ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল কালাম আজাদ

মতলববাজদের উদ্দেশ্য কী?

প্রকাশিত: ১৯:০৪, ৭ আগস্ট ২০২০

মতলববাজদের উদ্দেশ্য কী?

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া সুধাসদনে যান। তার সঙ্গে মওদুদ আহমদসহ অন্য নেতারা ছিলেন। কিছুক্ষণ নিচে বসার পর বেগম জিয়া দোতলায় যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য। তারা বেশ কিছুসময় আলাপ আলোচনা করেন। ঘটনাটি ২০০৯ সালের মে মাসের। ডা. জাফরুল্লাহ্র একটি খোলা চিঠিকে কেন্দ্র করে ড. মাহবুব উল্লাহ্র ‘প্রধানমন্ত্রী আমলে নেবেন কিনা জানি না’ শীর্ষক লেখাটি ছাপা হয় একটি দৈনিকে। মাহবুব উল্লাহ লিখেছেন ‘শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় তখন শেখ হাসিনা তার সঙ্গে দেখা করেননি।’ ড. মাহবুব উল্লাহ্ সুকৌশলে বলেছেন ওপরের কথাগুলো বিএনপির নেতা-কর্মীদের। নিজের বক্তব্য বিএনপির নেতা-কর্মীদের কাঁধে চাপিয়ে দিলেন। তিনি তার লেখায় বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আর শেখ হাসিনা বলে সম্বোধন করেছেন। তাঁর নামের আগে কিছু নেই। ঐ সময় খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী নন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে খালেদা জিয়ার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি। অথচ মাহবুব উল্লাহ বলে দিলেন, দেখা হয়নি। অনেকেই হয়তো তার এ বক্তব্যকে ডাহা নির্জলা মিথ্যা মতলবী বক্তব্য বলবেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ শব্দগুলো পছন্দ করি না। তার বেলায় প্রয়োগও করতে চাই না। তবে তিনি জেনে শুনেই এই তথ্য বিকৃত করেছেন। তিনি কোন কিছু জানেন না বা ঘটনা সম্পর্কে অবহিত নন তা কেউ বিশ্বাস করবে না। তিনি এটি কেন করলেন? ২০০৯ সালের ঘটনা। তখন যেসব ছেলেমেয়ের বয়স ১০/১২, এখন তারা যুবক সম্প্রদায়। এ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার জন্য ইতিহাস বিকৃতি। প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা এদের মজ্জাগত। তিনি কি কারণে বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করলেন জানি না। উদ্দেশ্য ছাড়া তারা কথা বলেন না বা লেখেন না। তারা অতি চতুরতার সঙ্গে লেখা বা কথায় বিষ ঢেলে দেন, যা আমাদের অনেকের পক্ষে উপলব্ধি করাও কঠিন হয়ে যায়। এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনা মনে পড়ল। মাহমুদুর রহমান মান্না ২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে অবস্থানরত বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকাকে (প্রয়াত) ফোন করেন। ফোনে তিনি শেখ হাসিনার সরকার পতনের লক্ষ্যে আন্দোলন চাঙ্গা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪/৫টি লাশ ফেলে দেয়ার ব্যবস্থা করার জন্য বলেন। ফোনালাপে বলেন সরকারের পতন ঘটাতেই হবে। প্রয়োজনে সামরিক শাসন। আরও অনেক কথা আছে। দীর্ঘ ফোনালাপ। এটি গণমাধ্যমে চলে আসে। তখন এ নিয়ে টিভি টকশো হয়। পত্রপত্রিকায় নিউজ, আলোচনা তো ছিলই। মাছরাঙা টিভিতে একটি টকশোতে আমি আমন্ত্রিত ছিলাম। আর ছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং ড. মাহবুব উল্লাহ। সঞ্চালক ছিলেন মৌ। আলোচনার এক পর্যায়ে মান্না সাহেবের ভিডিও প্রদর্শন করে মতামত চাওয়া হয়। ড. মাহবুব উল্লাহকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তিনি স্পষ্ট করে কিছু বোঝেননি। তখন আমি বলেছিলাম, আমাদের দুর্ভাগ্য একশ্রেণীর পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী নিজেদের পছন্দের বাইরে গেলেই আর কিছু বোঝেন না। সঞ্চালক বুঝলেন, মকসুদ ভাই বুঝলেন, আমি বুঝলাম অথচ মাহবুব উল্লাহ মান্নার কথা বুঝলেন না। জিয়া-মোশতাক খুনীচক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে যান তাঁর সুযোগ্য দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের পরম আদরের ১০ বছরের শিশু পুত্র রাসেলকেও রেহাই দেয়নি। সেই কালরাতে শাহাদাত বরণ করেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, শেখ জামাল, তাদের স্ত্রীদ্বয় সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরসহ আরও অনেকে। খুনীদের জিয়া-খালেদা সযত্নে লালন পালন করেছে। বিদেশী দূতাবাসে চাকরি দিয়েছে। সংসদে আইন করেছে বিচার না করার জন্য। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২১টি বছর ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রবাহিত করেছে ভিন্ন খাতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঈদের দিন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব দিয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ। বলেছেন তাতে শেখ হাসিনার বিরাট রাজনৈতিক সুবিধা আদায় হবে। মাহবুব উল্লাহ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা বলবেন আসামির সঙ্গে দেখা করবেন কেন? প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক সুবিধা দিতে চান কে, জাফরুল্লাহ? যিনি শেখ হাসিনা এবং তার দলকে পরাজিত করার জন্য জামায়াত-বিএনপিকে নিয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা। ভণ্ডামীর একটা মাত্রা থাকা উচিত। ডা. জাফরুল্লাহ টিভি টকশোতে বঙ্গবন্ধুর খুনী রাশেদ চৌধুরী অথবা নূরকে ক্ষমা করে দিতে বলেন। পরে জানা গেল ঐ খুনীরা তার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। ড. মাহবুব উল্লাহ ঠিকই বলেছেন, আসামির সঙ্গে কেন দেখা করতে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা? আর এই আসামি সেই আসামি, যিনি বঙ্গবন্ধুর খুনীদের আশ্রয় প্রশয় দিয়েছেন সারা জীবন। বঙ্গবন্ধুর খুনী খায়রুজ্জামানকে (সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত) রাষ্ট্র্রদূত বানিয়েছেন। অপর খুনী সেনাবাহিনীর আজিজ পাশাকে জিম্বাবুইয়েতে মারা যাওয়ার পর তাকে পদোন্নতি দিয়ে সমুদয় পাওনা পরিবারকে দিয়েছেন। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সরকারের জ্ঞাতসারে হাওয়া ভবনে তারেক জিয়ার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। আল্লাহর অশেষ রহমত ও জনগণের দোয়ায় সে যাত্রায় তাঁর জীবন রক্ষা পায়। গ্রেনেড হামলার পরপরই প্রচার করা হয় শেখ হাসিনার হাতব্যাগ থেকে এ গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছে। পরে শুরু হয় জজ মিয়া নাটক। দেশবাসীর এখনও মনে আছে সেসব ঘটনা। শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বিভিন্ন সময়ে কমপক্ষে ২১ বার চেষ্টা করা হয়। কারা এই হামলার অপচেষ্টা চালিয়েছে, এখন আর তা কারও অজানা নেই। খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ মানবিক কারণে তাকে ৬ মাসের জন্য মুক্তি দেয়া হয়েছে। মাহবুব উল্লাহ তার লেখায় প্রশ্ন রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মুক্তি দিতে পারেন কিনা? যদিও পরে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কোকো মারা যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুলশানে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে গিয়েছিলেন, তাঁকে সহানুভূতি জানাতে। খালেদা জিয়া তখন কার্যালয়েই ছিলেন। গাড়ি ঢোকার বড় গেটটি সঙ্গে সঙ্গে তালা মেরে দেয়া হয়। খালেদা জিয়ার নির্দেশ ছাড়া তার কোন স্টাফের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব ছিল না। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন গাড়ি ছাড়া হেঁটেই রওয়ানা দিলেন তখন ছোট গেটও তালা মেরে দেয়া হয়। খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী, থাকতেন সেনানিবাসে। অনেক সময় সিএমএইচে চিকিৎসাধীন সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের দেখতে গেলে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার গাড়ি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ঢুকতে দেয়া হতো না। জাহাঙ্গীর গেট থেকে সিএমএইচ পর্যন্ত দীর্ঘ পথ তাকে হেঁটে যেতে হতো। এসব আচরণ মতলববাজরা ভুলে যেতে পারে, দেশবাসী ভোলেনি। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত দিবস ১৫ আগস্ট। এ দিবসটিতে যাতে শোক পালন করা না যায়, বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করা না যায়, সেজন্য আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হয় ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার ভুয়া জন্মদিন পালন করে। তার ৪/৫টি জন্মদিনের একটি নির্ধারণ করা হয় ১৫ আগস্ট। খালেদা জিয়া কি জানতেন না এটি তার আসল জন্মদিন নয়? তিনি তো কেক কেটে উৎসব করেছেন ঠিকই। কতটা নিষ্ঠুর, অমানবিক। কল্পনারও অতীত। সদ্যপ্রয়াত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমেদ এ ভুয়া জন্মদিনের আবিষ্কারক। তাকে সহায়তা করেছেন খালেদা জিয়ার একসময়ের প্রেস সেক্রেটারি মরহুম মোজাম্মেল হক এবং অনেকে। আমার প্রশ্ন খালেদা জিয়া তো থামিয়ে দিতে পারতেন তাদের এ অন্যায় অমানবিক কাজ থেকে বিরত রাখতে, করেননি। আর আজ তার সাথেই দেখা করতে যেতে হবে জাফরুল্লাহ সাহেবদের পরামর্শে? আহারে আবদার কাকে বলে! তিনি আর একটি তত্ত্ব হাজির করেছেন তা হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। ব্যক্তি শেখ হাসিনার সমালোচনা করা যায়। আমার বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ব্যক্তি। তা সত্ত্বেও সরকার পরিচালনার কারণে ভুলভ্রান্তি হতেই পারে। সে কারণে প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করা যায়। ব্যক্তি শেখ হাসিনা, অত্যন্ত সম্মানিত, মমতাময়ী, ধর্মভীরু, মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর মেধা, শ্রম কর্তব্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়নতা, সততা ঈর্ষণীয়। তাঁর দূরদৃষ্টি, প্রজ্ঞা মানুষের জন্য মমত্ববোধ অতুলনীয়। তাঁর প্রজ্ঞা ও মেধা দিয়ে ইতোমধ্যেই তিনি বিশ্ব পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন। বিশ্ব নেতাদের সমীহ আদায় করেছেন। বিশ্ব নেতারা তাঁকে মমতাময়ী মা উপাধি দিয়েছেন। খোলাচিঠির লেখক ও ড. মাহবুব উল্লাহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের ওপর নির্ভর করতে বারণ করেছেন। একজন সাংবাদিক হিসেবে কেন যেন আমার মনে হয়, এ খোলাচিঠি মাহবুব উল্লাহর লেখা একটি গভীর চক্রান্তেরই অংশ। তা না হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দূরে রাখতে কেন বলা হবে? যারা জীবন বাজি রেখে জঙ্গী সন্ত্রাসীদের দমনের কাজে নিয়োজিত থাকে! দুর্নীতিবাজদের এবং অন্য সমাজ বিরোধীদের বিষয়ে তথ্য দিয়ে গোয়েন্দারা সরকারকে সাহায্য করে। আমলারা নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। সাম্প্রতিক করোনারোধে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহের সদস্য, আমলা, গোয়েন্দারা যেভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। তাদের সদস্যদের বহু সংখ্যকের প্রাণহানিও ঘটেছে। তাহলে কি কারণে তাদের দূরে রাখতে বলেছেন। সরকারের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি করার উদ্দেশ্য কি?- একথা ভেবে দেখা দরকার। লেখক : প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা
×