ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিশীথ দাস

মুহাম্মদ সামাদের কবিতায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ২০:৩৬, ৭ আগস্ট ২০২০

মুহাম্মদ সামাদের কবিতায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ

কবি মুহাম্মদ সামাদ ১৯৮৩ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একজন রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো’ প্রকাশের মাধ্যমে তার তেজোদীপ্ত আওয়াজ ছড়িয়ে দেন। এ গ্রন্থের এ শিরোনামের কবিতায় তিনি একজন রাজনৈতিক নেতার বক্তৃতার আঙ্গিকে বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী পরিস্থিতি তুলে ধরেন। এখানে অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা দখলকারীদের রাজনৈতিক মুখোশ উন্মোচন বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কবি অপশাসনের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্র‍ুপ প্রকাশ করেন। আর অতি সূক্ষ্মতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রতি করেন শ্রদ্ধা প্রদর্শন। বাঙালীর মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে পাকিস্তানের অমানবিক নির্যাতন থেকে মুক্ত করেন। মুহাম্মদ সামাদ একজন জীবনবাদী কবি। তিনি জনজীবনে বিশ্বাসী। আর তিনি জীবনের রঙকে বিন্যাস করেন সময়ের মানদণ্ডে। সূক্ষèভাবে উপলব্ধি করতে পারেন মানুষকে ও তাদের আন্দোলিত চেতনাকে। এ সত্যকে ধারণ করে তিনি এগিয়ে যান। যখনই কোনো অন্যায় প্রত্যক্ষ করেন তখন তিনি গর্জে ওঠেন। তাই জীবন ও ইতিহাসের প্রতি তার রয়েছে গভীর পর্যবেক্ষণ ও শ্রদ্ধাবোধ। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তিনি বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনের আলোকে দেখাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তিনি যেহেতু পুরদস্তুর কবি তাই কবিতার প্রতি রয়েছে তার সীমাহীন ভক্তি। তার মননে স্বদেশপ্রেম ও মুজিবের আদর্শ। তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেহের রক্তকণায় ধারণ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। দেখেছেন বিভীষিকাময় নানা ঘটনা। এদেশকে কুক্ষিগত রাখতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। যা তার হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করেছে। মুহাম্মদ সামাদ বঙ্গবন্ধুর প্রতি অগাধ প্রেম ও শ্রদ্ধার নিদর্শন জ্বালিয়েছেন তার কবিতার মর্মে। বঙ্গবন্ধুকে তিনি খাঁটি দেশপ্রেমিক হিসেবে স্বীকার করেন। যার উচ্চতা মাপা সম্ভব নয় অর্থাৎ যার উচ্চতা আকাশের চাইতেও বিশাল। বঙ্গবন্ধু কী ই না করতে পারতেন, তিনি ইচ্ছা করলে নিজে ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করে আরাম-আয়াশে সারা জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে সব রকম নিপীড়ন সয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেকে বলি দিয়েছেন। তাই কবি বঙ্গবন্ধুকে আঁকতে চেয়েছেন কলমের রেখায় যেখানে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্নায়ুবিক অসীম সাহসিকতা, ধৈর্য, মানবতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা আর অন্যদিকে ৬ দফা, ৭ মার্চ প্রভৃতির মতো কালজয়ী ইতিহাস। মুহাম্মদ সামাদের কবিতায় সেই ইতিহাসকে দেখতে পাই। যে ইতিহাস বর্ণনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত নিজের চেতনাবোধের বিন্যাস ঘটিয়েছেন। তাই কবি বলেন- মুজিব আমার পরশপাথর পবিত্র নিষ্পাপ মুজিব আমার বাংলাজুড়ে একটি লাল গোলাপ। (মুজিব) মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভের পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) তীব্র কণ্ঠে উচ্চারণ করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই দিন থেকেই বাঙালীর মনে তীব্র সাহস-শক্তি সঞ্চার হতে থাকে। তারা ভীরুতা, পিছপা হওয়ার অভ্যাস কিংবা সংগ্রামে অংশগ্রহণের অনাকাক্সক্ষা পরিত্যাগ করে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে তুমুলভাবে গর্জে ওঠে। কবি মুহাম্মদ সামাদ বলেন, আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধের অবদানে যে শুধু মানুষের অস্তিত্ব রয়েছে তাও নয়। এক্ষেত্রে প্রকৃতির অসংখ্য উপাদানের মতো যৌবনবতী নদীরও অস্তিত্ব রয়েছে। কারণ এই নদীর জলই পাক হানাদারের বিপক্ষে মুুক্তিযুদ্ধের রসদ যুগিয়েছে। এ যুদ্ধে মাঠের কৃষক, গৃহবধূ, তরুণ-তরুণী, দুরন্ত কিশোর অংশগ্রহণ করে। যদিও হানাদারের তাণ্ডবলীলায় গ্রামের পর গ্রাম জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়। নিরীহ মানুষের বুকে চলে বেয়নেটের আঘাত। তাদের এই ভয়াবহতায় নির্বিকার হয়ে পড়ে অবোধ পশুপাখিরাও। এর মধ্য দিয়েও বাঙালীরা বঙ্গবন্ধুর তেজোদ্দীপ্ত উচ্চারণ ভোলেননি। কেননা অতীত থেকে বাঙালীর পাশে থাকা বঙ্গবন্ধু নানা সময়ের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলার সাধারণ জনতাকে ঐক্যবদ্ধের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি হয়েছিলেন বাঙালীর আস্থাভাজন। তার যথাযথ দিকনির্দেশনার ফলেই বাঙালী অর্জন করে এই দেশ আর স্বাধীন একটি পতাকা। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকে কেন্দ্র করে কবি বলেন- ৭ মার্চ রেসকোর্সে উত্তাল জনসমুদ্রে বাঙালীর সিংহহৃদয় নেতা ঘোষণা করলেন- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম... (মুক্তিযুদ্ধগাথা) ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তার ৩২ নাম্বারের বাড়িতে। আর তার হত্যার মধ্য দিয়ে সেনা শাসন কায়েম হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যে উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ গড়তে চেয়েছিলেন সেখানে চীর ধরে যায়। মূলত তার হত্যার মধ্য দিয়ে দেশকে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার দীর্ঘদিন পরও বিচার তো সংঘটিত হয়নি বরং উল্টো মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের সরকার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয় দিয়ে, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে সহায়তা করে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের মাধ্যমে দেশে কলঙ্কের দাগ মুছে যাক- এমনটা কখনো তারা চাননি। ফলে এ বিচার কার্য দীর্ঘদিন ধরে এক প্রকার সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়। তাই কবি বেদনার্ত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে আমজনতা সবাই যেহেতু ভালোবাসতেন এ কারণে তার বেদনার ছাপ তিনি সবার মাঝে দেখতে পেয়েছেন। এ জন্য তিনি আজ অশ্রুসিক্ত। অবশেষে বঙ্গবন্ধু হত্যার ২৩ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের হত্যার বিচার করে। এতে কবির বেদনা খানিকটা হলেও প্রশমিত হয়ে যায়। যা কবি কবিতায় উচ্চারণ করেন এভাবে- পিতা, তোমার পাইপ চৌচির চশমা গুলিবিদ্ধ লাল পাঞ্জাবি প্রিয় চিত্রল হরিণ গাভীর সজল চোখ আদরের পায়রারা তোমার রবীন্দ্রসংগীত বিদ্রোহী কবিতা তোমার টুঙ্গিপাড়া তোমার বত্রিশ নম্বরের রক্তধারা আজ প্রার্থনারত (পিতা, আজ আমাদের শাপমুক্তি) দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের অধিকার ও ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে তারা নিজেদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে এদেশের মানুষের ওপর অত্যাচার চালায়। যার ফলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন এই ডাক যদি এ সময় না দেওয়া হয় তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে আরও বেগ পেতে হবে। এমন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কথা একদম কবি ভুলে যাননি। তাই তিনি বলেন- পাখির পাখায় হাওয়ায় হাওয়ায় গাঁয়ে গঞ্জে মাটিতে পাহাড়ে পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে উথাল ঢেউয়ে ছাব্বিশে মার্চ শেখ মুজিবের ডাক আসে: (স্বাধীনতার সূর্য ওঠে) মুহাম্মদ সামাদের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো আমার দু’চোখ জলে ভরে যায়, আজ শরতের আকাশে পূর্ণিমা, চলো তুমুল বৃষ্টিতে ভিজি, পোড়াবে চন্দন কাঠ, আমি নই ইন্দ্রজিৎ মেঘের আড়ালে, প্রেমের কবিতা, সিলেকটেড পোয়েমস প্রভৃতি। তার কবিতা অনূদিত হয়েছে ইংরেজী, সুইডিশ, গ্রিক, চীনা, সার্বিয়ান, হিন্দী, সিনহালি প্রভৃতি ভাষায়। তিনি সিটি আনন্দ-আলো পুরস্কার, সৈয়দ মুজতবা আলী সাহিত্য পুরস্কার, কবি সুকান্ত সাহিত্য পুরস্কার, কবি জীবনানন্দ দাশ পুরস্কার, কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার, ত্রিভুজ সাহিত্য পুরস্কার, কবিতালাপ পুরস্কার এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে কবি বিষ্ণু দে পুরস্কার ও প্রথম আলো পুরস্কার প্রভৃতি লাভ করেন। তিনি চীনের ইন্টারন্যাশনাল পোয়েট্রি ট্রানসেলেশন এ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার কর্তৃক ঘোষিত প্রাইজেস ২০১৮ : ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট পোয়েট হিসেবে মনোনীত হয়েছেন।
×