ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেগম মুজিব নারী সমাজের অহঙ্কার

প্রকাশিত: ২০:০৭, ৮ আগস্ট ২০২০

বেগম মুজিব নারী সমাজের অহঙ্কার

আমাদের সামনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। যিনি অন্তরালে থেকে কাজ করেছেন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের জন্য। ইতিহাসে স্বাধীন জনগোষ্ঠী ও স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের জন্য তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্ত এতটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং সময় উপযোগী ছিল-স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে পুরো দেশের সঙ্গে-সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলও আজ অবগত। শুধু তাই নয়, একমাত্র ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কারণেই তুমুল জনপ্রিয় ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি আমরা পেয়েছি। যে বই দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপনের উৎকৃষ্ট দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। জেনেছি অজানা অনেক ইতিহাস। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদান নিয়ে এই বইয়ের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী। বললাম, লিখতে যে পারি না, আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে কি জনসাধারণের কোন কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুক বলতে পারি- নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব শুধু লেখার কথা বলেই তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি। তিনি রীতিমতো উদ্যোগ নিয়ে লেখার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে আরও উল্লেখ করেন, ‘আমার স্ত্রী যার ডাকনাম রেণু, আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল, জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’ বঙ্গবন্ধুকে লেখার অনুরোধ, লেখার ব্যবস্থার পাশাপাশি কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি এগুলো সংরক্ষণও করেছেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের ভূমিকায় মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার জবানী থেকে জানা যায়; ড. ওয়াজেদ সাহেব আণবিক কমিশনের কর্মচারী হওয়ায় অফিসে নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন কিন্তু নজরদারি ছিল খুব। এদিকে বাচ্চারা স্কুলে যাবে, সঙ্গে ছিল না কোন বই-পুস্তক। পাকিস্তানী জওয়ানরা জানতে চেয়েছিল বই-পুস্তক কোথায়? উত্তর দেয়া হয়েছিল ধানম-ির ৩২ নম্বরে সড়কের বাসায় আর যেটি ছিল পাকিস্তানী আর্মিদের দখলে। প্রসঙ্গক্রমে ৩২ নম্বরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া গেল এবং সঙ্গে ছিলেন শেখ হাসিনা। সেই কঠিন থেকে কঠিনতম সময়ে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তাঁর প্রিয় কন্যা শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, ‘একবার যেতে পারলে আর কিছু না হোক, তোর আব্বার লেখা খাতাগুলো যেভাবে পারিস নিয়ে আসিস।’ এবং খাতাগুলো কোথায় পাবে বা কোথায় রাখা আছে সেটিও সুনির্দিষ্টভাবে বলেছিলেন। শেখ হাসিনা তাঁর লেখায় আরও উল্লেখ করেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু যে দিন জেল থেকে মুক্তি পেতেন জেলগেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এবং বঙ্গবন্ধুর লেখা খাতাগুলো যেন ঠিকভাবে ফেরত আসে সে বিষয়ে তিনি নজর রাখতেন।’ আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর বিখ্যাত ভাষণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি। শুধু তাই নয়, বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। আর এই ভাষণেরও মূল সাহস জুগিয়েছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ওই ভাষণে কী বলতে হবে, কার কথা বলতে হবে-খুব কাছে থেকে শেখ মুজিবকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বেগম মুজিব। ‘ভাইয়েরা আমার’ নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। ৭ মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বলেন, ‘দেখ, তুমি সারাটা জীবন এ দেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছ, দেশের মানুষের জন্য কী করতে হবে তা সকলের চেয়ে তুমিই ভাল জান। আজকে যে মানুষ এসেছে, তারা তোমার কথাই শুনতে এসেছে। তোমার কারও কথা শোনার প্রয়োজন নেই, তোমার মনে যে কথা আছে তুমি সেই কথাই বলবে। আর সেই কথাই সঠিক কথা হবে। অন্য কারও কথায় তুমি কান দেবে না।’ আমরা আজ কথায়, আলোচনায় কিংবা গবেষণায় দেখি, একজন মুজিব না হলে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হতো না। কিন্তু এই একজন মুজিবকে যিনি তিল তিল করে গড়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন, কঠিন বিপদের সময়েও ভালবাসার হাত দুটো শক্ত করে ধরে রেখেছেন; সহজ-সরল প্রকৃতির শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। যে মুজিব খুব আদর করে, ভালবেসে রেণু নামেই ডেকেছেন, জেলখানায় বসে রেণু নামেই চিঠি লিখেছেন। ফজিলাতুন্নেছা সম্বন্ধে একান্ত সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার স্ত্রীর মতো সাহসী মেয়ে খুব কমই দেখা যায়। আমাকে যখন পিন্ডির ফৌজ বা পুলিশ এসে জেলে নিয়ে যায়, আমার ওপর নানা অত্যাচার করে, আমি কবে ছাড়া পাব বা কবে ফিরে আসব ঠিক থাকে না তখন কিন্তু সে কখনো ভেঙ্গে পড়েনি। আমার জীবনে দুটি বৃহৎ অবলম্বন। প্রথমটা হলো আত্মবিশ্বাস, দ্বিতীয়টা হলো আমার স্ত্রী আকৈশোর গৃহিণী।’ খুব ছোটবেলা থেকেই ফজিলাতুন নেছার পড়াশোনার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল। কিন্তু ওই সময়টায় মেয়েদের স্কুলে যাওয়া ছিল নিষেধ। তবে নিজেস্ব চেতনায় তিনি পড়াশোনা করতেন। মিশনারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে বাড়িতে আবরি পড়ার পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজী, অঙ্ক, ভূগোল, ইতিহাস শিক্ষাও তিনি গ্রহণ করেন। পাঠ্য বইয়ের বাইরেও প্রচুর পড়াশোনা করতেন। বাল্যকাল থেকেই ফজিলাতুন্নেছা ছিলেন সহজ সরল প্রকৃতির। আর প্রকৃতির অপরূপ নৈসর্গে তিনি দারুণভাবে মুগ্ধ হতেন। বলা চলে, ফজিলাতুন্নেছা প্রকৃতির বাস্তবতা থেকেই প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করেন। প্রকৃতির কাছ থেকেই তিনি নিজেকে পরিশীলিত, নির্মল ও মার্জিত হওয়ার অসাধারণ মানসিকতার শিক্ষা ধারণ করেন। আজকের নারীর ক্ষমতায়নের যতটা পথ অতিক্রম করেছে তার উল্লেখযোগ্য শুরুটাও করেছেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানার উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভিপি পদে নির্বাচন করবেন বলে যখন স্থির করলেন, তখন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রলীগের ছেলেদের ডেকে বললেন, ‘হাসুকে জেতাতে হলে তো কাজ করতে হবে।’ অন্যদিকে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাহত মেয়েদের পুনর্বাসনসহ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁদের ক্ষমতায়নে জোরালো ভূমিকা রাখেন। সরকারী বিভিন্ন চাকরির সুযোগ করে দিতেন। বিভিন্ন সেক্টরে চাকরির সুপারিশ করেও নারীর ক্ষমতায়নকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছেন। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব একজন আটপৌরে বাঙালী রমণী হয়ে যে স্বকীয় ছাপ রেখেছেন, বিশেষ করে বাঙালী রাজনীতির ইতিহাসে, মুক্তিযুদ্ধের কঠিন পরিস্থিতির ভেতর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করাসহ নিজের ছেলেদের যুদ্ধে পাঠানো এবং চূড়ান্ত বিজয় স্বাধীনতার পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে থেকে সমাজ-সভ্যতা বিনির্মাণে তিনি যে অবদান রেখেছেন, তা চিরস্মরণীয় ও নারী সমাজের জন্য অনুকরণীয়। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)
×