ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

তাজউদ্দীন-বিতর্ক ॥ ইতিহাসের আলোকে (২)

প্রকাশিত: ২০:২৫, ৬ আগস্ট ২০২০

তাজউদ্দীন-বিতর্ক ॥ ইতিহাসের আলোকে (২)

(গতকাল লেখাটির প্রথম কিস্তি ছাপা হয়েছিল সম্পাদকীয় পাতায়। আজ দ্বিতীয় কিস্তি ছাপা হলো চতুরঙ্গ পাতায়) একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে তাজউদ্দীন আহমদ তার জীবিতকালে যেমন নিজেকে বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ নেতা বলে দাবি করেননি, তেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল হোতা হওয়া সত্ত্বেও জেনারেল জিয়াউর রহমান কখনও নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক বা বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ ব্যক্তি বলে দাবি করেননি। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রাম থেকে বেতারে পাঠ করার সময়েও তিনি তাকে মহান নেতা বলে উল্লেখ করেছেন। আবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরও জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতায় থাকাকালে কখনও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবমাননাকর কোন উক্তি করেননি। তাজউদ্দীন আহমদও কখনও বঙ্গবন্ধুর সামনে মাথা তোলেননি। বরং মাথা নত করে বঙ্গবন্ধুর সব নির্দেশ আমৃত্যু মেনে চলেছেন। একটা উদাহরণ দেই। বঙ্গবন্ধু যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি, তখন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটা আপোসের ইচ্ছা প্রকাশ করে তাকে রাওয়ালপিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের তখনকার তরুণ নেতাদের দাবি ছিল বঙ্গবন্ধু প্যারোলে জামিন নিয়ে গোলটেবিলে যাবেন না। তাকে মিথ্যা ষড়যন্ত্রের মামলা থেকে অব্যাহতি দিলে একজন মুক্ত মানুষ হিসাবে তিনি আইয়ুবের সঙ্গে আলোচনায় যাবেন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও হিতৈষীরা চাচ্ছিলেন, আইয়ুবের সঙ্গে আপোস। তারা চাচ্ছিলেন শেখ মুজিব যেন প্যারোলে জামিন নিয়ে গোলটেবিলে যান এবং আইয়ুবের সঙ্গে আপোস করেন। বঙ্গবন্ধু রাওয়ালপি-ি যাবেন এই প্রত্যাশায় আগেভাগেই তার এডভ্যান্স পার্টি হিসাবে তাজউদ্দীন আহমদ করাচী চলে যান এবং তার নেতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। পরে তিনি যখন জানতে পারেন শেখ মুজিব গোলটেবিলে জামিন নিয়ে যাচ্ছেন না, তখন তিনি ঢাকায় ইত্তেফাক অফিসে মানিক মিয়াকে টেলিফোন করেন। মানিক মিয়া তখনও অফিসে আসেননি। আমি তখন ইত্তেফাকে কাজ করি এবং অফিসে এসেছি। আমি তাজউদ্দীন ভাইয়ের টেলিফোন ধরি। তিনি বললেন, মানিক ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। আমাকে বেশ কিছু প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা চাপ দিচ্ছেন, আমি যেন করাচীতে থাকি এবং লিডারকে গোলটেবিলে যেতে রাজি করাই। আমি মানিক ভাইয়ের কাছে জানতে চাই পরিস্থিতিটা আসলে কি? লিডার যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তিনি গোলটেবিলে আসবেন না, সেটাই আমাদেরও সিদ্ধান্ত। আমি ঢাকায় ফিরে আসব। মানিক মিয়া কিছুক্ষণ পরই অফিসে এলেন। তাকে তাজউদ্দীন আহমদের টেলিফোনের কথা জানালাম। তিনি বললেন, আতাউর রহমান খান, সালাম খান, জহিরুদ্দীন, মশিউর রহমান (যশোর) প্রমুখ নেতারা চান শেখ মুজিব আইয়ুব খানের সঙ্গে যেন আপোস করেন। তিনি প্যারোলে জামিন নিয়ে গোলটেবিলে যান। এই ব্যাপারে তাকে রাজি করাতে তাজউদ্দীন যেন চাপ দেন। কিন্তু তাজউদ্দীন তা করবেন না। কারণ, তিনি যদি জানেন শেখ প্যারোলে জামিন নিয়ে গোলটেবিলে যাবেন না, তাহলে তারও সিদ্ধান্ত একই হবে। তিনি শেখ মুজিবের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবেন না। মানিক মিয়ার কথা সত্য হয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদ করাচী থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানান। জনান্তিকে বলে রাখি বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে রাওয়ালপিন্ডিতে যাওয়ার পেছনে সব চাইতে বড় আপত্তি ছিল বঙ্গবন্ধু পত্নীর। তার আপত্তিতেই বঙ্গবন্ধু প্যারোলে জামিন নিয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন তখন ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদন। তিনি বিনা দ্বিধায় দলের সভাপতির সিদ্ধান্ত মেনে নেন। অনেকে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং তার পরেও নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রগুলো সময়মতো রোখা গেলে ’৭৫-এর নির্মম হত্যাকান্ড ঘটানো সম্ভব হতো না। মুজিবনগরে বসে তাজউদ্দীন, তার কযেকজন সহযোগী ও তার সরকারের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য কমরেড মনি সিং মিলে আলোচনা করেছিলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে প্রেসিডেন্ট পদে রেখে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, সিপিবি, মুজাফ্ফর ন্যাপ অর্থাৎ, মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী দলগুলোর সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠিত হবে। এই আলোচনাটি প্রকাশ হয়ে যায় এবং খোন্দকার মোশতাক এটাকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র আখ্যা দেন। খোন্দকার মোশতাকের এই চক্রান্তই সম্ভবত সফল করার জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ড. কামাল হোসেন জাতীয় সরকার গঠনের পরিকল্পনাটি ভেস্তে দেয়ার ব্যবস্থা করেন কিনা তা আমি জানি না। তবে, এটুকু জানি পাকিস্তানে তিনি মুক্ত অবস্থায় ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুকে প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের পরামর্শ দেন। বঙ্গবন্ধু সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই সহজেই ড. কামাল হোসেনের পরামর্শে রাজি হন। তাজউদ্দীন জাতীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। তিনি বা তার গ্রুপ বা তার পরিবারের কেউ এ ব্যাপারে আপত্তি তোলেননি। আবার বঙ্গবন্ধু যখন তাকে অর্থমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করতে বলেছেন তখন সঙ্গে সঙ্গে তা করেছেন। এই ব্যাপারে কোন অসন্তোষ তিনি প্রকাশ করেননি। এই সময় তাকে অনেকেই বিদ্রোহী হওয়ার, নতুন দল গঠনের এবং এই দল গঠনে সাহায্য দানের প্রস্তাব দেন। তিনি এ সকল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল (জাসদ) যখন গঠিত হয় তখন তাকে সভাপতির পদে বসার আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি তাও গ্রহণ করেননি। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘাতকেরা প্রথম তার কাছেই ছুটে এসেছিল যাতে সরকারের দায়িত্ব তিনি নেন তার প্রস্তাব নিয়ে। তিনি তাতে অসম্মতি জানান। তাকে আরও তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে জেলে নেয়া হয় এবং হত্যা করা হয়। তার কারণটা কি? ঘাতকেরা এবং তাদের পেছনের ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পেরেছিল, তাজউদ্দীন বেঁচে থাকলে তিনি তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে আবার ক্ষমতায় যাবেন এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ পুনর্প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন। তাহলে মুজিব-তাজউদ্দীনের বিরোধের খবর, তাজউদ্দীনকে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো নিয়ে বাইরের প্রচারণা সবই কি মিথ্যে? সর্বৈব মিথ্যা বলব না। তবে ষড়যন্ত্রকারীরা তিলকে তাল করেছিল। বঙ্গবন্ধু তার আজীবনের সহকর্মী ও বন্ধু তাজউদ্দীনকে ভুল বুঝেছিলেন। এই ভুল বোঝাবুঝি হয় টোকিওতে দেয়া তাজউদ্দীনের এক বিবৃতিকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের অর্থনীতি তখন ভাল নয়। বিশ্বের ধনী দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশকে সাহায্য দানের আবেদন নিয়ে তিনি বিশ্ব সফরে বেরিয়েছিলেন। টোকিওতে দেয়া তার বক্তব্যকে বিকৃত করে বঙ্গবন্ধুকে জানান দুই ব্যক্তি। একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. আবদুল মতিন এবং অন্যজন ডানপন্থী শিক্ষাবিদ ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী। তাজউদ্দীন আহমদের ওপর ড. আবদুল মতিন কি কারণে রুষ্ট ছিলেন তা আমার জানা নেই। তবে জানতাম অর্থমন্ত্রীর পদটির দিকে বিগ ম্যাক নামে পরিচিত ড. চৌধুরীর নজর ছিল। এই সময় রাজনৈতিক কৌশলগত কারণেও বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটানো প্রয়োজন মনে করেছিলেন। স্বাধীনতার আগে এবং পরে আমেরিকা, চীন ও সৌদি আরবের প্রচারণা ছিল শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ ভারতের তাঁবেদার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়া সাহায্য করায় বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবে রাশিয়াকে মিত্রদেশ হিসেবে গ্রহণ করে। তখন বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল। সোভিয়েত শিবির এবং মার্কিন শিবির। বাংলাদেশকে ধরা হলো রুশ-ভারত শিবিরের দেশ হিসেবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিয়ে বঙ্গবন্ধু অনুভব করেছিলেন মার্কিন অর্থ ও খাদ্য সাহায্য তার দরকার। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে খাদ্যাভাব প্রকট হয়ে উঠেছিল। তিনি আমেরিকার সঙ্গে খাদ্যচুক্তি করার আশায় ভারতপন্থী এই লেবেলটা সাময়িকভাবে সরাতে চেয়েছিলেন। আমেরিকার সন্দেহ ভাঙ্গার জন্যই তিনি সাময়িকভাবে তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে সরাতে চেয়েছেন এবং আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে কৃষিমন্ত্রীর পদ দিয়েছিলেন। এ সময়ের একটি ঘটনা। তখন আমি থাকি ঢাকার কেএম দাস লেনের একটি বাসায়। একদিন বিকেলের দিকে পাইওনিয়ার প্রেসের মালিক আবদুল মোহাইমেন এমপি আমার বাসায় এসে হাজির। তিনি তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আমারও আত্মীয়। এসেই বললেন, আপনাকে তাজউদ্দীন সাহেবের বাসায় যেতে হবে। তিনি আপনার সঙ্গে একটা ব্যাপারে পরামর্শ করতে চান। আমি একটু বিস্মিত হলাম। আমিও তাজউদ্দীন আহমদের আত্মীয়। সেই সুবাদে তার বাড়িতে বহুবার গেছি। তার স্ত্রী জোহরা ভাবি যত্ন করে খাইয়েছেন। তবু আমি এক নগণ্য সাংবাদিক। আমার সঙ্গে তার মতো দেশমান্য নেতার কী পরামর্শ থাকতে পারে। তবু গেলাম মোহাইমেন সাহেবের সঙ্গে তার বাসায়। তাজউদ্দীন আহমদ ব্যস্ত ছিলেন তখনকার এটর্নি জেনারেল ফকির শাহাবুদ্দীনের সঙ্গে আলোচনায়। আমাকে দেখে তাকে বিদায় দিলেন। জোহরা ভাবি আমাদের জন্য চা নিয়ে এলেন। তাজউদ্দীন আহমদ শান্ত কণ্ঠে তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনার কথা জানালেন। বঙ্গবন্ধু চান তাজউদ্দীন যেন স্বেচ্ছায় কোন একটা কারণ দর্শিয়ে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। কিছুদিন পর তাকে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনবেন। কেন বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনকে সরাতে চান তার কারণও তিনি তাকে বলেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ আমার কাছে পরামর্শ চান, তার স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে সরে যাওয়া উচিত হবে কিনা! বিস্ময়ে আমি কিছুক্ষণ হতবাক থেকেছি। তারপর বলেছি, এই ধরনের রাজনৈতিক কৌশল জওয়াহের লাল নেহেরুও গ্রহণ করেছিলেন। মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য তিনি তার ঘোর বামপন্থী বন্ধু, বলতে গেলে নেহেরুর প্রাক যৌবন থেকে বন্ধু কৃষ্ণ মেননকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। কৃষ্ণ মেনন তাতে ক্ষুণ্ণ হননি। পরে আবার নেহেরু মন্ত্রিসভায় ফিরেছিলেন। আমার কথা শুনে তাজউদ্দীন আহমদ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমারও কি তা হলে পদত্যাগ করা উচিত? আমি বলেছি, তাজউদ্দীন ভাই, আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি বলে আপনার স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা উচিত নয়। বঙ্গবন্ধু আপনাকে মন্ত্রিপদ থেকে অপসারণ করুন। তাতে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে। হেনরি কিসিঞ্জার জানবে আপনাকে শেখ মুজিব মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়েছেন। আপনি সরেননি। বিস্ময়ের কথা! অনেকে ভাববেন আমি বানিয়ে লিখছি। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেননি। বঙ্গবন্ধু তার পদত্যাগপত্র রেডি করে রেখেছিলেন। তিনি তাতে সই দিয়ে নীরবে গণভবন (পুরনো) ত্যাগ করেন। কৃষ্ণ মেননের মতোই এই ব্যাপারে টুঁ শব্দ করেননি। বঙ্গবন্ধুকে সুযোগ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার কৌশল সফল করার জন্য। তাজউদ্দিন আহমদকে মন্ত্রী পদ থেকে সরানোর পর গুজবে গুজবে ঢাকা শহর ভরে যায়। কিন্তু সবচাইতে ক্ষতিকর খবরটি প্রকাশ করেন এনায়েতুল্লা খান মিন্টুর ‘হলিডে’ পত্রিকাটি। প্রথম পাতায় একটি খালি সিংহাসনের ছবি ছেপে বলা হয়, ‘বাংলার মসনদে কে বসবেন, তার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। এই দ্বন্দ্বে রুশ-ভারত শক্তি শিবির মদদ দিচ্ছে তাজউদ্দীন আহমদকে। অন্যদিকে তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে শেখ মুজিব আমেরিকাকে তুষ্ট করে ক্ষমতা দখলে রাখার চেষ্টা করছেন।’ এই খবরটি ছিল উদ্দেশ্যমূলক। কারণ, রাশিয়া ও ভারত তাজউদ্দীন আহমদকে সমর্থন দিলে বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি (সিপিবি) তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণের বিরোধিতা করত। তারা তখন আওয়ামী লীগের মিত্র এবং আওয়ামী নেতৃত্বে গঠিত গণ ঐক্যজোটের শরিক। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার না, সিপিবি, না তখন বামঘেঁষা বলে পরিচিত ড. কামাল হোসেন এই অপসারণে মৃদু আপত্তিও জানাননি। বঙ্গবন্ধুকে সামান্য অনুরোধ জানাননি, তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভায় রাখা হোক। তারা ছিলেন সম্পূর্ণ নীরব। মন্ত্রিসভায় তাজউদ্দীন আহমদের অনুপস্থিতিতে খোন্দকার মোশতাক শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। তিনি মন্ত্রিসভার যে সব তরুণ মন্ত্রীকে বঙ্গবন্ধু স্নেহ করতেন, যেমন তাহের উদ্দীন ঠাকুর, ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেমকে দলে টানতে সক্ষম হন। অবশ্য শাহ মোয়াজ্জেম আগে থাকতেই মোশতাক গ্রুপে ছিলেন। শুরু হয় মোশতাকের আগা মসিহ লেনের বাসায় গভীর রাতে গোপন বৈঠক। যে বৈঠকে তাহের উদ্দীন ঠাকুরেরা তো থাকতেনই, মাঝে মাঝে এসে যোগ দিতেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টার। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকান্ডের ব্লুপ্রিন্ট এই বৈঠকেই তৈরি করা হয়। বঙ্গবন্ধু যে সাময়িক রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়েছিলেন, তার প্রমাণ তাজউদ্দীন যখন মন্ত্রি নন, তখনও তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে পরামর্শের জন্য তাজউদ্দীন আহমদকে ডাকতেন। তাজউদ্দীনও তার কাছে যেতেন। তাদের বন্ধুত্বে কখনও ঘাটতি পড়েনি। এর আরও একটি প্রমাণ, বাকশাল গঠনের পর তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে বাকশালের সাধারণ সম্পাদক করতে চেয়েছিলেন। প্রথমে মনোরঞ্জন ধরের মারফত তাজউদ্দীন আহমদের কাছে এই প্রস্তাবটি পাঠান, তারপর নিজে দেন। তাজউদ্দীন আহমদ বাকশাল গঠনের সমর্থন দিতে চাননি এবং প্রস্তাবটি গ্রহণ করেননি। আবার তিনি প্রকাশ্যে বাকশালের বিরোধিতায়ও নামেননি। আমার ধারণা, তাজউদ্দীন আহমদ এখানে একটা ভুল করেছিলেন। তিনি অভিমান ভুলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একত্রিত হলে মোশতাক গ্রুপের ক্ষমতা খর্ব হতো। আওয়ামী লীগে ঐক্য ফিরে আসত। দেশের প্রগতিশীল শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ত না। ১৫ আগস্টের নিদারুণ ঘটনাটি এত সহজে ঘটানো সম্ভব হতো না। এখানেই বোঝা যায় তিনি অসাধারণ রাজনৈতিক সংগঠক ছিলেন, কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ছায়ার তলে তিনি ছিলেন অসাধারণ রাজনৈতিক সংগঠক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ছায়ার বাইরে তার এতটা নেতৃত্ব গুণ ছিল না। পপুলিজম তার মধ্যে আদৌ ছিল না। পাঠক ভাইদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলছি, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার দরুন তার সম্পর্কে আমার এ ধারণা হয়েছে। এটা আমার নিজস্ব ধারণা। সঠিক নাও হতে পারে। তাজউদ্দিন আহমদের মৃত্যুর আগেই তার সমর্থক সেজে একটি মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে খাড়া করার চেষ্টা করে। তার মৃত্যুর পর এই চেষ্টা আরও শক্তিশালী হয়। এজন্যে তাজউদ্দীন কোনভাবেই দায়ী নন। অনুরূপভাবে জেনারেল জিয়া বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর কখনও নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করেননি, নিজেকে বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ বলেও প্রচার চালাননি। তার মৃত্যুর পর পাকিস্তানের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের পরামর্শে তার পরিবার ও দল এটা প্রচার করা শুরু করে। লন্ডন, ৫ আগস্ট, বুধবার ২০২০ ॥ [পরবর্তী অংশ আগামী বুধবার
×