ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খুররম মমতাজ

সেই রাশিয়া

প্রকাশিত: ০০:৫৭, ৩১ জুলাই ২০২০

সেই রাশিয়া

পূর্ব প্রকাশের পর সাইকেলে উঠতে উঠতে অস্কার শুনলো বুড়ো বলছে- ‘আজ কপালে আমার ঝাঁটা আছে রে নাতি...ঝাঁটা আছে...!’ তারপরই গান ধরলো। দূর থেকে ভেসে এলো মাতালের গান- ‘ওই মারোঝ মারোঝ/নি মারোঝ মিনিয়া... (ওরে তুষার ঝরে... তুষার!/আমার লাগে না শীত...)!’ জোরে প্যাডেল মেরে কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুলে পৌঁছে গেল অস্কার। সাইকেলটা অফিসঘরের পিছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখলো, যাতে সহজে কারো চোখে না পড়ে। পড়লে নানারকম প্রশ্ন উঠতে পারে। তারপর পা টিপে টিপে সে এলো জানালার কাছে। নিঃশব্দে জানালা টপকে এপাশে চলে এসেছিল অস্কার। ঘরের ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গোল বাঁধলো বিগ জো-র খাটটা পার হতে গিয়ে। সাত ফিট লম্বা জো-র পা দুটো খাট থেকে বের হয়ে থাকে ঘুমানোর সময়Ñ কথাটা একদমই মনে ছিল না অস্কারের। ওর পায়ে বাড়ি খেল সে। কী যেন একটা পড়ে গেলো, শব্দও হলো। হঠাৎ ঘুম ভেঙে চেঁচিয়ে উঠলো জো- ‘ভুত! ...ভুত!!’ একপাশে কাত হয়ে শুয়ে ছিল সে। বিরাট বপু নিয়ে সোজা হতে হতে অস্কার নিজের বিছানায় উঠে কম্বল মুড়ি দিলো। অন্ধকারে কিছু দেখতে পায়নি জো, চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিলো। হৈচৈ শুনে ঘুম ভাঙলো অনেকের। লুই উঠে আলো জ্বেলে জো-কে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় ভুত! কিছু নাই। ঘুমা...।’ জো বললো, ‘তাহলে জানালা দিয়ে কেউ এসেছে, আমাকে ব্যথা দিয়েছে...’ ‘স্বপ্ন দেখেছিস মনে হয়, ঘুমিয়ে পড় জো।’ ‘মোটেই স্বপ্ন না, পা এখনো ব্যথা করছে...।’ গজগজ করতে করতে শুয়ে পড়লো জো। আমারও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আলো নেভার আগে ঘুম ঘুম চোখে দেখলাম কম্বলের ভিতর থেকে উঁকি মারছে অস্কার। আমার দিকে ফিরে আছে সে, গোল গোল চোখে তাকাচ্ছে। কম্বলের ফাঁক দিয়ে ওর গায়ের জ্যাকেটটা দেখতে পেলাম। ঘুমের রাজ্যে ফিরে যেতে যেতে ভাবলাম জ্যাকেট গায়ে ঘুমাচ্ছে কেন অস্কার? পরদিন সকালে দেখি আমার আগেই জেগে গেছে অস্কার। শুয়ে শুয়ে কম্বলের মধ্যেই সে কিছুক্ষণ হাত-পা নাড়াচাড়া করে প্রতিদিন সকালে, আজকেও করছে। এটা ওর প্রভাতি ব্যায়াম, আমাকেও শিখিয়ে দিয়েছে। ঘুমের জড়তা কাটাতে বেশ সাহায্য করে ব্যায়ামটা। একজন দু’জন করে সবাই উঠে পড়লো। নাস্তা খাওয়ার সময় আমি নিচু স্বরে অস্কারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাল রাতে কী হয়েছিল রে, জ্যাকেট পরে ঘুমিয়েছিলি কেন? আমার দিকে চোখ টিপে ফিসফিসিয়ে সে বললো, ‘চেপে যা, পরে তোকে বলবো...’ সেদিন অস্কার, আাজিম সহ আমরা চার-পাঁচজন গেলাম ফসলের মাঠে কাজ করতে। পিচঢালা রাস্তায় উঠে প্রতিদিন ডানে মোড় নেয় বাস, যায় শহরের দিকে, আজকে গেল উল্টো দিকে। ওদিকেই মাইলকে মাইল ভিওস্কি গ্রামের ফসলের মাঠ। ওদিকেই নদী। নদীর নাম মালিতছা, বাংলায় যার অর্থ মিনতি। মিনতি নামের নদীÑ আহা কী সুন্দর নাম! একেক জনকে একেক জায়গায় নামিয়ে দিল বাস। আমি নামতেই ক্যাপ পরা এক লোক হাসিমুখে এগিয়ে এসে হাত মেলালো। তার বয়স পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের মতো। ‘সুপ্রভাত। আমার নাম বোরিস নিকোলায়েভিচ বেরেজোভ’, বললেন তিনি। ‘আমি আন্দ্রুশার বাবা। আন্দ্রুশা আমাকে বলেছে তোমার কথা।’ ‘সুপ্রভাত বোরিস নিকোলায়েভিচ।’ আমি রাশান নিয়ম অনুযায়ী ফরমাল সম্ভাষণ জানালাম তাকে। রাশান সম্ভাষণের কিছু নিয়ম-কানুন আছে। প্রথম নামটা শুধু ঘনিষ্টজনদের জন্য। যেমন এখানে বোরিস। ঘনিষ্টজনরা আদর করে ডাকার সময় নামটা অদল-বদল করে নেয়। ‘বোরিস’কে ডাকে ‘বোরিয়া’ অথবা ‘বোরিসচিক’। এভাবেই আন্দ্রে হয়েছে আন্দ্রুশা, তার বোন নাতালিয়া হয়েছে নাতাশা। কিন্তু সদ্য পরিচিত অথবা অল্প পরিচিতরা একে অন্যকে প্রথম দুটো নামে সম্ভাষণ ক’রে থাকে। যেমন এইমাত্র আমি বললাম ‘বোরিস নিকোলায়েভিচ’। এটাই ফরমাল নিয়ম। আরও বেশি ফরমাল পরিবেশে নামের আগে কমরেড বলা হয় সমাজতন্ত্রের রাশিয়ায়। মিস্টার, মিস, মিসেস বাদ দিয়ে দিয়েছে ওরা। নামকরণেরও একটা নিয়ম আছে। যেমন বোরিসের ছেলের পুরো নাম আন্দ্রে বোরিসোভিচ বেরেজোভ। মাঝের নামটা আসছে বাবার নাম বোরিস থেকেÑ ‘বোরিসোভিচ’। মেয়ের বেলায়ও একই নিয়মÑ নাতালিয়া বোরিসোভনা বেরেজভ। এখানে ‘বোরিসোভনা’ মানে বোরিসের মেয়ে। আর বেরেজোভ হচ্ছে পারিবারিক পদবী। আমার মুখে ফরমাল সম্ভাষণ শুনে আন্দ্রুশার বাবা হেসে বললেন, ‘তুমি আমাকে শুধু বোরিসই ডাকতে পারো। অত ফরমাল হওয়ার দরকার কী!’ এই কথায় পরিবেশটা অনেক সহজ হয়ে গেল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছেন আপনি?’ ‘ভালো আছি অপু। তুমি ভালো তো?’ ‘হ্যাঁ ভালো। আজকে কী কাজ আমাদের?’ ‘চলো দেখাই তোমাকে।’ হার্ভেস্টিং মেশিন- ফসল কাটার যন্ত্রটা বড়সড়ো একটা ট্রাকের মতো দেখতে। ওটার এক পাশে লোহার ফ্রেম। সিলিন্ডার আকৃতির ফ্রেমটা চিকণ চিকণ লম্বা লোহার পাত দিয়ে তৈরি। ফ্রেমের গায়ে একটা চিমনি লাগানো। কীভাবে যন্ত্রটা কাজ করে বুঝিয়ে দিল বোরিস। হার্ভেস্টার চলতে শুরু করলে লোহার ফ্রেম ঘুরতে থাকবে। সেই সঙ্গে ঘুরতে থাকবে চিকণ পাতগুলো। সেগুলো পাকা গমের গাছকে দুমড়ে ভিতরে নিয়ে নেয়। ভিতরে খড় আর গমের দানা আলাদা হয়ে যায়। শেষে গমের দানাগুলো চিমনি দিয়ে বেরিয়ে এসে পড়ে ট্রাকের উপর। আমার কাজ খুব সহজ। বুঝিয়ে বললো বোরিস, ‘ট্রাকে উঠে যাও। ওখানে কাঠের কোদাল আছে, সেটা দিয়ে গমের স্তূপকে ছড়িয়ে সমান করে দেবে। যাতে এক জায়গায় পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে মাটিতে পড়ে না যায় গমগুলো।’ ড্রাইভিং সিটে উঠতে উঠতে বরিস বললো, ‘আন্দ্রুশা তোমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।’ ‘কেমন আছে আন্দ্রুশা?’ আমিও ট্রাকের গা বেয়ে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করলাম। ‘ভালো আছে, আজকেই তাকে দেখতে পাবে, লাঞ্চের সময়। নাতাশাও সঙ্গে আছে।’ ইঞ্জিন স্টার্ট নিয়েছে। ড্রাইভারের মাথার কাছে ছোট্ট একটা ফোকড়। (চলবে)
×