ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

বাংলাদেশে করোনাও বাঙালী হয়ে গেছে!

প্রকাশিত: ২০:১৪, ৬ আগস্ট ২০২০

বাংলাদেশে করোনাও বাঙালী হয়ে গেছে!

বাজারে সব মাছ বিক্রেতা, সবজি বিক্রেতা, ফল বিক্রেতা সবাই সুস্থ, সবল, হাসিমুখে পণ্য বিক্রি করছে। বিগত চার মাস ধরে তাদের কাউকে কোন অসুস্থতায় ভুগতে হয়নি! ওরাই আমাকে প্রশ্ন করে- ‘খালাম্মা, ভালই আছেন দেখছি।’ আমি বলি- ‘তো, তোমরাও তো দেখছি ভালই আছ।’ ওরা এক গাল হেসে বলে, ‘এ রোগ তো আপনাগো মতন ধনীদের রোগ, এ আমাদের ধরবে না।’ দেখছি, যে ক’জন রিক্সাওয়ালাকে ফোনে ডাক দিই বা যারা গলিতে রোজই আসে, তারাও ভাল আছে। ডাকলেই পাই। উপরন্তু যে বুয়া গত দশ বছরের মতো রান্না করে একটার সময় চলে যায়, সেও এক দিনও কামাই করেনি। পাশের কাজের বুয়াও ভাল আছে। পাবনা থেকে বাস চলাচলের পর ফিরে এসেছে। ভ্যান গাড়ির সবজি, মাস্ক-স্যানিটাইজার, আম, আপেল, আনারসওয়ালা- সবাই সুস্থ আছে। ওষুধের দোকানের বিক্রেতা, ছেলেরা বহাল তবিয়তে আছে। আইভারমেকটিন কিনব কিনা, জিজ্ঞেস করে। বলি, ‘যখন গলাব্যথা, জ্বর হবে, তখন কিনব।’ অবশ্য আশপাশের অনেক বিল্ডিংয়ে বুয়া ছাঁটাই হয়েছে। আমাকে দেখে ওরা চোখ কপালে তোলে- দৈনিক আসা-যাওয়া করা বুয়া নিয়ে এখনও আমার কোন অসুস্থতা হলো না- এ এক বিস্ময় বৈকি। তাই তো, বুয়ারা কেউ এখনও হাঁচি পর্যন্ত দিল না কেন? জ্বর, গলাব্যথা দূরে থাক। যারা বিস্ময় প্রকাশ করে তাদের বলি, ‘আগে হাঁচি, কাশি, জ্বর তো হোক, তারপর কিছুদিনের জন্য আসবে না। অসুস্থ হওয়ার সময় তো বোঝা যাবেই।’ ব্যাংকের তরুণী মেয়েরা বলে- ‘ম্যাডাম, আপনি তো দেখছি সুস্থ আছেন।’ বলি, ‘হ্যাঁ, এখনও আছি, পরে কি হবে জানি না।’ ওরা বলে, ‘না ম্যাডাম, আপনি তো এ্যাকটিভ আছেন। সে জন্য আপনার হবে না।’ আসলে, এ্যাকটিভ লোকদেরও করোনা হচ্ছে। যে যাই বলুক, আমরা বাঙালীরা মনে হচ্ছে, করোনাভাইরাসকে এক রকম কাবু করে বাঙালীই করে ফেলেছি। তা না হলে, এতগুলো বস্তি বা ঘিঞ্জি এলাকায় থাকা এসব নানা কাজের কর্মী মানুষ করোনাকে ঘরের মানুষ করে তার সঙ্গে মিলে মিশে বসবাস করছে কিভাবে? হয়ত উপসর্গহীন হয়ে করোনা তাদের কারও কারও দেহে বাস করছে। অর্থাৎ, সে আমাদের মতো অদম্য কর্মঠ রোগকে তোয়াক্কা না করা বাঙালিয়ানার কাছে সারেন্ডার করে ‘বাঙালী’ হয়ে উঠেছে। কঠিন করোনা আসলে হচ্ছে কাদের? চিকিৎসক, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, প্রশাসক কর্মকর্তা, পুলিশ, সেনা সদস্যদের। পাশে দু-একজন করে গার্মেন্টস শ্রমিক ও সাংবাদিক আক্রান্ত এবং কারও কারও মৃত্যু হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসকরা থাকেন এসিবদ্ধ হাসপাতাল আইসিইউতে। হোটেলও এসিবদ্ধ। ব্যাংকারদের ব্যাংকঘরগুলোতে তারা সকাল থেকে রাত ৭-৮টা পর্যন্ত এসিবদ্ধ ব্যাংকের কক্ষে থাকেন। বড় ম্যানেজার, এমডিরা তো বাসাতেও এসি রুমে থাকেন। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-অফিস তো এসিবদ্ধ বটেই, অনেকেরই বাসাও এসিবদ্ধ। আমলারাও এসিবদ্ধ কক্ষে অফিস করেন। বড় আমলাদের বাসায়ও এসি থাকে। গার্মেন্টসগুলোর কারখানাঘর এসিবদ্ধ কিনা জানা নেই। সাধারণ সিলিং ফ্যান থাকলে ভাল হয় বলে মনে হয়। দীর্ঘদিন ধরে ভাবছিলাম এসিবদ্ধ ক্লাবঘর, রেস্তরাঁ এবং উপরোক্ত সব স্থাপনা এসিবদ্ধ থাকে বলে হয়ত ওখানে করোনাভাইরাস আটকে পড়ে এবং ঘুরতে থাকে। এক সময় ওখানে থাকাদের আক্রান্ত করে। এটা ভাবনার কারণ, বস্তি, ছোট ছোট এসিহীন বাড়িগুলো অসম্ভব গরম হয় বটে, কিন্তু বাসিন্দারা খোলা জানালা-দরজা দিয়ে আলো-বাতাসের মুক্ত আসা-যাওয়ার কারণে হয়ত করোনাভাইরাস তাদের বাড়িতে আবদ্ধ থাকে না। তাই তারা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকে। পরে লক্ষ্য করলাম পাশ্চাত্য দেশে পাব ক্লাব বন্ধ করে দেয়া হলো- এখানে এসি ঘরে সময় কাটানোদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হয়ে গেল বলে। তা হলে এসিবদ্ধ হাসপাতালে, ব্যাংকে, অফিসে বেশি সময় থাকার কারণে একটি বড় দল করোনা আক্রান্ত হতে পারে, এটা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে। লক্ষ্য করলাম, আমাদের এ্যাপার্টমেন্টে বাসরত চিকিৎসক ছাড়া অন্য একটি পরিবারের সব সদস্য করোনা আক্রান্ত হলো। মা’টি মারা গেল, তারা এসিবদ্ধ ঘরে বসবাস করত! বস্তিতে বা এ্যাপার্টমেন্টে তরুণ-তরুণী ছাড়াও যেহেতু আধুনিক যুগে ওষুধের, চিকিৎসার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, সে জন্য প্রায় সব বাড়িতে বয়স্ক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বেঁচে আছেন। গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় সব পরিবারে বৃদ্ধ, বৃদ্ধা বাস করছেন এবং তারা যে খুব বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন, এমনটা দেখতে পাচ্ছি না। মুম্বাইয়ের ‘ধারাবি’ বস্তিতে করোনা কম কেন তা জানতে নাকি যে টেস্ট করা হয়েছে, তাতে জানাচ্ছে, ওখানে যথেষ্ট সংখ্যক, ২০ থেকে ৩০ শতাংশ করোনা আক্রান্ত আছে। গবেষকদের মতে, এবার বস্তিতে সম্ভবত উপসর্গহীন করোনার অস্তিত্ব বড় সংখ্যায় বের হবে। সত্যই, এটা কেমন কথা ধনীরা, সচ্ছলরা করোনা আক্রান্ত হবে, কেউ কেউ মৃত্যু বরণ করবে, আর দরিদ্র বস্তিবাসী-কাজের বুয়া, দোকানদার, রিক্সাওয়ালা, শ্রমিক, কৃষক, ফেরিওয়ালারা দিব্যি হেসে-খেলে জীবন কাটাবে? এটা যে গবেষকরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল বাংলাদেশের দরিদ্র বস্তিবাসী লাখ লাখ সংখ্যায় মৃত্যুবরণ করবে, তাদের মানে আঘাত হেনেছে। আঘাত লাগাটা কি এমনি এমনি ছেড়ে দেয়া যাবে! আমার তো মনে হচ্ছে- শীঘ্রই একটা গবেষক দল বস্তিতে বস্তিতে ডাটা সংগ্রহ করে ওখানে করোনা হামলা হচ্ছে না এই সত্যকে খারিজ করতে মাঠে নামবে! এক রকম আতঙ্কই বোধ করছি- হকার্স, গাউছিয়া শত শত নারী-পুরুষ শিশু-তরুণ, ক্রেতা-বিক্রেতারা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা কি ভয় পেয়ে বন্ধ ঘরে ফিরে যাবে? মনে হয় না। এরা তো শেষমেশ বাঙালী, যাদের একদল করোনাভাইরাসকে উপসর্গহীন, নতজানু, নমনীয় করে নিজেরা তাদের তোয়াঙ্কা না করার পর্যায়ে নামিয়ে এনে দৈনন্দিন কাজকর্ম ‘মাস্ক’ ঝুলিয়ে রেখে, ‘মাস্ক’ না পরেও পরিচালনা করছে! তাদের করোনাই যেন ভয় করে। যদি ধরা হয়, আমাদের অর্ধেক জনসংখ্যা উপসর্গহীন করোনা আক্রান্ত, যারা অন্যদের মধ্যে এ রোগ ছড়াচ্ছে, তবে নিজেরা কোন রকম অসুস্থতা বোধ করছে না, সুতরাং দু’তিন সপ্তাহ পর অজান্তেই করোনামুক্ত হচ্ছে- তাহলে আমাদের ভয় পাবার কিছু নেই। তারা অর্থাৎ, সেই অর্ধেক লোকসংখ্যা তো টিকা গ্রহণকারীর সামনে অবস্থানে চলে এসেছে। তাদের কাছ থেকে যারা সংক্রমিত হয়েছে, তারাও উপসর্গহীনই থাকবে। সুতরাং তারাও দু’তিন সপ্তাহ পর রোগমুক্ত হয়ে এ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন হবে। তাহলে ভয়টা কোথায়? ভয় সেই কঠিন ভয়ঙ্কর করোনাভাইরাস প্রজাতিকে, যেটি রোগীকে শ্বাসতন্ত্র হয়ে দ্রুত ফুসফুস অথবা ব্রেনের সব শিরার রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে অক্সিজেন ও রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থাকে বন্ধ করে দিয়ে ফুসফুস, লিভার, কিডনি, ব্রেনসহ সব অঙ্গকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে রোগীর মৃত্যু ঘটাচ্ছে। এর জন্য টিকা প্রয়োজন। কিন্তু সেটি কতটা ফলপ্রসূ হবে, দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ ক্ষমতা দেবে কিনা- সে সব এখনও অজানা। তবে দরিদ্র শ্রমজীবী বাঙালী করোনাভাইরাসকে উপসর্গহীন নমনীয় করে তুলে বাড়ির একজন যদি করে ফেলে থাকে অর্থাৎ, করোনাকেও ‘বাঙালী’ করে ফেলে, তাহলে অন্তত এই একটি বিষয়ে দরিদ্র বাঙালী ধনবান দুর্নীতিবাজ বাঙালীকে হারিয়ে দিয়েছে। অন্তত একবার তো প্রলেতারিয়েতের জয় হলো অবশেষে, তাই বা কম কি! তবে বাংলাদেশ মাত্র সাড়ে তিন হাজার মৃত্যুর রেকর্ড নিয়েও কোন কোন দেশ একে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার তালিকায় রেখেছে! শুধু যে জাল সার্টিফিকেট তৈরিটা প্রধান কারণ, তা মনে হয় না। বাংলাদেশ বিরোধিতা সব সময়ই কম-বেশি আছে, চলছে। উপসর্গহীন রোগীরা পরীক্ষা করাবে না- এটাই স্বাভাবিক। উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন জানানো হচ্ছে। করোনায় মৃত্যুর সঙ্গে এ সংখ্যা গড়ে প্রতিদিন বিশ যোগ করে ধরলেও মোট মৃত্যু অনেক দেশের চাইতে বাংলাদেশ কম। এ ঘটনাটি অনেকের গাত্রদাহ ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশকে এখন ভৌগোলিক জলবায়ু পরিবর্তন ঘটিত বন্যা, দুর্যোগ, নদী ভাঙ্গন, ফসলহানিসহ সব প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে এবং জয়ীও হতে হবে। এ যুদ্ধে প্রলেতারিয়েতকে জয়ী হতেই হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×