ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইনচার্জসহ ১৬ পুলিশ ক্লোজড ॥ তদন্ত কার্যক্রম শুরু

টেকনাফে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা নিহত

প্রকাশিত: ২২:১৮, ৫ আগস্ট ২০২০

টেকনাফে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা নিহত

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ টেকনাফে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক মেজর প্রাণ হারিয়েছেন। তার নাম সিনহা মোঃ রাশেদ খান। ঈদ-উল-আজহার আগের দিন শুক্রবার রাত অনুমান ৯টায় টেকনাফ থানাধীন মেরিন ড্রাইভ সড়কে বাহারছড়া পুলিশ চেকপোস্টে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর ওই পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ১৬ সদস্যকে জেলা পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়েছে। মেজর সিনহা হত্যার এ ঘটনায় গঠিত চার সদস্যের তদন্ত কমিটি মঙ্গলবার থেকে তাদের তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে। কমিটিকে তদন্তের জন্য সময় দেয়া হয়েছে ৭ দিন। এদিকে নিহত মেজর (অব) সিনহাকে সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে ঢাকা বনানীর সামরিক কবরস্থানে। এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা পৃথকভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ঘটনার খোঁজখবর নিচ্ছেন। এর আগে ঘটনার তদন্তে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন-যুগ্ম সচিব) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। রবিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। এই কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের একজন প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে থাকবেন, যাকে মনোনীত করবেন ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও কক্সবাজারের এরিয়া কমান্ডার। পুলিশের পক্ষ থেকে এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকবেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজির মনোনীত একজন প্রতিনিধি। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মোঃ শাজাহান আলি কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকবেন। যাকে ইতোপূর্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়, কমিটি ঘটনার বিষয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। ঘটনার কারণ ও উৎস অনুসন্ধান করবে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে মতামত দেবে। তদন্ত কার্যক্রম শুরু ॥ পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোঃ রাশেদ খান নিহতের ঘটনার তদন্তে গঠিত কমিটি তদন্ত কাজ শুরু করেছে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, মঙ্গলবার সকালে তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমান কক্সবাজারে পৌঁছেন। কক্সবাজার হিলডাউন সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে বেলা ১১টায় তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যদের নিয়ে এক সমন্বয় সভার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেন। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে পুনর্গঠিত এই তদন্ত কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। কমিটিতে রামু ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও কক্সবাজারের এরিয়া কমান্ডারের মনোনীত একজন প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে রয়েছে। পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছে চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শকের মনোনীত অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ জাকির হোসেন। তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, দুঃখজনক ঘটনাটির একটি নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ তদন্ত করা হবে। সূত্রে জানা যায়, গত শুক্রবার রাত ৯টায় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ রোডে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ (৩৬) তার প্রাইভেটকার নিয়ে এক সঙ্গীসহ মেরিন ড্রাইভ হয়ে কক্সবাজারের হিমছড়িতে নীলিমা রিসোর্টে আসছিলেন। পথিমধ্যে টেকনাফের বাহারছড়া শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের চেকপোস্টে পৌঁছলে গাড়িটি থামাতে সিগন্যাল দেয় পুলিশ। গাড়ি থামিয়ে মেজর সিনহা নিজের পরিচয় দেন। এ সময় গাড়ি তল্লাশি করাকে কেন্দ্র করে পুলিশ সিপাহিরা তখন মেজর সিনহার সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সিপাহিরা। ইন্সপেক্টর লিয়াকত মুঠোফোনে কি বলেছেন, জানা না গেলেও মোবাইল কললিস্ট যাচাই করলে লিয়াকত কি নির্দেশনা দিয়েছেন, তা স্পষ্ট হওয়া যাবে বলে মন্তব্য করেন অভিজ্ঞজনরা। ইন্সপেক্টর লিয়াকতের নির্দেশ পেয়ে সিপাহিরা গাড়ি থেকে মেজর সিনহাকে নেমে আসতে বলেন। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ হাত তুলে গাড়ি থেকে নেমে আসেন। এরপর তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী পর পর তিনটি গুলি করে সিনহাকে হত্যা করে বলে সেনা সদর থেকে গণমাধ্যমে প্রেরিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে। পরক্ষণে পুলিশের গুলিতে আহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদকে একটি মিনি ট্রাকে করে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। সিনহার হত্যাকাণ্ড নিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন ॥ একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাহাড় থেকে নেমে মেজর (অব) সিনহা সিফাতকে নিয়ে নিজস্ব প্রাইভেটকারে ওঠেন। রাত ৯টার দিকে তারা পৌঁছান শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে। সেখানে আগে থেকেই ডাকাত প্রতিরোধে প্রস্তুত ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ পুলিশের সদস্যরা। পুলিশের সঙ্কেত পেয়ে মেজর সিনহা গাড়ি থামান এবং নিজের পরিচয় দিলে প্রথমে তাদের চলে যাবার ইশারা দেয়া হয়। পরে পরিদর্শক লিয়াকত আলী তাদের পুনরায় থামান এবং তাদের দিকে পিস্তল তাক করে গাড়ি থেকে নামতে বলেন। সিফাত হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির পেছনের দিকে গিয়ে দাঁড়ান। মেজর সিনহা গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নামার পরপরই পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত তাকে তিনটি গুলি করেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গুলি করার পরপরই রাত পৌনে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন স্থানীয় জনগণ ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাঠকর্মী সার্জন আইয়ুব আলী। তখন গুলিবিদ্ধ সেনা কর্মকর্তাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পান তারা। সার্জন আইয়ুব আলী ঘটনার ভিডিও রেকর্ড করতে চাইলে পুলিশ ওই সার্জনের পরিচয় জানতে চায়। পরিচয় দেয়ার পর সার্জনের হাত থেকে মুঠোফোন সেট ও তার পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেয় পুলিশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাত ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে আনা হয় একটি মিনিট্রাক। ট্রাকে উঠানোর সময়ও মেজর সিনহা জীবিত ছিলেন এবং নড়াচড়া করছিলেন। এরপর সিনহাকে নিয়ে ট্রাকটি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পৌঁছায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর। তখন হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক সিনহাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতাল থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব ১ ঘণ্টার পথ। অতিরিক্ত ৪৫ মিনিট অতিবাহিত করা পুলিশের একটি অপকৌশল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। পুলিশের দাবি ॥ পুলিশ জানিয়েছে, ওই সেনা কর্মকর্তা তার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে অপর একজন সঙ্গীসহ টেকনাফ থেকে কক্সবাজার আসছিলেন। মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া চেকপোস্টে পুলিশ গাড়িটি থামিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে তিনি বাধা দেন। এই নিয়ে তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে সেনা কর্মকর্তা তার কাছে থাকা পিস্তল বের করলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ওই সেনা কর্মকর্তা গুরুতর আহত হয়। পরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পর পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন, শামলাপুরের লোকজন ওই গাড়ির আরোহীদের ডাকাত সন্দেহ করে পুলিশকে খবর দেয়। এই সময় চেকপোস্টে গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু গাড়ির আরোহী একজন তার পিস্তল বের করে পুলিশকে গুলি করার চেষ্টা করে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ওই ব্যক্তি মারা যায়। এসপি জানান, এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। ২ জনকে আটক করা হয়েছে। পিস্তলটি জব্দ করেছে পুলিশ। এছাড়া গাড়ি ও রিসোর্টে তল্লাশি করে ৫০টি ইয়াবা, কিছু গাঁজা এবং দুটি বিদেশী মদের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে। ডিআইজি কক্সবাজারে ॥ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা ঘটনার বিস্তারিত জানতে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক কক্সবাজার এসেছেন। রবিবার বিকেলে তিনি কক্সবাজার পৌঁছেন। এর আগে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম এ্যান্ড অপারেনন্স) মোঃ জাকির হোসেনও কক্সবাজারে আসেন। সোমবার বিকেলে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে টেকনাফ পরিদর্শন করেন ডিআইজি। তিনি সংগঠিত ঘটনার বিষয়ে বিভিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ করছেন বলে জানা গেছে। ইনচার্জসহ ১৬ পুলিশ ক্লোজড ॥ অবসরপ্রাপ্ত মেজর রাশেদ হত্যা ঘটনায় পুলিশের টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীসহ ১৬ সদস্যকে ক্লোজ করা হয়েছে। রবিবার সকালে তাদের ক্লোজ করে নিয়ে আসা হয়েছে পুলিশ লাইনে। তদস্থলে কক্সবাজার জেলা পুলিশ থেকে নতুন পুলিশ সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থেই এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কক্সবাজারে কেন এসেছিলেন মেজর সিনহা ॥ ঢাকাস্থ স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফ্লিম এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগ থেকে জাস্ট গো নামক একটি কোম্পানির পক্ষে ইউটিউব চ্যানেলে দেয়ার জন্য প্রামাণ্য তথ্য চিত্র নির্মাণের লক্ষ্যে কক্সবাজারে আসেন মেজর সিনহা। স্টাম্পফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের তিনজন ছাত্রছাত্রীসহ একটি ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ট্রাভেল ভিডিও তৈরি করতে গত ৩ জুলাই থেকে কক্সবাজারে অবস্থান করছেন তারা। তারা পর্যটন স্পট হিমছড়ির নিলীমা রিসোর্টে রাতযাপন করতেন। গত ৫ জুলাই কক্সবাজার পৌরসভার মাধ্যমে কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজ হতে করোনার নমুনা টেস্ট করান ওই চারজন। টেস্টে তাদের রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’ আসে। প্রায় এক মাস যাবৎ পর্যটন নগরীর বিভিন্ন স্থানে শূটিং করেন তারা। ঘটনার আগে কোথায় ছিলেন সিনহা ॥ শুক্রবার বিকেল থেকে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাতসহ মেজর সিনহা ছিলেন মাথাভাঙ্গা তথা মারিশবনিয়া এলাকার পাহাড়ে। সেখানে পাহাড়ী ঝর্ণাও রয়েছে। হয়ত ঝর্ণার আশপাশের চিত্র ধারণ করাটাই ছিল তার উদ্দেশ্য। ওই পাহাড়ী ঝর্ণার ছবি প্রামাণ্যচিত্র ধারণ করে রাত ৮টার দিকে চলে আসছিলেন তারা। সন্ধ্যা ও রাত্রিকালীন শূটিং শেষ করে অন্ধকার হওয়া মোবাইল ও টর্চলাইটের আলো জ্বালিয়ে রাত আটটার দিকে পাহাড় থেকে নামছিলেন সিনহা ও তার সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাত। মাইকিং ও পুলিশ ফাঁড়িতে ফোন ॥ সন্ধ্যা ৭টার পর টর্চলাইটের আলো দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা ডাকাত বলে সন্দেহ করে। পরে মাথাভাঙ্গার বাসিন্দা নেজাম উদ্দিন নামে এক যুবক মারিশবনিয়া মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়েছে বলে প্রচার করে। কালবিলম্ব না করে কমিউনিটি পুলিশিং সদস্য নুরুল আমিন মুঠোফোনে পাহাড়ে টর্চলাইট জ্বালিয়ে কয়েকজন ডাকাত হাঁটাহাঁটি করছে বলে মিথ্যা সংবাদ দেয় বাহারছড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকতকে। মাইকে প্রচার শুনে চলে আসেন সিনহা ॥ মাইকে বলা হয়, আপনারা স্থানীয় হয়ে থাকলে পাহাড় থেকে নেমে আসেন। এই বাক্য শুনে মেজর সিনহা তার সঙ্গীসহ নেমে আসেন মাথাভাঙ্গা পাহাড় থেকে। মাইকিং শুনে পথিমধ্যে জড়ো হওয়া স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সিনহা কথা বলেন এবং নিজের পরিচয় দেন বলে জানা গেছে। পরিচয় জেনে স্থানীয়রা নিজ নিজ বাড়ি ঘরে ফিরে যায়। মেজর সিনহা ও তার সঙ্গী সিফাত হেঁটে মেরিন ড্রাইভে রাখা তার গাড়িতে গিয়ে উঠেন। পথিমধ্যে বিজিবি চেকপোস্টে থামানো হয় তার গাড়িটি। বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর বলে পরিচয় জেনেই ছেড়ে দেয়া হয় তার গাড়িখানা। অন্তত পাঁচ কিমি পর পুলিশ চেকপোস্টে এসে আটকা পড়ে সিনহার গাড়িটি। উল্লেখ্য, বাহারছড়া পুলিশ চেকপোস্ট থেকে মাথাভাঙ্গা পাহাড়ী ঝর্ণার দূরত্ব প্রায় ১০/১২ কিমি। সিনহা তিন গুলিতে নিহত ॥ পুলিশের এজাহারে আইসি লিয়াকতের রিভলবার থেকে চারটি গুলি ছোড়ার কথা উল্লেখ থাকলেও কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গ সূত্র জানিয়েছে, ময়নাতদন্তে দেখা গেছে, তিনটি গুলির একটি সিনহার বুকে ও দুটি গলার নিচে বিদ্ধ হয়। জানা গেছে, তার সঙ্গী সিফাতকে পায়ে গুলি করা হয়েছে। তাকে তদন্ত কেন্দ্রে নিয়ে চিকিৎসা শেষে রুজুকৃত মামলার আসামি হিসেবে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার জানিয়েছেন, শুক্রবার রাত ২টার দিকে টেকনাফ পুলিশ অবসর প্রাপ্ত এক সেনা কর্মকর্তার গুলিবিদ্ধ মরদেহ হাসপাতালে নিয়ে আসে। হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়। দুটি মামলা রুজু ॥ জব্দ তালিকায় একটি বিদেশী পিস্তল ও ৯ রাউন্ড গুলি, ও মাদক উদ্ধার দেখিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ২টি মামলা রুজু করেছে পুলিশ। পরে সিনহার সঙ্গী সিফাতকে ঘটনাস্থল থেকে এবং শূটিং টিমের সদস্য এক নারীকে নীলিমা রিসোর্ট থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার বাদী টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল। মামলায় আসামি করা হয়েছে নিহত মেজর সিনহার সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে। এছাড়াও মেজর সিনহা রাশেদ খান ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে আরও একটি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে টেকনাফ থানায়। এতে উদ্ধার দেখানো হয়েছে ৫০ পিস ইয়াবা, দুটি মদের বোতল ও ২৫০ গ্রাম গাঁজা। সরকারী কাজে বাধা, হত্যার উদ্দেশে অস্ত্র তাক করা ও মৃত্যু ঘটানো এসব অপরাধ আনা হয়েছে রেকর্ডকৃত মামলায়। শনিবার আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। হোটেল ম্যানেজার যা বললেন ॥ কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের পাশে অবস্থিত নীলিমা রিসোর্টের ম্যানেজার মোঃ সোলাইমান বলেন, রিসোর্টটি দুই মাসের জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন মেজর (অব) সিনহা মোঃ রাশেদ খান। তারা সংখ্যায় চারজন হলেও আলাদা আলাদা কক্ষে থাকতেন। রিসোর্টে দুজনকে রেখে ৩১ জুলাই বিকেলে মেজর সিনহা ও সিফাত প্রাইভেটকার নিয়ে টেকনাফ শূটিং করতে যান। রাত দুটার দিকে রিসোর্টের একজন কর্মচারী মুফোঠোনে জানায় যে, রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ সিনহার রিসোর্টে অভিযান চালিয়ে কিছু মদের বোতল ও গাঁজা উদ্ধার করেছে। এ সময় একজনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। ঢাকায় লাশ দাফন ॥ শনিবার সকালে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে তার মরদেহ স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত মেজর রাশেদের মৃতদেহ কক্সবাজার থেকে রবিবার ঢাকায় নেয়া হলে সেখানে এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয় বলে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে। মেজর সিনহা মোঃ রাশেদকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় বনানী সামরিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। জানাজার পূর্বে সেনানিবাসের একটি চৌকস সেনাদল সামরিক মর্যাদা প্রদান করে সিনহাকে। সিনহার পরিচয় ও ঠিকানা ॥ মেজর রাশেদ খান ১৯৮৪ সালের ২৬ জুলাই ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম আদনান। ঢাকার রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করার পর সিনহা মোঃ রাশেদ ৫০তম বিএমএ লং কোর্সের একজন কর্মকর্তা হিসেবে ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর মাত্র ২০ বছর বয়সে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। অবসরপ্রাপ্ত মেজর রাশেদ যশোরের বীর হেমায়েত সড়কের বাসিন্দা। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম এরশাদ খানের সন্তান। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা ৫০তম বিএমএ লং কোর্সের একজন কর্মকর্তা হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাংলাদেশের এলিট ফোর্স এসএসফ (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) এ একজন বাছাইকৃত চৌকস সেনা অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অবিবাহিত সিনহা ওরফে আদনান ২০১৮ সালে মেজর পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছাই অবসর নেন। সিনহার পিতা ছিলেন উখিয়ার ইউএনও ॥ নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর রাশেদ খানের পিতা এরশাদ খান কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৭-৮৮ সালে তিনি উখিয়ায় ইউএনওর দায়িত্বে ছিলেন। যশোরের বীর হেমায়েত সড়কের বাসিন্দা এরশাদ খান ছিলেন ১৯৭১ এর রণাঙ্গনের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এরশাদ খান সর্বশেষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব থাকাবস্থায় অবসরে যান।
×