ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সোনার বাজারে আগুন ॥ দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ৭ আগস্ট ২০২০

সোনার বাজারে আগুন ॥ দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে

রহিম শেখ ॥ মহামারী করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেই স্বর্ণের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। প্রতিদিনই ভাঙ্গছে আগের রেকর্ড। মূলত চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে উত্তাপ ছড়াচ্ছে স্বর্ণের দাম। তবে গত জুলাই মাসের শেষার্ধে এসে যেন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে শুরু করে মূল্যবান ধাতুটি। বৃহস্পতিবার অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে সর্বোচ্চ দামের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে স্বর্ণ। এদিন লেনদেনের শুরুতেই প্রতি আউন্স স্বর্ণ রেকর্ড দুই হাজার ৫৩ ডলার ছাড়ায়। সামনের দিনগুলোতে স্বর্ণের দাম আরও বাড়তে পারে এমনই ইঙ্গিত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসও। আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে ডলার ও জ্বালানি তেলের দরপতনের কারণে স্বর্ণের মজুদ করছেন অনেকেই। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বাড়ায় এই প্রভাব ইতোমধ্যে পড়েছে বাংলাদেশের স্বর্ণের বাজারে। এ কারণে দেশে এখন প্রতি ভরি সোনার দাম দাঁড়িয়েছে ৭৭ হাজার টাকা। চলতি মাসেই আরও কয়েক দফা দাম বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বৈধপথে সোনা আমদানির ফলে দাম কমার সম্ভাবনা থাকলেও সেই সুফল মিলছে না বাজারে। এভাবে মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা এ ধাতব মুদ্রা কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত কয়েকদিন ১৯৫০ থেকে ১৯৭৫ ডলারের মধ্যে ঘুরতে থাকা প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম গত মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো দুই হাজার ডলারে উঠে যায়। পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ২০৩১ ডলারে ওঠে। বুধবার আন্তর্জাতিক বাজারে লেনদেনের শুরুতে স্বর্ণের দাম কিছুটা কমলেও দিনশেষে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ২০৪২ ডলারে গিয়ে ঠেকে। বৃহস্পতিবার লেনদেনের শুরুতেই প্রতি আউন্স স্বর্ণ রেকর্ড দুই হাজার ৫৩ ডলার ছাড়ায়। আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম গত ৬ মাসে বেড়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। এর মধ্যে গত এক মাসেই বেড়েছে ১৪ শতাংশেরও বেশি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত তিন কারণে বিশ্বজুড়ে সোনার দাম অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। প্রথমত, বিশ্বের অনেক অঞ্চলে আবারও করোনার রেকর্ড সংক্রমণের কারণে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এতে দরপতন ঘটছে শেয়ারবাজারে। তাই অস্থির এ সময়ে ব্যবসায়ীরা নিরাপদ হিসেবে সোনায় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, ডলার দুর্বল হওয়ায় এটিও সোনার দাম বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলছে। তৃতীয়ত, অর্থনীতি সুরক্ষায় অনেক দেশ বিপুল অঙ্কের প্রণোদনা দিচ্ছে, সেই সঙ্গে কমাচ্ছে সুদের হার। এর কারণেও সোনার দাম বাড়ছে। এছাড়া চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি বৃদ্ধি এবং মহামারী মোকাবেলায় নানা দেশের সরকারের আরও প্রণোদনা দেয়ার সম্ভাবনায় বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দর উর্ধমুখী বলে মনে করছেন অনেকেই। অর্থনীতিতে তারল্য সঞ্চারে ফেডারেল রিজার্ভ বাড়তি অর্থ সরবরাহ করলে মার্কিন মুদ্রা ডলারের দর কিছুটা কমবে। অথচ ডলার হচ্ছে, বিশ্ববাণিজ্যে লেনদেনের প্রধান মাধ্যম। এ অবস্থায় দুর্বল ডলার এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির ধীরগতির পুনরুত্থান মিলে স্বর্ণের বাজারমূল্য খুব দ্রুত ২৩০০ ডলার আউন্সে পৌঁছাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্স। দুর্লভ ধাতুর লেনদেনে বিনিয়োগের পরামর্শক সংস্থা স্প্রোট ইঙ্কের বাজার কৌশলবিদ পল ওং বলেন, ‘স্বর্ণের দর আরো উত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েই আছে। তাছাড়া ধীরগতির অর্থনৈতিক উত্তরণের পরিস্থিতি এবং তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রণীত সহায়ক ও নমনীয় মুদ্রানীতি; বিনিয়োগ উৎস হিসেবে স্বর্ণের চাহিদা বাড়াবে। কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের বাজারেও সোনার দাম বেড়েই চলেছে। অতীতে দেশের বাজারে সোনার দাম সাধারণত ভরিতে এক থেকে দেড় হাজার টাকা হ্রাস-বৃদ্ধি করা হতো। তবে এবার পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে শুরু করেছে সোনার দাম। দেশের বাজারে সোনার দাম তিন দফায় দেড় মাসেই বেড়েছে ১৩ হাজার টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে সর্বশেষ গত বুধবার রাতে আবারও বাড়ানো হয় স্বর্ণের দাম। মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে সব ধরনের সোনার দাম ৪ হাজার ৪৩২ টাকা বাড়িয়ে সবচেয়ে ভাল মানের সোনার দাম প্রতি ভরি উঠেছে ৭৭ হাজার ২১৬ টাকায়। দেশে এর আগে কখনই এত বেশি দামে সোনা বিক্রি হয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে গোল্ডের দাম। এমন অস্থির বাজার আমি আমার জীবনে দেখিনি। গোল্ডের দাম শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।’ পরিসংখ্যান দিয়ে আগরওয়ালা বলেন, সর্বশেষ গত ২৩ জুলাই বাজুসের পক্ষ থেকে সোনার দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্সের (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম, ২.৬৫ ভরি) দাম ছিল ১৮৯০ ডলার। বুধবার তা ২০৪২ ডলারে উঠেছে। অর্থাৎ এই ১২ দিনে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ১৫২ ডলার বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছুই করার নেই। বাধ্য হয়েই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে আমাদের স্থানীয় বাজারে দাম বাড়াতে হচ্ছে।’ দাম সামনে আরও বাড়ার আভাস দিয়ে তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারীতে সবাই এখন নিরাপদ বিনিয়োগ ভেবে গোল্ড কিনে মজুদ রাখছে। ফলে বুঝতে পারছি না, আন্তর্জাতিক বাজারে গোল্ডের দাম বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে ঠেকবে।’ আগরওয়ালা বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে ইউএস ডলারের প্রাধান্য খর্ব, জ্বালানি তেলের দর পতন এবং নানাবিধ অর্থনৈতিক সমীকরণের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের মূল্য ইতিহাসের সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থান করছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশীয় বুলিয়ন মার্কেটেও সোনার দাম বাড়ানো হয়েছে বলে তিনি জানান। এদিকে বৃহস্পতিবার থেকে সারা দেশে সোনার নতুন দর কার্যকর করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। এর আগে বুধবার রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৃহস্পতিবার থেকে ২২ ক্যারেটের এক ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) সোনার অলংকার (সবচেয়ে ভাল মানের সোনা) কিনতে লাগবে ৭৭ হাজার ২১৬ টাকা। বুধবার পর্যন্ত তা ৭২ হাজার ৭৮৩ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এ ছাড়া ২১ ক্যারেট ৭৪ হাজার ৬৬ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৬৫ হাজার ৩১৮ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির সোনার ভরি বিক্রি হবে ৫৪ হাজার ৯৯৬ টাকায়। বুধবার পর্যন্ত ২১ ক্যারেট ৬৯ হাজার ৬৩৪ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৬০ হাজার ৮৮৬ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির সোনা বিক্রি হয়েছে ৫০ হাজার ৫৬০ টাকায়। সোনার দাম বাড়লেও দেশে রূপার দাম অপরিবর্তিত থাকবে, ভরি ৯৩৩ টাকায়। জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সভাপতি এনামুল হক খান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে যে গতিতে বাড়ছে তাতে মনে হচ্ছে আপাতত সোনার দাম কমার সম্ভাবনা নেই। বরং আরও বাড়তে পারে।’ কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিম্নবিত্তরা তো আগে থেকেই সোনা কেনা বাদ দিয়েছেন। এখন মধ্যবিত্ত পরিবারেও নাগালের বাইরে চলে গেল এ ধাতব মুদ্রা। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে সোনা আমদানির ওপর শুল্ক ছাড় দেয়া হয় ভরিতে ১ হাজার টাকা। এছাড়া বছরে তিনবার ব্যাগেজ রুলের আওতায় ২৩৪ গ্রাম বা ২০ ভরি পর্যন্ত সোনা আনার সুযোগও দেয়া হয়। এজন্য প্রতি ভরির জন্য ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। আগে স্বর্ণবার আমদানিতে ৩ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হতো। এখন ২০ ভরি সোনার বার আনতে ৪০ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হয়। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে যোগ করা হয় আরও একটি বড় সুবিধা। চলতি অর্থবছরের শুল্ক সুবিধার সঙ্গে আগামী অর্থবছরের জন্য সোনা আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পুরোটাই প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। দেশে আমদানি উৎসাহিত করতেই এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে বাজেট বক্তব্যে বলা হয়েছে। এতে ভরিতে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা আমদানি খরচ কমবে বলেও মনে করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। এত সুবিধার পরও সোনা আমদানিতে আগ্রহ নেই ব্যবসায়ীদের। অথচ দেশে প্রতিবছর ২০ থেকে ৪০ টন সোনার চাহিদা রয়েছে। জানা যায়, ২০১৮ সালে সোনা আমদানি নীতিমালা চূড়ান্ত করে সরকার। সে মোতাবেক দেশে ১৮ প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পেলেও গত ৬ মাসে মাত্র ১টি কোম্পানি সোনা আমদানিতে এলসি খুলেছে। সম্প্রতি বৈধপথে ১১ কেজি সোনা আমদানি করা হয়েছে। ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের কর্ণধার দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, সোনা আমদানির সুযোগ দেয়া হলেও ভ্যাট বেশি হওয়ার কারণে আমদানি করতে আগ্রহ দেখায়নি অনেক ব্যবসায়ী। তবে এবারের বাজেটে ভ্যাট কমানোয় অনেকেই আমদানির উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান তিনি। আগরওয়ালা এ বিষয়ে বলেন, বাজেটে অর্থমন্ত্রী সোনা আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার পর পরই ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের পক্ষ থেকে দুবাই থেকে ১১ কেজি সোনা আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল। এটাই ৪৯ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশে বৈধপথে প্রথম সোনা আমদানি। এর মধ্য দিয়ে দেশের জুয়েলারি শিল্পের ইতিহাসে একটি সোনালি অধ্যায়ের সূচনা হলো। এতদিন যে গোল্ড আসত, তা অবৈধ পথে আসত। আর কিছু আসত ব্যাগেজ রুলসের আওতায়। এখন দেশে ‘গোল্ডনির্ভর’ শিল্প গড়ে উঠার প্রত্যাশা জানিয়ে আগরওয়ালা বলেন, কাঁচামাল আসা শুরু হলো, এখন এ খাত বিকশিত হবে।
×