরাইলসহ অন্তত ১০টি ট্রলারঘাট আছে। এসব ঘাট থেকে যেসব যান চলাচল করে সেগুলো চালকের ইচ্ছেমতো ডিজাইন করে নির্মাণ ও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চলাচল করে। কিশোরগঞ্জের ১৩ উপজেলার মধ্যে ইটনা, মিঠামইন, অট্টগ্রাম, বাজিতপুর, ভৈরব, নিকলী এলাকা হাওড় অধ্যুষিত। রয়েছে নদী বন্দর। জেলার সবচেয়ে বড় ট্রলারঘাট হলো চামড়া। পুরো জেলায় শতাধিক ছোট বড় হাওড় আছে। এর মধ্যে ৫০টি হাওড়ে সারা বছরই নৌযান চলাচল করে। পুরো জেলায় ১২টি ঘাটের অনুমোদন থাকলেও আছে ৩০টির বেশি। জেলা প্রশাসনের কোন রকম তদারকি ছাড়াই এসব ঘাট থেকে নৌযান চলে বছরের পর বছর। যদিও নামেমাত্র নৌপরিবহন অধিদফতরের অফিস খোলা হয়েছে এ জেলায়। কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোঃ সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী বলেন, নৌযান চালকরা প্রশিক্ষণ নিতে খুব একটা উৎসাহ বোধ করেন না। তবুও আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দিতে চেষ্টা করি। যারা স্বেচ্ছায় নিতে চান তাদের প্রয়োজনে আবারও প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। তিনি বলেন, অনেক ঘাট উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইজারা দেয়া হয়। তাদেরও দেখভালের কিছু দায়িত্ব রয়েছে। ১১টি উপজেলা ও ১২টি থানা নিয়ে সুনামগঞ্জ জেলা। গোটা জেলাই হাওড় অধ্যুষিত। ছোট বড় মিলিয়ে আছে চার শতাধিক হাওড়। পুরো হাওড়াঞ্চলের মধ্যে এ জেলাতেই সবচেয়ে বেশি পানি হয়। নৌপথের সংখ্যাও বেশি। জেলাজুড়ে কমপক্ষে দুই হাজার ট্রলারঘাট রয়েছে, এর বেশিরভাগই অনুমোদনহীন। এছাড়া জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে শতাধিক ঘাট ইজারা দেয়া হলেও নজরদারি নেই। বর্ষায় সড়কপথ পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণে জেলায় একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নৌযান। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলেও বর্ষা মৌসুমে নৌপথে যোগাযোগ বেশি। শুকনো মৌসুমে সুরমা, কুশিয়ারাসহ অন্যান্য নদীপথে মালবাহী নৌযান চলে সারা বছর। সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ-ভৈরব-খালিয়াজুড়ি থেকে ঢাকা পর্যন্ত রয়েছে ব্যস্ত নৌ রুট। অথচ তদারকি বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়। যে জেলায় সবচেয়ে বেশি হাওড় ও নৌযান সেখানে এমন চিত্র সত্যিই হতাশ করার মতো বিষয়। কিন্তু কেন। জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ আবদুল আহাদ জনকণ্ঠকে বলেন, নৌ সেক্টরের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব বিআইডব্লিউটিএর। কার্যত আমাদের কোন দায়িত্ব নেই। তিনি বলেন, নৌপরিবহন সেক্টরে কোন এলাকায় ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলে বা এ ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। সিলেট জেলায় সবচেয়ে বড় হাওড় হাকালুকি। কিন্তু হাকালুকি দিয়ে কোন নৌপথ নেই। তবে নদীপথে যোগাযোগ আছে বছরজুড়ে। সিলেট থেকে বিভিন্ন জেলায় পাথর ও বালু পরিবহন করা হয় সারাবছর। সেখানেও নৌযানের তদারকি আছে বলা যাবে না। অর্থাৎ নৌ-নিরাপত্তা ব্যবস্থা একেবারেই শূন্যের কোঠায়। সিলেটে ছোট বড় মিলিয়ে ১০৫টি হাওড় আছে। এর বাইরে হবিগঞ্জে ১৪ ও মৌলভীবাজারে তিনটি হাওড় আছে। নৌপথের সার্বিক নিরাপত্তা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের সকল নৌপথে যাত্রী নিরাপত্তার স্বার্থে কাজ করছে নৌপরিবহন অধিদফতর। তিনি বলেন, দেশে অনিয়ম ও আইন না মানার সংস্কৃতি অন্যান্য সেক্টরের মতো নৌ সেক্টরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল। আমরা আস্তে আস্তে চেষ্টা করছি সবকিছু নিয়মের মধ্যে আনার অভ্যাস গড়ে তুলতে। তিনি বলেন, নৌযান পরিচালনায় নিয়ম না মানা, নক্সা ছাড়াই নৌযান চালানো এসব বিষয় নিয়ে আগের চেয়ে অনেকটা কঠোর হয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে নৌপরিবহন অধিদফতর। এতে দেশের অনেক এলাকায় নৌপরিবহন খাতে স্বচ্ছতা ফিরেছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা অনিয়ম সহজেই দূর করা সম্ভব নয়। আস্তে আস্তে এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। সব অবহেলা দূর করতে হবে। ইতোমধ্যে বিআইডব্লিউটিএ দেশের ৪৩৪টি নৌঘাট উন্নয়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, নৌ সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কেউ বসে নেই। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নৌপথের অথরিটি নৌপরিবহন অধিদফতর এ বিষয়টি মানুষের এতাদিন জানা ছিল না। অথবা মানুষকে জানানো হয়নি। এখন সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে নদীপথ বাঁচানোর। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ হাজার কিলোমিটার নতুন করে নৌপথ তৈরির পরিকল্পনা হয়েছে। সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে ড্রেজার সংগ্রহ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন থেকে আইন না মানার সংস্কৃতি ভুলে যেতে হবে। নিয়ম মেনে নৌযান পরিচালনা করতে হবে। ইচ্ছেমতো যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের দিন ভুলে যেতে হবে। এজন্য যা যা করা দরকার আমরা তাই করব। হাওড়াঞ্চলে নৌ-নিরাপত্তার সার্বিক চিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে নৌপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও নৌ-সড়ক রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, নৌপরিবহন অধিদফতর ও বিআইডব্লিউটিএ এই দুই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নৌ-নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার। বাস্তবতা হলো সরকারী এই দুই সংস্থার লোকজন কাজ করেন না। নিয়ম অনুযায়ী নৌযানে ২০ জন যাত্রী হলে রেজিস্ট্রেশন ও চলার অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু যারা নৌযান চালান তারা সব সময় ২০ জনের কম যাত্রী দেখান। কিন্তু ২০ জনের বেশি নিয়ে এসব যান চলছে কিনা তা দেখভালের যাদের দায়িত্ব; তারা দেখেও দেখেন না। নৌ-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে হাওড়ে তদারকি বাড়াতে হবে। পরিদর্শনের জন্য বোট নেই, অফিস নেই এসব খোঁড়া যুক্তি দিয়ে মাঠ পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কাজ করেন না। ফলে দুর্ঘটনা কমবেশি প্রতিবছরেই হচ্ছে। তিনি বলেন, কিশোরগঞ্জে নৌপরিবহন অধিদফতরের অফিস হলেও দুই সংস্থার পরিদর্শকদের কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। সব মিলিয়ে গোটা হাওড়াঞ্চলের নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা অরক্ষিত বলা যায়। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে হাওড়াঞ্চলের নৌযান চলাচলের ওপর নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, নৌপথের জন্য নৌ পুলিশ গঠন করা হলেও হাওড়ে দেখা যায় না। বিআইডব্লিউটিএ-নৌপরিবহন অধিদফতরের লোকজন কাজ করেন না। এসব সুবিধা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে নৌ-নিরাপত্তার কাজে যুক্ত করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। দেশের যেখানে সেখানে অনুমোদনহীন নৌ-ঘাট ও দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিদের নৌপথে প্রয়োজনীয় নজরদারি না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
×