ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাপানী ও চীনা বিনিয়োগ আনার উদ্যোগ

সনি টয়োটার মতো বৈশ্বিক ব্র্যান্ড আসছে

প্রকাশিত: ২২:১৯, ৫ আগস্ট ২০২০

সনি টয়োটার মতো বৈশ্বিক ব্র্যান্ড আসছে

রহিম শেখ ॥ করোনার প্রাদুর্ভাবে সারাবিশ্বে কমে গেছে বিদেশী বিনিয়োগ। মহামন্দায় এক দেশের বিনিয়োগ ছুটছে আরেক দেশে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ ছুটছে চীন থেকে। এসব বিনিয়োগের গন্তব্য আপাতত কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ভারত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ। এই দৌড়ে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। জাপানের যেসব কোম্পানি চীন থেকে সরে আসবে, সেখান থেকে কিছু কোম্পানিকে যাতে বাংলাদেশে আনা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। সনি, টয়োটার মতো বৈশ্বিক ব্র্যান্ড যাতে বাংলাদেশে আসে সেই অনুরোধ জানিয়ে ইতোমধ্যে জাপান দূতাবাস, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (জাইকা) এবং জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) কাছে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। বিনিয়োগ বাড়াতে জেট্রোর ঢাকা কার্যালয়কে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)। শুধু জাপানী নয়, সরাসরি বিপুল পরিমাণে চীনা বিনিয়োগ আসছে বাংলাদেশে। চীনের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি ইয়াবাং ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিংস গ্রুপ বাংলাদেশে প্রাথমিকভাবে আড়াই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। বিনিয়োগের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ১০০ একর জমি নিচ্ছে কোম্পানিটি। মঙ্গলবার কোম্পানিটির সঙ্গে ইজারা চুক্তি করেছে বেজা। এছাড়া চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৬০টি চীনা কোম্পানি বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে উন্নয়নকারী চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে। সম্প্রতি বৈশ্বিক পরামর্শক সংস্থা প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারসের (পিডব্লিউসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ কোম্পানি ব্যয় কমানো, মজুরি বাবদ ব্যয় কমানো, বাণিজ্যযুদ্ধ এড়ানো ও জমির ব্যয় কমানোর জন্য চীন ছাড়তে চায়। এর বাইরে রয়েছে করোনা মহামারী মন্দা মোকাবেলা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানি এ্যাপল ইতোমধ্যে তাদের উৎপাদনের একটি অংশ চীন থেকে ভারতে নিয়ে গেছে। তাইওয়ানের ফোকসভাগেনও চীন থেকে ভারতে আসার পরিকল্পনা করছে। এভাবে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অনেক দেশেরই বহুজাতিক কোম্পানি তাদের উৎপাদন ব্যবস্থা চীন থেকে বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাচ্ছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এই প্রবণতা শুরু হয়, করোনা মহামারীর পর তা আরও বেড়েছে। জাপানের সনি কর্পোরেশন তাদের ক্যামেরা, প্রজেক্টর ও ভিডিও গেমের প্লেস্টেশন তৈরির কারখানা চীন থেকে সরিয়ে অন্য কোন দেশে নিতে চায়। চীন থেকে খুব শীঘ্রই বিদায় নিতে চায় জাপানের গাড়ি উৎপাদনকারী টয়োটার যন্ত্রাংশ তৈরির কোম্পানি টয়োটা বশোকু কর্পোরেশন, ইলেকট্রনিক জায়ান্ট শার্প ও প্যানাসনিক, ঘড়ি উৎপাদনকারী সিকো ও ক্যাসিওর মতো বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোও। এই তালিকায় আরও রয়েছে জাপানের মিতসুবিশি ইলেকট্রনিক, তোশিবা, দক্ষিণ কোরিয়ার এসকে হাইনিকস ও এলজি ইলেক্ট্রনিকস, তাইওয়ানের কম্পিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কম্পাল ইলেক্ট্রনিকস। আশা জাগাচ্ছে জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চল ॥ বাংলাদেশও জাপানী বিনিয়োগ পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে জাপানীদের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে, যার ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এটি উন্নয়ন করছে জাপানের সুমিতমো কর্পোরেশন। জাপানী অর্থনৈতিক অঞ্চল ২০২১ সালে কারখানা করার উপযোগী হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সহায়তায় বিনিয়োগকারীদের জন্য এক দরজায় সেবা বা ওয়ান স্টপ সার্ভিসও চালু করেছে বেজা। যদিও তাতে বেশ কিছু সেবা যুক্ত করা এখনও বাকি। বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম গত ১২ মে জেট্রোর ঢাকা কার্যালয়কে চিঠি দিয়ে বলেছেন, জাপান বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার যে কৌশল নিয়েছে, তা নিয়ে বাংলাদেশ খুবই আগ্রহী। এফবিসিসিআই চায়, জাপান কারখানা সরিয়ে বাংলাদেশে আনুক। চীন থেকে সরে যাওয়া কারখানা এ দেশে আনতে বাড়তি সুবিধা দেয়ার চিন্তা করছে সরকারও। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি কমিটিও কাজ করছে। বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগ নিয়ে আসছে চীন ॥ চীনের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি ইয়াবাং ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিংস গ্রুপ বা শিল্প গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে পোশাক উৎপাদনের কাঁচামাল ও অন্যান্য রাসায়নিক কারখানা স্থাপনের জন্য অনেক আগেই বিনিয়োগ প্রস্তাব জমা দেয়। প্রাথমিকভাবে ৩০ কোটি ডলার বা দুই হাজার ৫২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। পরে এই বিনিয়োগ এক বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। কোম্পানিটি বার্ষিক ইজারা ভাড়া ভিত্তিতে ১০০ একর জমিতে শিল্প স্থাপন করবে। মঙ্গলবার সকালে বেজা কার্যালয়ে এ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে বার্ষিক রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪৬ দশমিক ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া বার্ষিক অভ্যন্তরীণ বিক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯৭ দশমিক ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখানে স্থাপিত শিল্পে ২ হাজার ২শ’ জন লোকের কর্মসংস্থান হবে। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, গেস্ট অব অনার হিসেবে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোঃ মাহবুব উজ জামানি উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ইয়াবাং গ্রুপের চেয়ারম্যান মিস্টার জুজিয়াচু। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী। ইয়াবাং ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিংস গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড একটি চীনা সংস্থা যা মূলত চীনের ইয়াবাং গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। তারা ডাইং ও পেইন্টিং-এর ক্ষেত্রে অন্যতম বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান। এই গ্রুপটি জিয়াংসু স্টক এক্সচেঞ্জের একটি তালিকাভুক্ত সংস্থা। ডাই ও রং ছাড়াও পিগমেন্ট, ফার্মাসিউটিক্যালস, ভেটেরিনারি ওষুধ, কীটনাশক, ফটোভোলটাইকস, মাইনিং, লজিস্টিক্স, ফিন্যান্স এবং রিয়েল এস্টেটের সেক্টরে তাদের বিনিয়োগ রয়েছে। ইয়াবাং গ্রুপের বার্ষিক পরিচালন আয় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই গ্রুপটি শীর্ষস্থানীয় ৫শ’ চীনা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে। চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ আনতে চায় চায়না হারবার ॥ বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য যে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেখানে উন্নয়নকারী হিসেবে কাজ করছে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। চায়না হারবার বেজাকে এক চিঠিতে সম্প্রতি বলেছে, তারা চীন সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও তাদের মূল প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানির (সিসিসিসি) কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেয়েছে। বাংলাদেশ সরকার রাজি থাকলে তারা চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের যৌথ অংশীদারত্ব চুক্তি করতে চায়। সিসিসিসি বিখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ফরচুন-এ বৈশ্বিকভাবে শীর্ষ ৫০০ কোম্পানির একটি। ২০১৯ সালের তালিকায় এটি ছিল ৯৩ তম। তাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান চায়না হারবার বলছে, চুক্তি হলে তারা ১০ কোটি মার্কিন ডলারের মূলধন নিয়ে আসবে। বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি ॥ কোভিড-১৯ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ-সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে বিদেশী বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে ব্যাংকিং প্রক্রিয়া আরও সহজ ও গতিশীল করার কথা উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরকে লেখা চিঠিতে বলা হয়, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নিজ দেশে সহজে লভ্যাংশ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির অন্যতম পূর্বশর্ত। বেটার বিজনেস ফোরামের আদলে টাস্কফোর্স করার পরামর্শ ॥ সরকার এরই মধ্যে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১১টি বাধা চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে করোনা মহামারীর প্রেক্ষাপটে স্থানান্তরিত বিনিয়োগ ধরতে দেশে কোন ইনসেনটিভ বা প্রণোদনার ব্যবস্থা না থাকা।
×