ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ আবে যমযমের উপকারিতা

প্রকাশিত: ১৯:০১, ৭ আগস্ট ২০২০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ আবে যমযমের উপকারিতা

আবে যমযম অর্থাৎ যমযমের পানি সবার কাছে পরিচিত। যমযম কূপের উৎপত্তি হয় কিভাবে তাও সবার জানা। এ কূপ মক্কা মুকাররমায় বিশ্ব মুসলিমের কেবলা কাবা গৃহের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্থাপিত হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরের অদূরে অবস্থিত। এ কূপের গভীরতা ১৪০ ফুট। এ কূপের পানির উৎস সাফা ও মারওয়া পাহাড় এবং কাবা গৃহের তলদেশ হতে উৎসারিত হয়ে প্রচণ্ড বেগে অজস্র ধারায় অনবরত এ কূপে এসে পড়েছে। যে কারণে এর পানি যতই উত্তোলন করা হোক না কেন কখনই কমে না বরং কখনও কখনও বৃদ্ধি পায়। জানা যায় ৯০৯ খ্রিস্টাব্দে এর পানি উপচিয়ে কাবা চত্বরে বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে হাজীদের কাবা শরীফ তওয়াফের সুবিধার্থে এ মুবারক কুটির ওপর আচ্ছাদিত করায় আন্ডার গ্রাউন্ড রয়েছে এবং মসজিদুল হেরেমের দেয়াল পাত্রে অসংখ্য কল বসিমে হাজীদের পানি পান করার জন্য এর থেকে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়াও এ কূপ থেকে পাইপযোগে প্রিয়নবী (স)-এর জন্মগৃহ মাত্তুলিদুন্নবী (সা)-এর নিকটে একটি কূপ নির্মাণ করে তাতে যমযমের পানি দিয়ে ভরপুর করা হয়েছে। ফলে সহজেই ভিড় এড়িয়ে সেখান থেকে যমযমের পানি নেয়া যায়। হযরত ইব্রাহিম খলীলুল্লাহ (আ) তাঁর স্ত্রী হাজেরা (আ)-কে তাঁর নবজাতক পুত্র ইসমাঈল (আ) সহ মক্কার জনমানব শূন্য বিরান উপত্যকায় রেখে যান। তিনি তাঁদের জন্য এক ব্যাগ ভর্তি খেজুর এবং পুরনো চামড়ার তৈরি পানির ব্যাগ ভর্তি পানি দিয়ে যান। তাঁদের এ নির্জন স্থানে রেখে ইবরাহিম (আ) যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন হযরত হাজেরা আলায়হাস সালাম তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি এই বিরান ভূমিতে রেখে কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বার বার এই কথা বলেছিলেন, কিন্তু হযরত ইব্রাহিম (আ) তাঁর কথায় কর্ণপাত করছিলেন না। তখন হযরত হাজেরা (আ) বললেন, আল্লাহ কি আপনাকে আমাদের এখানে রেখে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন? হযরত ইব্রাহিম (আ) বললেন : হ্যাঁ। এ কথা শুনে হযরত হাজেরা (আ) বললেন, তাহলে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন। হযরত ইব্রাহিম (আ) যে খেজুর ভর্তি বস্তু ও ব্যাগ ভর্তি পানি দিয়ে গিয়েছিলেন তা কিছু দিনের মধ্যেই ফুরিয়ে গেল। একদিন পিপাসায় কাতর হয়ে শিশু ইসমাইল কাঁদতে লাগলেন। পাগলিনীর মতো মা হাজেরা (আ) একটি জয়তুন গাছের নিচে শিশুটিকে বসিয়ে রেখে সাফা মারওয়া পানির খোঁজে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন কিন্তু কোথাও তিনি পানি পেলেন না। সাতবার দৌড়ানোর পর হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন তাঁর শিশু পুত্র ইসমাইলের পায়ের দিকে ঝিরঝির করে পানি বয়ে যাচ্ছে। তিনি দ্রুত পাহাড় থেকে নেমে এসে সেই বয়ে যাওয়া পানি থেকে দুই হাত ভরে পানি তুলে শিশুকে পানি পান করালেন এবং নিজেও পান করলেন। পানি প্রবাহ এত বেগে উঠছিল যে তিনি তা ঠেকানোর জন্য পাথর কুড়িয়ে এনে তার চারদিকে বেঁধে ফেললেন, ফলে সেখানে কূপের সৃষ্টি হলো। কূপটি অফুরন্ত পানির কূপে পরিণত হলো। যমযম মানে প্রচুর পানি আর যামযামা অর্থ হলো অল্প অল্প ঢোকে পান করা। এই কূপকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে এখানে জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে। এ কূপের উদ্ভবের কিছুকাল পরে আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম (আ) কাবাগৃহ পুনর্নির্মাণ করেন। এ কাজে তাকে সাহায্য করেন তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ)। তখন তাঁর বয়স ছিল প্রায় ১১ বছর। যমযম কূপ কয়েক হাজার বছর পর অদৃশ্য হয়ে যায়। পরে এটাকে পুনরায় খনন করে হযরত মুহম্মদ (সা)-এর দাদাজান আবদুল মুত্তালিব। তিনি স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হয়ে পুনরায় এ মুবারক কূপটি স্থাপন করেন। যমযমের আরও কয়েকটি নাম রয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : বাররাহ অর্থাৎ বহু উপকারী আল-মাদনুনাহ অর্থাৎ স্বতন্ত্র, সাফিয়া, শরাবুল আবরার বুশরা ‘আউনা প্রভৃতি। এ কূপের খ্যাতি প্রাচীনকালেও বিশ্বজুড়ে ছিল। পারসিকরা এই কূপ দর্শনে এসে একে ঘিরে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করত। আইয়ামে জাহিলিয়াতে নানা রকম মানত করে এই কূপের ভেতর অর্থকড়ি, সোনার আসবাব, সোনার গহনা এতে ফেলে যায় ফলে এটা কালক্রমে ভরাট হয়ে যায়। আব্দুল মুত্তালিব এর থেকে দুটি সোনার তৈরি হরিণ, কালইয়া তরবারি, বেশ কিছু বর্ম এবং প্রচুর মুদ্রা বের করেছিলেন। যমযমের পানি অতি পবিত্র ও বরকতময়। এতে প্রচুর খাদ্যপ্রাণ, জীবনীশক্তি, রোগ নিরাময়ের শক্তি রয়েছে বা পৃথিবীর অন্য কোন পানিতে নেই। এর গুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে বহু হাদিস রয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, এর পানি সরবরাহ কখনও নিঃশেষিত হতো না। এ সম্পূর্ণ পুষ্টিদায়ক ও রোগ নিরাময়ক। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘যে নিয়তে পানি পান করা যায় আল্লাহ তা পূরণ করেন।’ (ইবনে মাজাহ) মুসলিম শরীফে আছে, ‘হযরত আবু যর গিফারী (রাদি) মক্কা শরীফে এসে পূর্ণ এক মাস শুধুমাত্র আবে যমযমের পানি পান করে কাবা চত্বরে অবস্থান করেছিলেন। যার ফলে তার দেহের ওজন বৃদ্ধি পায় এবং তিনি কখনও ক্ষুধার্ত হননি।’ অতি সাম্প্রতিককালের একটি ঘটনা। রিয়াদ থেকে দারুস সালাম প্রকাশনা কর্তৃক ২০০২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এবং বেশ কয়েকজন স্কলার দ্বারা সম্পাদিত হিস্টরি অব মক্কা প্রকল্প বিধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে : মরক্কোর লায়লা নামের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হন। তিনি আল্লাহর ইবাদত বন্দেগিতে অবহেলা করতেন। তার সুন্দর স্বাস্থ্য ও রোগের জন্য অহঙ্কার করতেন। তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য কালোজিরা খান। সেখানকার বিশেষজ্ঞরা বলেন : তার ব্রেস্ট রিমুভ করা ছাড়া এবং কেমোথেরাপি দেয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। কেমোথেরাপি প্রয়োগ করলে তার মাথার চুল পড়ে যাবে এবং চিবুকে দাড়ি গজাতে পারে। তাকে নখ ও দাঁতও হারাতে হতে পারে। তিনি এ চিকিৎসা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ৬ মাসের মধ্যেই তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায় এবং ওজন দারুণ কমে যায়। সারা দেহে দারুণ যন্ত্রণা শুরু হয়। আবার তিনি আলজিয়ায় যান ও ডাক্তারগণ তার স্বামীকে জানান যে, রোগ ফুসফুসসহ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় কোন ওষুধেই তার কাজে আসবে না। তার রোগীকে দেশে নিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। মরণ যখন তখন আসতে পারে। তার স্বামী যখন ভাবলেন যে, আমাদের ওপর হজ করা ফরজ হয়ে গেছে, অথচ এখনও হজ করিনি, আল্লাহকে ভুলে গেছি। তিনি তার মুমূর্ষু স্ত্রীকে নিয়ে মক্কা শরীফ গেলেন। কাবা শরীফ দর্শন করার সঙ্গে সঙ্গে তার স্ত্রী কাঁদতে লাগলেন এবং রোগ থেকে মুক্তি দানের জন্য আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করলেন। তিনি মসজিদুল হারামে বসে কুরআন তিলাওয়াত করতে লাগলেন ও ইবাদত বন্দেগি করতে লাগলেন এবং আবে যমযমের পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে লাগলেন। এর ফলে তার অন্তরে প্রশান্তি নেমে এলো। তিনি স্বামীকে বললেন, ‘আমি হোটেলে যাব না এখানেই থাকব। তিনি ইতিকাফের নিয়ত করে সেখানেই অবস্থান করতে লাগলেন। তার বুকে-পিঠে বেশ কয়েকটি টিউমার দেখা দিল। কয়েক মহিলা তাকে পরামর্শ দিলেন জমজমের পানি দিয়ে গোসল করতে। তিনি কয়েক দিন তাই করলেন। টিউমারগুলোতে হাত পর্যন্ত দেয়া যাচ্ছিল না। অসম্ভব যন্ত্রণা অনুভব হতো। কিন্তু আবে যমযমের পানি পান করার ফলে কয়েক দিনের মধ্যে টিউমারগুলো বিস্ময়করভাবে অদৃশ্য হতে লাগল। এক পর্যায়ে তিনি সুস্থ হয়ে গেলেন। এটা অবশ্যই আল্লাহর কুদরতের অপূর্ব নিদর্শন। লায়লা এখনও জীবিত আছেন। সুস্থ অবস্থায় আবে যমযমের পানি পান করার সময় কেবলামুখী হয়ে তিনি যে দোয়া পাঠ করলেন : আল্লাহুম্মা ইন্নি আস আলুকা ‘ইলমান নাফিআন ওয়া রিযকান ওয়াসিআন ওয়া শিফাআন মিন কুল্লি দায়িন -হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে উপকারী ইলম, পর্যাপ্ত জীবিকা এবং যাবতীয় রোগের নিরাময় কামনা করছি। তারপর প্রতিটি চুমুকে বিসমিল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু ‘ওয়া রসূলিল্লাহ পড়া উত্তম। এর অর্থ যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য এবং সালাত ও সালাম (দরূদ শরীফ) রাসূলুল্লাহর প্রতি। লেখক : পীর সাহেব দারিয়াপুর শরীফ
×