ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বলির পাঁঠা সিফাত ও শিপ্রা

প্রকাশিত: ২২:৪৩, ৭ আগস্ট ২০২০

বলির পাঁঠা সিফাত ও শিপ্রা

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ পুলিশের গুলিতে নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খানের সঙ্গে ইউটিউব চ্যানেলে কাজ করতে কক্সবাজারে এসেছিলেন শিপ্রা রানী দেবনাথ, সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও তাহসিন রিফাত নূর। স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের এই শিক্ষার্থীরা অনেক দিন ধরে প্রোডাকশনের কাজ করছিলেন। একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য এসেই সিফাত ও শিপ্রা দুটি আলাদা মামলায় কক্সবাজার কারাগারে হাজতবাস করছেন। তাহসিন রিফাত নূরকে তার অভিভাবকের জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। মেজর সিনহার সঙ্গে তারা তিনজন কক্সবাজারের পর্যটন স্পট হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্টে উঠেন এক মাস আগে। তারা কক্সবাজারে এসে পৌরসভার মাধ্যমে কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ল্যাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করান। তাদের চারজনেরই রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। ওই ইউটিউবের প্রযোজক হচ্ছেন- মেজর (অব) সিনহা, পরিচালক শিপ্রা দেবনাথ এবং সিফাত হচ্ছেন ফটোগ্রাফার। ইতোপূর্বে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে ওই ইউটিউবের জন্য এডিটরও খোঁজা হয়েছিল। পুলিশী অভিযানে নীলিমা রিসোর্ট থেকে গ্রেফতার হওয়া শিপ্রা দেবনাথ কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার হাজরাহাটি গ্রামের মেয়ে। বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা নবকুমার দেবনাথের কন্যা তিনি। এদিকে পুলিশের সাজানো মাদক মামলায় কারাগারে বন্দী সাহেদুল ইসলাম সিফাত টেকনাফে যাওয়ার সময় মেজর (অব) সিনহার তথ্য চিত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে তার নানা সাবেক চেয়ারম্যান এনায়েত কবির হওলাদারের সঙ্গে কথা বলেছে। কক্সবাজারে রওনা হওয়ার আগে বলেছিলো নানু- আমি ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশুনা করে একদিন নাম করা ফটোগ্রাফার হব। তোমরা দোয়া কর আমি সিনহা স্যারের সঙ্গে টেকনাফে শূটিং করতে যাচ্ছি। ওখানে একমাস থাকব। তোমার নাতিকে একদিন দেশ চিনবে। সিফাতের নানা এনায়েত কবির হাওলাদার কষ্টের স্বরে সাংবাদিকদের বলেন, আজ আমার নাতিকে সত্যি দেশ চিনল, তবে নামকরা ফটোগ্রাফার হিসেবে নয়, পুলিশের সাজানো নাটকের আসামি হিসেবে। সিফাত জীবনে একটি সিগারেটও খায়নি- অথচ তাকে মাদক দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে। আমি আমার নাতির মুক্তি চাই। আপনারা আমার নাতিকে এনে দিন বলে সাংবাদিকদের মাধ্যমে দাবি জানান তিনি। নিহত সাবেক মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খানের সঙ্গে একই গাড়িতে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতের বাড়ি বরগুনা জেলার বামনা উপজেলার কলাগাছিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম নুর মোস্তফা। মা লন্ডন প্রবাসী মোছাম্মৎ শিলা খান। সিফাত স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফ্লিম ও মিডিয়া বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সিফাতের নানা গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছেন, সাহেদুল ইসলাম সিফাতের ছোটবেলা থেকে শখ ছিল ফটোগ্রাফি ও অভিনয় করা। সে কারণে আমরা তাকে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ফ্লিম ও মিডিয়া বিভাগে ভর্তি করি। নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ খান তার ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিও ধারণ করার জন্য সিফাতকে নিয়ে যান কক্সবাজারে। হিমছড়িতে নীলিমা রিসোর্ট নামে একটি রিসোর্টে অবস্থান করে এক মাস ধরে ডকুমেন্টরি ভিডিও তৈরি করছিলেন তারা। টেকনাফে বাহারছড়ার মাথাভাঙা পাহাড়ে রাত্রিকালীন সাগরগিরি দৃশ্য ধারণ করে ফেরার পথে গত শুক্রবার (৩১ জুলাই) রাত ৯টায় টেকনাফের বাহারছড়া শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (ক্লোজড) লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খান। সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে একই গাড়িতে ফিরছিা সাহেদুল ইসলাম সিফাত। সাবেক চেয়ারম্যান এনায়েত বলেন, পুলিশ তাদের দোষ ধামাচাপা দিতে আমার নাতিকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। নিহত সাবেক মেজর সিনহার সঙ্গে থাকা ও গ্রেফতার হওয়া সাহেদুল ইসলাম সিফাতের নানা বরগুনা জেলার বামনা সদর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এনায়েত কবির হাওলাদার পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, টেকনাফ থানার ওসি ও বাহারছড়া ফাঁড়ির ইনর্চাজ লিয়াকতসহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত পুলিশ নিজেরা বাঁচতে তার নাতিসহ এক সহপাঠীকেও এই ঘটনার বলিরপাঁঠা বানানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সিফাত জীবনে একটি সিগারেটও খায়নি অথচ তাকে মাদক দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে। সিফাতের স্বপ্ন পুলিশের সাজানো নাটকে আজ ধ্বংস হতে চলেছে। মেজর সিনহা ওকে খুব ভালবসত। ওর মাধ্যমে সিনহা তার ইউটিউব চ্যানেলটি তৈরির কাজ শুরু করে। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাহেদুল সিফাত ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার হিসেবেও কাজ করেন। কারিকুলামের অংশ হিসেবে ওরা প্র্যাকটিক্যাল কাজ জমা দেন। সিফাত ও শিপ্রা তৃতীয় বর্ষের এবং তাহসিন শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। ওরা যখনই সময়সুযোগ পায়, নিজেদের মতো করে বিভিন্ন প্রোডাকশনে কাজ করে। অভিনয়জগতের অনেক তারকা, পরিচালকের সঙ্গেও কাজ করেছে বলে জানা গেছে। কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের পাশে অবস্থিত নীলিমা রিসোর্টের ম্যানেজার মোঃ সোলাইমান বলেন, রিসোর্টটি দুই মাসের জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন মেজর (অব) সিনহা মোঃ রাশেদ খান। তারা সংখ্যায় চারজন হলেও আলাদা আলাদা কক্ষে থাকতেন। রিসোর্টে শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসীন রিফাত নূর এই দুইজনকে রেখে ৩১ জুলাই বিকেলে মেজর সিনহা ও সিফাত প্রাইভেটকার নিয়ে টেকনাফ শূটিং করতে যান। রাত দুইটার দিকে রিসোর্টের এক কর্মচারী মুফোঠোনে জানায় যে, রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ সিনহার রিসোর্টে অভিযান চালিয়ে কিছু মদের বোতল ও গাঁজা জব্দ করেছে। উল্লেখ্য, শুক্রবার (৩১ আগস্ট) রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি তাদের তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। মেজর সিনহার বোন শরমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলিসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন বুধবার। আসামিরা বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৩ (টেকনাফ) এর বিচারক শুনানি শেষে তাদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
×