ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

আগস্ট ॥ বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরিদের দায়িত্ব

প্রকাশিত: ২০:৩৪, ৫ আগস্ট ২০২০

আগস্ট ॥ বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরিদের দায়িত্ব

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে বাঙালী জীবনে আগস্ট এক বেদনার মাস, অনেকটা আক্ষেপের মাস। ১৫ আগস্টের অনেক আগে থেকে, বলা যায় মুক্তিযুদ্ধকালেই তাজউদ্দীনবিরোধী তৎপরতার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার নীল নক্সা তৈরির কাজ শুরু হয়। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে মোশতাক গং যুক্ত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তো নেয়া হয়নি, বরং তারা চাটুকারিতা করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠিত থেকেছেন। ১৫ আগস্ট কালো রাতে সেনানিবাস থেকে খালি ট্যাংকগুলো যখন ধানমণ্ডি ৩২ নং রোডে প্রবেশ করে, তখন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি করছিল। প্রায়শই বলা হয়ে থাকে যে, বঙ্গবন্ধুর জীবনের ঝুঁকির কথা তাঁকে বারংবার বলা হলেও তিনি তা আমলে নেননি। দেশে কি এমন কেউ ছিল না, যাকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করা যেত। বঙ্গবন্ধু না চাইলেও কি তাঁর এবং পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা জোরদার করা যেত না। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা মহামান্য রাষ্ট্রপতির যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা তা নিশ্চয়ই তাঁদের ইচ্ছার ভিত্তিতে গৃহীত হয়নি। মহামান্য রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন বক্তৃতায় এটা স্পষ্ট হয় যে, তিনি চান বা না চান রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থাসমূহ এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাহলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের ক্ষেত্রে এটি কেন অনুসৃত হয়নি তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড শুধু একজন রাষ্ট্রপতি বা জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড নয়, এর মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রকে পাল্টে দেবার উদ্যোগ নেয়া হয়। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পাতাকাবাহী মানুষ যাতে টিকে না থাকে সে উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু একটি শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছেন। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ নামের যে স্তম্ভগুলো সংবিধানে তিনি সন্নিবেশিত করেন তা উপড়ে ফেলার বড় কারণ ছিল দীর্ঘকালের শোষণকে অব্যাহত রাখা। কৃষক ঠিকমতো সার ও ফসলের ন্যায্য মূল্য পাক, শ্রমিক নিয়মিত বেতন পাক, দেশ শিল্পে সমৃদ্ধ হোক - কায়েমী স্বার্থবাদীরা তা চায়নি। তারা ধর্মের নামে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্য চরম সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নেয় এবং বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নামে কুৎসা রটনা করতে থাকে। তাঁর কর্মী-সমর্থকদের জেলে ঢোকানো হতে থাকে। ইতিহাসের পাতা ও মানুষের হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলার সব আয়োজন করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যকাণ্ডের পরে দেশে-বিদেশে তদন্ত শুরু হয়। কোথাও তাঁর বা পরিবারের সদস্যদের নামে কোন অর্থের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এতে স্পষ্ট হয় যে, খুনীদের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ভাবধারার পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনে মূলত ধর্মকেই ব্যবহার করা হয়। এতে মানুষের কতটুকু আত্মিক পরিবর্তন হয়েছে, মানুষের সত্যবাদিতার কোন উন্নতি হয়েছে কি, না, ঠকবাজ ভাল মানুষ হয়েছে কি, না- তা বিশ্লেষণযোগ্য। বরং দেখা যায় লেবাসধারী ভণ্ড তপস্বীর সংখ্যা বেড়েছে; ভাল মানুষ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়েছে। সমাজের উঁচু পর্যায় থেকে নিম্নতর পর্যায় পর্যন্ত মানুষের লোভের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অস্ত্র উঁচিয়ে ক্ষমতা দখল করে ভাল কথা বলে পর্বতসম দুর্নীতি করা হয়েছে। বিভিন্ন শুক্রবারে বিভিন্ন মসজিদে নামাজ আদায়ের পাশাপাশি হেন কোন অপকর্ম নেই যে, সামরিক রাষ্ট্রপ্রধানরা করেননি। এভাবে দিনে দিনে রাষ্ট্র ও সমাজে অন্তঃসারশূন্যতা তৈরি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মিথ্যা বলে বলে মানুষের মধ্যে অনীহা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও মানুষ বঙ্গবন্ধুকে আঁকড়ে থেকেছে। এই আঁকড়ে থাকা মানুষগুলোর নেতৃস্থানীয়রা অনেকে মন্ত্রীত্বের লোভের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি, জেল-জুলুমের পরোয়া করেননি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে শুধু স্বাধীনতা বিরোধীদের দিয়ে দল গঠন করেন তাই নয়; আওয়ামী লীগেরও কিছু কেন্দ্রীয় নেতা তার সঙ্গে হাত মেলান বা অস্ত্র বলে তাদেরকে তার সঙ্গে ভিড়তে বাধ্য করা হয়। কিন্তু তারপরও বেশ কিছু সংখ্যক নেতা রয়ে যান, যারা দলের আদর্শ প্রচারে ভয় পাননি। তখন নীতি-আদর্শের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য দেখা দেয়। আওয়ামী লীগ (মালেক), আওয়ামী লীগ (মিজান) ও আওয়ামী লীগ (গাজী)- এভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধারা তৈরি হয়। একসময় জোহরা তাজউদ্দীন দলের হাল ধরেন এবং সেই দুর্গম যোগাযোগের যুগে প্রত্যেক এলাকার সঙ্গে নেটওয়ার্কিং গড়ে তোলেন। এই সময়ে কর্মীদের মধ্যে আবার সাহস ফিরে আসতে থাকে। ১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মাত্র ৩৯টি আসন পায়। নির্বাচনটি হয়েছিল সামরিক বাহিনীর পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায়। খন্দকার আছাদুজ্জামান এই সময়ে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। মনে আছে পত্রিকার পাতায় সংসদীয় কার্যক্রমের যে খবর প্রকাশিত হতো তা কর্মীদের উদ্দীপিত করত। ৩৯ জনই যেন ছিল জাতীয় সংসদ। সবই যেন ছিল তাদের দখলে। এসব কারণে কর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। তখন ‘জয় বাংলা’ নিষিদ্ধ, ‘বঙ্গবন্ধু’ নিষিদ্ধ। তখন মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা হয়ে যায়- শুধু যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা, মুক্তিযুদ্ধের শিল্পী, কূটনীতিক, সাংবাদিক এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের নেতৃত্ব সবকিছু মুছে দেয়া হয়। তারপরও কর্মীরা সংগঠিত থাকে। তখন কলেজগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। অধিকাংশ কলেজেই ছাত্রলীগ বিজয়ী হতো। এভাবে সমর্থকদের মধ্যে আশা জাগে, প্রেরণা তৈরি হয়। শ্রমিক এলাকায় দেখা যায়, একদল শ্রমিক সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিবিসির সংবাদ শোনার জন্য বসে আছে। ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, ১৫ আগস্ট তারা বিবিসিতে বঙ্গবন্ধুর নাম শুনতে পাবে- এ জন্য সব জড়ো হচ্ছে। চলবে... লেখক : উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
×