ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বৈরুত ট্রাজেডি

প্রকাশিত: ১৯:৫৪, ৮ আগস্ট ২০২০

বৈরুত ট্রাজেডি

লেবাননের রাজধানী বৈরুতে গত মঙ্গলবার স্মরণকালের এক ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বিস্ফোরণে ভূমিকম্পের মতোই কেঁপে ওঠে সমগ্র নগরী। বৈরুত অতীতে বহুবার শত্রুপক্ষের বোমার আঘাত সয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ এই বিস্ফোরণের জন্য বৈরুতবাসীরা বাইরের কোন শত্রু বা জঙ্গীগোষ্ঠীকে নয়, দুষছে তাদের নিজেদের সরকারকেই। প্রাথমিক তদন্তে স্পষ্ট হয়েছে অনেকটাই যে এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নামক রাসায়নিকই ওই ধ্বংসযজ্ঞের কারণ। বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, ছয় বছর ধরে বৈরুতের গুদামে দুই হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুত করে রাখা হয়েছিল। এ যেন বারুদের সঙ্গে সহাবস্থান! ওই রাসায়নিকটি নিজে ঠিক বারুদ না হলেও আগুনের স্পর্শে তা মহাবিস্ফোরক হয়ে উঠতে পারে। এমন বিপজ্জনক রাসায়নিকের সঙ্গে অজান্তেই অনেকটা যেন সহাবস্থান করে আসছিল বৈরুতবাসী। রাসায়নিক গুদামে মজুত করে রাখা বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক নিলামের মাধ্যমে বাজারে ছেড়ে দেয়ার কথা ছিল। দুঃখজনক হলো বন্দর কর্তৃপক্ষ বার বার তাগাদা দেয়ার পরেও রাসায়নিক সরানো হয়নি। আরও হতাশার কথা হচ্ছে সেখানে যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জমিতে সারের কাজেই মূলত লাগে। কিন্তু এটি আবার বোমা তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়। সহজেই এর থেকে বিস্ফোরণ হতে পারে। ফলে অসতর্কতার কারণেই হোক বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতার সুযোগেই হোক মহালঙ্কাকান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে রাসায়নিকটি। এই বিস্ফোরণ অনেককেই হিরোশিমার পারমাণবিক বিস্ফোরণের কথাও মনে করিয়ে দিতে পারে। অনেকের কাছে এটি দুঃস্বপ্ন জাগানো ভূমিকম্পের মতোই। ব্রিটেনের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমা শহরে যে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছিল, সেটির দশভাগের এক ভাগ শক্তি ছিল বৈরুত বিস্ফোরণে। তারা বলছেন, বৈরুতের এই বিস্ফোরণ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক-বহির্ভূত বিস্ফোরণ। বৈরুতের ভূদৃশ্যই বদলে দিয়েছে মঙ্গলবারের বিস্ফোরণ। প্রাথমিকভাবে প্রায় দেড়শ’ ব্যক্তি নিহত হওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে। কমপক্ষে পাঁচ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। বাংলাদেশের চারজন নাগরিকের মৃত্যুর দুঃখজনক খবর পাওয়া গেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত আমাদের নৌবাহিনীর একটি জাহাজও বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নৌবাহিনীর ২১ নৌসেনা আহত হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লেবাননের প্রধানমন্ত্রীর কাছে শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। জরুরী ভিত্তিতে লেবাননকে যে কোন সহায়তা দিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ, এ আশ্বাসও দেয়া হয়েছে। সহায়তার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ খাদ্যসামগ্রী, প্রাথমিক চিকিৎসাসামগ্রী ও চিকিৎসক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লেবাননে দুই সপ্তাহের জন্য জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছে। তবে বিস্ফোরণের জন্য সরকারকে দায়ী করে এর বিচার চাইছেন বৈরুতবাসী, বিক্ষোভও করছেন তারা। অন্যদিকে এ্যামনেস্টি ইন্ট্যারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিস্ফোরণের ঘটনায় স্বতন্ত্র তদন্তের দাবি জানিয়েছে। তারা সরকারী তদন্তের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছে। বিস্ফোরণের কারণে কয়েক লাখ মানুষ গৃহহারা হয়েছে। তাদের কল্যাণও জরুরী। লেবাননের বিস্ফোরণে স্বজন, অঙ্গ ও সম্পদহারা মানুষ দ্রুত তাদের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠবে, লেবাননে আমাদের দূতাবাসও নাগরিকদের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা নিয়ে সর্বক্ষণিক পাশে দাঁড়াবে- এটাই কাম্য। আহতদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও নিহতদের মৃতদেহ দ্রুততম সময়ে দেশে ফিরিয়ে আনাসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা নিয়ে দুই দেশের সরকারও এগিয়ে আসবে বলে মানুষ আশাবাদী। তবে এ বিস্ফোরণ থেকে বিশ্বের শিক্ষা নেয়ার আছে। রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্য মানববসতি থেকে দূরবর্তী অবস্থানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই সুরক্ষিত রাখা চাই। তা না হলে এ ধরনের মর্মান্তিক মানবিক বিপর্যয় বিশ্বের যে কোনো প্রান্তেই ঘটতে পারে।
×