ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

আলেয়ার আলোময় ভুবন এখন নিকষ কালো

প্রকাশিত: ২১:৪৩, ৫ আগস্ট ২০২০

আলেয়ার আলোময় ভুবন এখন নিকষ কালো

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হচ্ছে ফুটবল। আর ফুটবল খেলার প্রাণ হচ্ছে রেফারিরা। ফুটবলে কঠিন কাজগুলোর মধ্যে রেফারিংটা নিশ্চয়ই অন্যতম। রেফারিদের প্রতিটি সিদ্ধান্তই কোচ, খেলোয়াড় এবং দর্শকদ্বারা চুলচেরা বিশ্লেষণ ও যাচাই করা হয়। ফুটবলারদের বেতন নিয়ে সারাবছরই আলোচনা হয়। সরগরম থাকে ফুটবল অঙ্গন। কিন্তু মাঠে দামী ফুটবলারদের পরিচালনায় বা খেলার সৌন্দর্য রক্ষায় যারা থাকেন তাদের পারিশ্রমিক নিয়ে কখনও আলোচনা হয় না। এমনকি বাংলাদেশের রেফারিদের বেতন পরিশোধ নিয়ে কি কখনও মাথা ঘামায় দেশীয় ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)? তারা রেফারিদের বেতন পরিশোধ করে ঠিকই তবে অনেক টালবাহানা করে, কালক্ষেপণ করে। কিন্তু এই করোনাকালে তারা কিভাবে বেঁচে আছেন সেটা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা আছে কী? আজ এক মহিলা রেফারিকে পাঠকদের সামনে হাজির করছি, যিনি খুবই আর্থিক সমস্যায় আছেন। অনেক দুঃখ-দুর্দশায় কাটাচ্ছেন একেকটি দিন, একেকটি রাত। আলেয়ার আলোময় ভুবন এখন নিকষ কালো। তার নাম আলেয়া বেগম আলো। ২৭ বছর বয়সী আলেয়া কি এই করোনাকালে বাফুফে বা অন্য কোন সংগঠন থেকে কোন সাহায্য পেয়েছেন? ‘ফুটবল রেফারিজ এ্যাসোসিয়েশন থেকে আমিসহ ১৫ নারী রেফারি গত ঈদের আগে জনপ্রতি দুই হাজার টাকা করে পেয়েছিলাম। বাফুফে অনেকদিন ধরেই আমাদের ৩০ নারী রেফারিকে সাহায্য দেয়ার আশ্বাস দিয়ে আসছে। কিন্তু এখনও সেটা তারা বাস্তবায়ন করেনি’ আলেয়ার উত্তর। আলেয়া দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জনকণ্ঠকে জানান, ‘খেলা চালালে আয় হয়। এতে নিজে চলি, সংসার চালাই। এখন খেলা বন্ধ, রোজগারও বন্ধ। খুবই কষ্টে আছি ভাই!’ ঢাকার ধানমণ্ডি টিউটোরিয়াল স্কুলে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে গেম টিচার হিসেবে আছেন আলেয়া। কিন্তু দেশে করোনা আসার পর স্কুল বন্ধ। তাই আলেয়ার বেতনও বন্ধ। মোহাম্মদপুরের যে বাসায় থাকতেন তার ভাড়া দেয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। তাই এখন নিজেদের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের উত্তর বাঁশবাড়িয়ার রহমতের পাড়ায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। সেখানে বড় বোনকে নিয়ে থাকেন। আলেয়ার বাবা একটি টেক্সটাইল মিলে চাকরি করতেন। সড়ক দুর্ঘটনায় ২০০৭ সালে তিনি মারা যান। তার সাত বছর আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মাও পরপারে পাড়ি জমান। তাদের সাত মেয়ে। প্রথম পাঁচজনের বিয়ে হয়ে গেছে। আলেয়া সবার ছোট। ষষ্ঠ বোনের সঙ্গেই এখন চট্টগ্রামে থাকেন তিনি। এই বোনটি টুকটাক টিউশানি করেন। আর স্কুল শিক্ষিকা মেজ বোন কিছু সাহায্য করেন। এভাবেই এখন কষ্টেসৃষ্টে দিনাতিপাত করছেন আলেয়া। এখনও বিয়ে না করার কারণও জানান আলেয়া, ‘আমার ইমিডিয়েট বড় বোনের এখনও বিয়ে হয়নি। তার আগে আমি কিভাবে বিয়ে করি? তাছাড়া আমার দুটো লক্ষ্য আছে। জাতীয় রেফারির মর্যাদা পাওয়া এবং ফিফা রেফারি হওয়া। এই লক্ষ্যগুলো পূরণ হলেই আমি বিয়ে করব।’ চট্টগ্রাম শারীরিক শিক্ষা কলেজ থেকে বিপিএড শেষ করেছেন আলেয়া। এছাড়া চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার অপেক্ষায় আছেন করোনাকাল শেষ হলে। প্রথম শ্রেণীর রেফারি আলেয়া রেফারিং করেছেন ছেলেদের পাইওনিয়ার লীগ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ লীগ, চট্টগ্রামের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ লীগ, অনুর্ধ-১৭ লীগ, ঢাকায় অনুষ্ঠিত মহিলা লীগ ও বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবলে। শেষের আসরের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে দু’বার পুরস্কার নিয়েছেন ২০১৭ ও ২০১৮ সালে। রেফারি হিসেবে জয়া চাকমাকে আদর্শ মানা আলেয়া ভবিষ্যতে কোচও হতে চান। বিকেএসপি থেকে বছর দুয়েক আগে কোচেস ট্রেনিং কোর্সও করেছেন এ জন্য। খেলা বন্ধ থাকলেও আলেয়ার ফিটনেস ঠিক রাখার প্রক্রিয়া কিন্তু থেমে নেই। সপ্তাহে ছয়দিন সমুদ্র সৈকতে গিয়ে নানা ধরনের ব্যায়াম করে শারীরিক সক্ষমতা ধরে রাখছেন। রেফারি হিসেবে কেমন পারিশ্রমিক পেতেন আলেয়া? ‘আমাদের কিন্তু মাসিক হিসেবে পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। দেয়া হয় টুর্নামেন্ট বা লীগ শেষ হলে। ফলে মাসিক কত আয় করি সেটা বলা সম্ভব না। তবে একটা হিসেব দিতে পারি। চট্টগ্রামের অনুর্ধ-১৭ লীগের প্রতি ম্যাচে ১৫০০, বঙ্গমাতায় ২০০০ (ফাইনালসহ), জেলা লীগে ৬০০ ও পাইওনিয়ার লীগের প্রতি ম্যাচে ৭০০ টাকা করে পাই। মহিলা লীগে ৫ ম্যাচে ১০ হাজার টাকা পেয়েছিলাম।’ আলেয়ার এই হিসেব থেকেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশের নারী রেফারিরা এখনও কত অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে রেফারিং করে থাকেন। রেফারি হওয়ার আগে নানা ধরনের খেলাই খেলেছেন আলেয়া। এ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ও রাইট উইঙ্গার হিসেবে খেলেছেন আন্তঃজেলা জাতীয় মহিলা ফুটবল, স্কুল লীগ, কলেজ লীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় লীগে। ক্রিকেটারও তিনি। ডানহাতি মিডলঅর্ডার উইলোবাজ ও ডানহাতি অফ স্পিনার হিসেবে একযুগ খেলেছেন ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে। তার দলগুলো হলো : বাংলাদেশ আনসার, শেখ জামাল ধানমণ্ডি, কেরানীগঞ্জ, গুলশান ইয়ুথ ক্লাব ও সিটি ক্লাব। খেলেছেন প্রথম বিভাগ লীগেও। চট্টগ্রাম বিভাগের হয়ে অংশ নিয়েছেন জাতীয় লীগেও। আরও আছে। এ্যাথলেটিক্সে জেলা পর্যায়ে ২০০৬ সালে ২০০ ও ৪০০ মিটার দৌড়ে দ্বিতীয় হয়েছেন। এরপর ডাক পান বিজেএমসির ক্যাম্পে। জুনিয়র এ্যাথলেটিক্সে লংজাম্প ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে অংশ নিয়েছেন। হ্যান্ডবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন খেলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন লীগে। শৈশবে খেলাধুলা করার সময় পাড়ার লোকে নানা কটু কথা বলতো। সেগুলো শুনে বাবা-মা কষ্ট পেতেন। আলেয়াকে এ জন্য বকা দিতেন এবং খেলা না ছাড়ায় মারতেনও। কিন্তু জেদি আলেয়া খেলা ছাড়েননি। কারণ খেলাধুলা তার প্রাণ। এটা তার রক্তে মিশে গেছে। এ প্রসঙ্গে আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘এত ক্রাইসিসের মধ্যেও খেলাটা ছাড়িনি। অথচ এখন আমাদের কেউ একটা খোঁজও নেয় না!’
×