ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নতুনরা যোগ দিচ্ছে ব্যবসায়

ইয়াবা পাচারের রুট বদল, নদীপথেই আসছে চালান

প্রকাশিত: ২২:১৬, ৭ আগস্ট ২০২০

ইয়াবা পাচারের রুট বদল, নদীপথেই আসছে চালান

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রুট পরিবর্তন করেছে ইয়াবা পাচারকারীরা। তারা সড়কের পরিবর্তে নদীপথ বেছে নিয়েছে। দশ বছর ধরে তারা কক্সবাজার থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী ও বরগুনার নদীপথে ইয়াবার চালান আনছে। তবে বিগত দুই বছর ধরে এটিকেই ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করছে মাদক পাচারকারীরা। সাঁড়াশি অভিযানের মুখে তিন শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ীর বিশাল একটি দল আত্মসমর্র্পণ করলেও ইয়াবা ব্যবসা থেমে নেই। নতুন নতুন মাদক ব্যবসায়ীরা ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অভিনব কায়দায় লাখে লাখে ইয়াবার চালান আনছে তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মোতাবেক মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। চলমান সেই যুদ্ধের দুই বছর পার হলেও তেমন সফলতা আসেনি। র‌্যাব বলছে, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গীর মতো মাদক নির্মূলের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি মাদকের সঙ্গে সরকারদলীয় কেউ জড়িত থাকলে তাকে স্থায়ীভাবে দল থেকে বহিষ্কার করার নির্দেশ দেন। এর পর থেকেই মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যার সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে র‌্যাব। সারাদেশে মাদক বিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চলছে। অভিযানে এ পর্যন্ত মাদকের সঙ্গে জড়িত ৫০ হাজারের বেশি ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে দুই কোটির বেশি ইয়াবা। পাশাপাশি অন্যান্য মাদক তো আছেই। র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ভ্রাম্যমাণ আদালত মাদক বিরোধী প্রায় চার হাজার অভিযান চালিয়েছে। অভিযানে প্রায় ১২ হাজার ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। অর্থদণ্ড করা হয়েছে প্রায় ১৪ কোটি টাকা। সাঁড়াশি অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে এখন পর্যন্ত ২৪৫ জনের বেশি পেশাদার মাদক কারবারি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে পাঁচ শতাধিক। ধারাবাহিক অভিযানের সময় কক্সবাজার ও কুষ্টিয়ায় তিন শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করে। এতে ইয়াবা চোরাচালান কমে যাওয়ার আশা করা হলেও তা হয়নি। চাহিদা বেশি থাকায় নতুন নতুন মানুষ ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যেই সরকার মাদককে দেশের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে আইন পর্যন্ত সংশোধন করেছে। দুই শ’ গ্রাম ওজনের বেশি পরিমাণ ইয়াবা বা হেরোইনসহ গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির সাজা যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। শুধু র‌্যাবের অভিযানেই শতাধিক মাদকের আখড়া গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আর পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর মিলে শতাধিক মাদকের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। মাদকের আগ্রাসন ঠেকাতে জল ও স্থল সীমান্ত পয়েন্টে এবং দেশের ভেতরে একযোগে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। এমনকি সরকারের তরফ থেকে ইয়াবা তৈরির অন্যতম প্রধান উপকরণ সিওড্রএফিড্রিন আমদানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কাশির ওষুধ তৈরিতে বিকল্প রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে। কোস্টগার্ড সূত্র বলছে, নাফ নদী দিয়ে মাছ ধরার সময় বেশি ইয়াবা আসার কারণে ওই নদীতে মাছ ধরা পরীক্ষামূলকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছিল। তাতে তেমন কোন কাজ হয়নি। কারণ মাছ ধরার ট্রলারগুলোর নিচে রশি বাঁধে। সেই রশির মাথায় ইয়াবা পলিথিনে মুড়িয়ে পানিতে ডুবিয়ে আনে মাদক কারবারিরা। শত শত ট্রলার চেক করা স্বাভাবিক কারণেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে ইয়াবা চোরাচালান সেভাবে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। দেশে নকল ইয়াবা তৈরি বন্ধ করতে মাদকটি তৈরির অন্যতম প্রধান উপকরণ সিওড্রএফিড্রিন আমদানি বন্ধ করে দেয়া হয়। কাশির ওষুধ তৈরিতে বিকল্প রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয় ওষুধ কোম্পানিগুলোকে। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম বলছেন, সড়কের পরিবর্তে নদীপথ বেছে নিয়েছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। প্রায় দশ বছর ধরে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা কক্সবাজার থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী ও বরগুনার নদীপথে ইয়াবার চালান আনছে। যার মধ্যে গত দুই বছরে তাদের হাতে বেশ কয়েকটি বড় চালান ধরা পড়েছে। গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, বর্তমানে ওই রুটেই ইয়াবার বড় বড় চালান আসছে। ইয়াবা ব্যবসায়ীর বিশাল একটি দল আত্মসমর্পণ করলেও ইয়াবা ব্যবসা থেমে নেই। তবে কমেছে। নতুন নতুন ব্যক্তি নতুন করে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম জানান, সম্মিলিত তৎপরতার কারণে বিগত কয়েক বছরের তুলনায় হালে মাদক চোরাচালান অনেক কম হয়েছে। মিয়ানমার থেকে যাতে মাদক দেশে প্রবেশ করতে না পারে এজন্য মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি দ্রুত গতির জলযান কেনা হয়েছে; যা মাদক প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা ও অপারেশন্স শাখার পরিচালক পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এ এস এম মাসুম রাব্বানী বলছেন, কয়েক শ’ চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ীর আত্মসমর্র্পণ করার পর স্বাভাবিকভাবেই মাদকের আগ্রাসন কমে আসার আশা করা হয়েছিল। দেশে মাদকের আগ্রাসনের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করা হয়েছিল, ততটা পড়েনি। মাদকের আগ্রাসন বন্ধ হয়নি। তবে অনেকাংশে কমেছে। সারাদেশে তাদের সাঁড়াশি অভিযান চলমান আছে। দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। আর অনিয়মিত মাদক সেবীর সংখ্যা আরও প্রায় এক কোটি। তিনি আরও জানান, ধর্ষণ, ধর্ষণপরবর্তী হত্যা, খুন, হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি চালানো, ছিনতাইসহ এ ধরনের অধিকাংশ অপরাধের সঙ্গে কোন না কোনভাবে মাদকের সংশ্লিষ্টতা থাকে। দেশে সংঘটিত মোট অপরাধের মধ্যে শতকরা আশিভাগের সঙ্গেই কোন না কোনভাবে মাদকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক) মাহবুব আলম বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার হওয়া মাদক ব্যবসায়ীর অধিকাংশই পরবর্তীতে জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। তারা আবার মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। ফলে গ্রেফতার হলেই যে মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছে, এমনটা নয়। চাহিদা বেশি থাকায় মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অনেক মাদক ব্যবসায়ী আবার মাদকের পাশাপাশি অস্ত্র-গোলাবারুদ ও জাল মুদ্রার ব্যবসা করে। পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, আমারা মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। আগের তুলনায় মাদক চোরাচালান কমলেও পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। মাদক নির্মূলে তিনি সকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্মিলিত চেষ্টার পাশাপাশি দেশবাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিভাগের সাবেক প্রধান এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ বলছেন, অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, তারা এক সময় ইয়াবা, হেরোইন বা মারাত্মক সব মাদকে আসক্ত ছিলেন। ইয়াবা সেবনে লিভার, কিডনি, হার্ট ও মস্তিষ্ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। দীর্ঘ সময় ইয়াবা সেবনের কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যায়। শরীর শুকিয়ে যায়। শরীরের সৃষ্ট ঘা থেকে ক্যান্সারের সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ মাদকাসক্তেরই শেষ পরিণতি অকালমৃত্যু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলছেন, মাদক একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এই ব্যাধি দূর করতে না পারলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। সমাজ ও সংস্কৃতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
×