ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে রবীন্দ্র স্মরণ

প্রকাশিত: ২০:২৭, ৬ আগস্ট ২০২০

করোনাকালে রবীন্দ্র স্মরণ

২২ শ্রাবণ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। ৮০ বছর হতে চলল রবীন্দ্রনাথ আমাদের ছেড়ে চলে যান। ৮০ বছরের দীর্ঘ জীবনও পেয়েছিলেন। বিশ্ব জোড়া খ্যাতি অর্জন থেকে শুরু করে আবহমান বাংলা ও বাঙালীর ঐতিহ্যিক চেতনা ধারণ করা ছাড়াও সৃষ্টি বৈচিত্র্যে ঐশ্বরিক, জাগতিক এবং নান্দনিক শৌর্যে নিজেকে প্রতিনিয়ত শাণিত করেছিলেন। অতি বাল্যকাল থেকে সৃজনশক্তির স্ফুরণে যেভাবে বাংলা সাহিত্যের নতুন ধারা তৈরি করেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার নিরন্তর গতিপ্রবাহ আজও আমাদের বিস্ময়ে বিমুগ্ধ করে দেয়। সুখে, আনন্দে, দুঃখ, তাপে মানুষের প্রতিদিনের যাপিত জীবন নিয়ে তার শৈল্পিক মাহাত্ম্য অনুপম। জীবনবাদী আর বোধের সৃষ্টি নায়ক কবিগুরু মানুষের অনুভব, অনুভূতিকে দেখেছেন দক্ষ পর্যবেক্ষক হিসেবে। একইভাবে সমাজ আর প্রকৃতির সমূহ বিপর্যয়েও শুভ আর আশার বাণী শোনাতেও কখনও কার্পণ্য করেননি। ঐতিহ্যিক ঠাকুর পরিবারে জন্ম নেয়া কবি শৈশব, কৈশোর অতিক্রান্ত করেন উনিশ শতকের নবজাগরণের সমৃদ্ধ সময়ে। তিরিশ বছর তেমন সুবর্ণকাল অতিক্রম করে প্রত্যক্ষ করেন গ্রাম বাংলার হতদরিদ্র প্রজাকুলের অসহায় ও নির্বিত্ত দুঃসময়। সঙ্গত কারণে জমিদারি দেখার সুবাদে আমাদের বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল আর প্রমত্ত পদ্মার অবিরাম স্রোতে অবগাহন করা কবি তার সৃজন সত্তাকে যে মাত্রায় নিবেদন করেন সেখান থেকে উঠে আসে পিছিয়ে পড়া অতি সাধারণ মানুষের নিত্য সুখ, দুঃখ, হাসি-কান্না আর সমস্যাসঙ্কুল জীবনের ইতিবৃত্ত। দ্বার উন্মোচিত হয় বাংলা সাহিত্যের ছোট গল্পের। দুঃখ-দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর ভাগ্যহত জীবন কিভাবে সমাজ-সংস্কারের কঠিন শৃঙ্খলে আটকে পড়ে আছে তাও তার সৃজন দ্যোতনার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। রোগ-বালাই, শোক আর নিত্য জীবনযুদ্ধ কতখানি নিপীড়িত মানুষের ব্যবহারিক কর্মপ্রবাহে সম্পৃক্ত হয়ে আছে তাও কবির নান্দনিক চিত্তকে নানা মাত্রিকে আলোড়িত করতে থাকে। কলকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরণীয় বুদ্ধিবৃত্তির জগত আর ভাব সম্পদ থেকে একেবারেই আলাদা গ্রামীণ জনপদ আর নৈসর্গিক অফুরান বৈভব। প্রকৃতির অবারিত দানের মহিমায় পূর্ণ হয়েও সাধারণ মানুষের জীবন ছিল এক অচলায়তন সমাজ কাঠামোর গভীর শিকড়ে। ফলে নজর দিতে হয়েছে জমিদারি এলাকায় অতিদীনহীন প্রজাদের সার্বিক কল্যাণে বাস্তবোচিত ও আধুনিক, বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মসূচীকেও। চিরায়ত সমাজের গন্ডালিকা স্রোতে বহমান প্রজাসাধারণের জীবন-মান উন্নয়ন অত সহজ সাধ্যও ছিল না। সমাজের গভীরে লালন করা সমস্ত অপসংস্কারকে সূক্ষ্ম সমাজ গবেষকের দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করতে পেরেও সব ধরনের ইতিবাচক প্রভাব খাটানো যায়নি। কবি নিজেই মনে করতেন। জমিদার কিংবা উপনিবেশিক শাসনের চাইতেও জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল সাধারণ গোষ্ঠীর নিজেদেরই ভাগ্য পরিবর্তনের চরম অনীহা। সহায় সম্বলহীন মানুষের ভাগ্য বিধাতার ওপর নিঃশর্ত সমর্পণ কবি কখনও মানতে পারেননি। মনে করতেন মানুষ যদি নিজের মঙ্গল কামনায় বিরুদ্ধ প্রতিপক্ষ শক্তির বিপক্ষে তার কর্মযোগকে শাণিত করতে ব্যর্থ হয় তাহলে দুঃসময় আর ক্রান্তিকালের অবসান হওয়া কঠিন। সচেতন মানুষের নিজস্ব দায়বদ্ধতাই পরিত্রাণের সর্বোত্তম উপায়- এমন মর্মবাণী দীর্ঘ জীবনে ধারণ করতে তাকে কখনও ভাবতে হয়নি। নিজের ভাল মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধ তার শুভ-অশুভ প্রবৃত্তি যদি সঠিক পথে এগিয়ে যেতে ব্যর্থ হয় তাহলে বিপদ আর অশনিসঙ্কেত পদে পদে। আজ আমরা করোনা দুর্ভোগের চরম আপৎকালীন সময় অতিক্রম করছি। এমন সঙ্কটকালে মনে আসাটা স্বাভাবিক কবি গুরু কিভাবে বিপদ দুঃসময়কে পার করার মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন। শুধু তাই নয় পরিত্রাণের পথও যথার্থভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। বিপদকে ভয় নয় নিঃসঙ্কোচে, নির্ভীকভাবে তাকে জয় করাও জীবনের বিধিলিপি। মানুষের প্রতিদিনের জীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয়। দুঃখ, তাপে, শোকে বিপদে মুক্তির পথ বের করাই মানুষের প্রতিদিনের কর্ম লিপি। বিপরীত স্রোতের সঙ্গে রীতিমতো লড়াই করে জীবনের গতি অবারিত করতে হয়। রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক সৃজন সম্পদে মূর্ত হয়ে আছে জরা, বেদনা, মৃত্যু আর চরম বিপর্যয়ের সঙ্কটকালেও কিভাবে অন্তর্নিহিত শক্তি আর বোধে জীবনকে চালিয়ে নিতে হয়। বিপদকালে সমস্যাসঙ্কুল পথ পাড়ি দিতে কিভাবে নিয়মবিধি মেনে চরম অভিশাপকেও খন্ডন করতে হয়। মানুষ নিজেই তার জীবন আর ভাগ্যের নিয়ন্তা। তার শুভ-অশুভ বিচার বুদ্ধিই তাকে সার্বিক অমঙ্গল থেকে বাঁচাবে। তিনি বলতেন- যে মানুষ নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন না আইন, সমাজ, রাষ্ট্র এবং ধর্ম কেউই তাকে বাঁচাতে ব্যর্থ হবে। আত্মশক্তি আর অভাবনীয় মনোবলে সমস্ত বিপদ আর দুর্যোগকে সামলাতে হবে। জীবন চলিষ্ণু। কখনও থেমে থাকে না। কর্ম প্রবাহের নিরন্তর গতিধারায় সঙ্কটকালের দুর্ভোগকে অতিক্রম করাও জীবনের অবধারিত গতি। আজ করোনার দুঃসময়ে মানবতা ও জীবনবোধের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়ানকাল স্মরণ করতে গিয়ে মনে পড়ছে কিভাবে মানুষের মঙ্গল আর মুক্তি কামনা জীবনভর সৃজন ও কর্ম সাধনায় করে গেছেন। ভাবুক শৈল্পিক সত্তায় উৎসর্গিত জীবন সামাজিক বাস্তবতার টানা পোড়েনে ব্যবহারিক গতিপ্রবাহে কিভাবে দুর্যোগকাল পার হতে হয় তারই দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। যা কালের প্রবাহেও তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। আধুনিক তথ্যসমৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক যুগে রবীন্দ্রনাথ যে কত অনিবার্য তা নতুন করে উপলব্ধি করতে হয়। বিজ্ঞানমনস্ক রবীন্দ্রনাথ জীবনভর বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তার সৃজন সাধনায় নিমগ্ন হয়েছেন। সেটা যেমন তার কবিতা, ছোট গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধে একইভাবে বাস্তব কর্মযোগের প্রতিটি বিষয়েও। কাব্যিকভাব সম্পদে প্রতিনিয়ত নিজেকে সমর্পণ করা কবি বাস্তব প্রেক্ষাপটের ব্যবহারিক জীবন প্রক্রিয়াকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। সমস্যা কবলিত সমাজ সংস্কারের সমস্ত দুর্যোগকে সুদক্ষ সমাজ নিরীক্ষকের ভূমিকায় চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। উত্তরণের পথও সুনির্দিষ্ট করতে পিছপা হননি। সবার ওপর ব্যক্তি মানুষকে গুরুত্ব দিয়েছেন সর্বাধিক। সমাজের অসহনীয় আবর্জনা এবং অপ্রয়োজনীয় অপসংস্কারকে ঠান্ডা মাথায়, যৌক্তিকভাবে ঝেড়ে ফেলারও আন্তরিক আবেদন জানান। গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জমিদারি তদারকি করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের নৈকট্যে নিজেকে তৃপ্ত করেছেন, পূর্ণতায় ভরিয়ে তুলেছেন বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধ আঙিনা। ঠাকুরবাড়ির জৌলুস ছেড়ে ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রাম্যসমাজ কবির সুজনবোধকে যেভাবে আলোড়িত করে তার নজিরবিহীন নমুনা বিকাশমান রবীন্দ্র সাহিত্য। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের ছোট গল্পের অকল্পনীয় অবয়ব। যা পূর্ণাঙ্গ গ্রাম বাংলার শান্তি-স্নিগ্ধ প্রকৃতিই শুধু নয় তার চেয়েও বেশি অসহায়, পশ্চাদপদ দরিদ্র জনগোষ্ঠী। যারা নিজেরাই জীবন সম্পর্কে উদাসীন, ভাগ্য বিধাতার ওপর নির্ভরশীল। আর এখানেই কবি বার বার আঘাত করেছেন ব্যক্তি মানুষের জড়তা, স্থবিরতা এবং নির্লিপ্ততায়। বিদ্রোহের নিশানা সেভাবে উড়াননি, বিপ্লবের রক্তাক্ত উম্মাদনাও তার সাহিত্যের ভান্ডারকে কখনও রঞ্জিত করেনি। কিন্তু সমস্ত অন্যায়, অপবাদের বিরুদ্ধে ঠান্ডা লড়াই আর নীরব বিদ্রোহ থেকে কখনও ক্ষান্ত হননি। সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে যারা সম্পদের পাহাড় গড়েন তাদের বিরুদ্ধে যৌক্তিক খড়গহস্ত হতে তাকে ভাবতেও হয়নি। দীর্ঘ জীবন আর সুবিশাল সাহিত্যের আঙিনায় নিজেকে যেভাবে শাণিত করেছেন অত্যাচার আর নিপীড়নের বিপক্ষে সেখানে সুষম সমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠা ছিল এক অবধারিত পর্যায়ক্রম। মানুষের জীবনে সমস্ত অসম ব্যবস্থাপনাকে অন্তর থেকে ঘৃণা করেছেন। মানুষের কল্যাণে তার অধিকার আদায়ে সব ধরনের কর্ম প্রকল্প হাতেও নিয়েছেন তার জমিদারির আঙ্গিনায়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সহজ মিলনই কবির আরাধ্য ছিল। সে মিলনের পথে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা আর বন্ধন জালকে ছিন্ন করতে কবির নির্দেশনা আজও পাথেয়। গ্রামবাংলার জনপদ আর প্রমত্ত পদ্মায় বজরা ভ্রমণের মধ্যে লেখা তার ‘চিত্রা’ এবং ‘সোনার তরী’ কাব্যে আজও নদীমাতৃক, সুজলা, সুফলা শ্যামল বাংলার সাধারণ মানুষের নিত্যজীবন প্রবাহের এক অনন্য সম্ভার। যে মহতী কাব্যটি কবি ও বাঙালীকে বিশ্ব সভায় নিয়ে যায় তাও এই গ্রামীণ ছায়াঘেরা পরিবেশে রচিত বলেই কবির জবানীতে জানা যায়। কাছ থেকে অতি সাধারণ মানুষের ঘনিষ্ঠতায় কবি প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামের যে ইতিবৃত্ত প্রত্যক্ষ করেছেন সেটা যেমন তাঁর নান্দনিক শৌর্যে মহীয়ান হয়েছে পাশাপাশি বাস্তব কর্মপ্রবাহে তার সরাসরি প্রভাবও পড়তে দেরি হয়নি। সর্বক্ষেত্রে বিশ্ব বরেণ্য কবির মনে হয়েছে মানুষ নিজেই তার জীবন বিধাতা, প্রতিদিনের মান উন্নয়নেও তার কর্মযোগই যথার্থ বিধান। সঙ্কটে, বিপদে, দুঃখে, কষ্টে মানুষ নিজেই তার মুক্তির পথ খুঁজে নিতে সক্ষম। সেটাই বৃহত্তর সমাজ এবং মানুষের বেঁচে থাকাও এগিয়ে যাবার সর্বোত্তম উপায়। সময়টা ছিল উনিশ শতকের নব জাগরণের সমৃদ্ধকাল। আর গ্রামে-গঞ্জে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তেমন অরুণোদয়ের আলোর ছিটে ফোঁটাও পৌঁছায়নি। কলকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরণ থেকে যোজন যোজন দূরে থাকা অসহায় নিম্নবিত্তের মানুষরা কোন এক সময় রবির কিরণে উদ্ভাসিত হলেও তার চিরস্থায়ী বহির্প্রকাশ সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি। গণমানুষের ঔদাসীন্য আর পরনির্ভরতায় ভেতরের অন্তর্নিহিত বোধ ও শক্তির যে অপচয়, অবক্ষয় তাতেই পুরো গোষ্ঠী নির্জীব অবস্থায় কাল থেকে কালান্তরে ভেসে চলেছে। উন্নত বিশ্ব ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় রাশিয়া, চীন, জাপান ও ইউরোপ আমেরিকা কবির মনে হয়েছে সাধারণ মানুষের অভাবনীয় জাগরণে নতুন সমাজের ভিত শক্ত হয়েছে। কতিপয় বিশিষ্ট মানুষের দ্বারা হয়নি। তারা শুধু পথ নির্দেশকের কাজ করেছেন। সিংহভাগ জনগোষ্ঠী তাদের জীবন মান উন্নয়নে সম্মুখ সমরে এগিয়ে এসেছিল তবেই না আধুনিক উন্নত সমাজ ব্যবস্থার গোড়া পত্তন। ভেতরের শক্তি আর নিজের ভালমন্দ বোঝার ক্ষমতার মধ্য দিয়ে আমরা কবির নির্দেশিত পথেই করোনা দুর্যোগ অতিক্রম করার সাহস পাব। সরকারী এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ও বিধি যেমন থাকবে পাশাপাশি ব্যক্তি মানুষের সচেতনতা, দায়বদ্ধতায় নিজেকে সুরক্ষার চাবিকাঠিও খুঁজে নিতে হবে। প্রাণ এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে এড়াতে নিয়মমাফিক বিধি ব্যবস্থাকেও আমলে নিতে হবে। ভয় পাওয়ার চাইতেও তাকে জয় করার শক্তি অন্তর্নিহিত বোধে জাগিয়ে তুলতে হবে। সমাজ এবং জীবন নিয়মশৃঙ্খলার অধীন। এর ব্যত্যয় সব কিছুকে বেসামাল করে তোলে। করোনা দুর্যোগকেও আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে স্বাস্থ্যগত বিধিবিধান মেনে চলে। কবির ৮০তম প্রয়াণ বর্ষে আমরা তাঁর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধায় স্মরণ করতে চাই কিভাবে ক্রান্তিকালীন সময় পার করতে হয়। লেখক : সাংবাদিক
×