ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ স্নেহের টান

প্রকাশিত: ০০:৫৬, ৩১ জুলাই ২০২০

গল্প ॥ স্নেহের টান

দুই দিনের দুপুরের ভাত ঘুম ভাঙতেই চোখ মেলে তাকালো জানালার বাইরে। নীলচে আকাশে কি সুন্দর বিকেল বাইরে খেলা করছে। মন যেন কিসের বিষণ্নতায় ভরে গেল। দুপুরে সহজে ঘুমোতে চায় না। কিন্তু ক’দিন শরীরের উপর দারুণ পরিশ্রম। তার উপর নতুন অফিসের ভিন্নতর চাপ। সব মিলিয়ে শরীরটা বাগিয়ে আনতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। অনেক দিন পর একটু সময় পেয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছিল। আর কখন যে চোখ দুটো ঘুম কাতুরে হয়েছে টের পায়নি। নীলচে আকাশে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘের ভেলা দেখতে খারাপ লাগছিল না। কিন্তু দৃশ্যপটে বার বার ভেসে আসছিল বিউটির একা চলে যাওয়া। বিউটি আদরের বোন। যখনই ঢাকায় আসে তখনই সেই বিয়ে না হওয়ার আগের মতো ভাইদের জন্য একটু আধটু রান্না বান্না করে। ননদ হিসেবে ভাবিরা কত মানা করে। রান্না ঘরে আসার কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু শোনে না কারও কথা। বিয়ের আগে কত পদের রান্না করে ভাইদের মুখের উপর রাখত। আজ পদ না থাকলেও, যে কোন একটা আইটেমে ভাবিদের চমক দিয়ে দেয়। বিউটি ছোট বেলা থেকে মানুষ হয়েছে ঢাকায়। ঢাকার আবহাওয়ায় বড় হয়ে যাওয়া বিউটির কপালে জুটলো যশোরের জামাই। বিয়ের পর জলের মাছ ডাঙায় তোলার অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু ঘন ঘন ভাইদের যশোরে আসা যাওয়া সেই অবস্থা থেকে মুক্তি মিলেছে। এরপরও মাঝে মধ্যে ঢাকায় আসে। কয়েকদিনের জন্য এলেও, দিন গড়িয়ে যেত সপ্তাহ খানেক। এ নিয়ে জামাই অনেক সময় মনোক্ষুণ্ন হয়েছে। পরে সামাল দেয়া হয়েছে। বিউটির ঢাকায় আসা যাওয়া নিয়ে বেশ শর্ত পূরণ করতে হয়েছে। আর র্শত হচ্ছে, নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে ফের যশোর ফিরে যেতে হবে। তবে এর কারণও রয়েছে। বিরাট বাড়িতে জামাই বলতে গেলে একা। বিউটি ঢাকায় এলে তাকে অনেক সময় নিজের হাতে রান্না করে খেতে হয়। বিউটি কাজের মানুষ ঠিক করলে কি হবে, বউ ছাড়া অন্যের হাতে মুখে খাবার যেতে চায়না। এ নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা শুনতে হয় জামাইকে। রিফাত কোলে আসার পর থেকেই বিউটির মন অনেকটা পাল্টে গেল। নিজের ঘরের দিকে আরও মনোযোগী হয়ে উঠল। বিশাল বাগানে কোথায় কোথায় গাছ লাগাবে এ নিয়ে সব সময় চিন্তাভাবনা। প্রকৃতির মায়া তাকে অনেকটা আচ্ছন্ন করে ফেলে। আশপাশের মানুষজন বিউটিকে যতই দেখে ততই অবাক হয়। শহরে বড় হয়ে উঠা একটা মানুষ কিভাবে গ্রামের জীবনযাপনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিল। রিফাতের বেড়ে উঠার যতœ যে লালন করেছে, গাছপালাগুলোর দিকেও একই নজর রেখেছে। গাছের কাঠাল কিংবা কাঁচা আম ঢাকায় ভাইবোনদের কাছে পাঠানোর জন্য সব সময় ব্যস্ত থাকে। কুরিয়ার সার্ভিসে এসব পাঠানো নিয়ে জামাই কত সময় মশকরা করে। বিউটি এই সব মশকরা তেমন পাত্তা দেয় না। বরং পারলে দু’এ কথা শুনিয়ে দেয়। রিফাত বেশ ক্ষাণিকটা বেড়ে উঠার পর সে নিজেই কাঠাল, পেয়ারা নিয়ে ঢাকায় হাজির। এ সব অদ্ভুত কা- কারখানা দেখে অনেকে অবাক। এত দূর থেকে এই সব বয়ে আনা চাট্টিখানা কথা। মনের সখের কাছে বিউটির এই ধরনের আচরণ ভাইদের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা তা আর কারও বুঝতে বাকি রইল না। সেবার খবর পেল বড় আপার খুব অসুখ। খবর শুনে আর চুপচাপ বসে থাকতে পারল না। জামাইকে অনেক বুঝায়ে-শুনায়ে রাজি করাল। তবে জামাইয়ের শর্ত ছিল। আর সে শর্ত ছিল সপ্তাহখানেক বেশি থাকা যাবে না শর্ত দিয়েছিল এই ভেবে যেন বিউটি তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। কারণ বিউটি যখন ঢাকায় আসে তার সময় যেন জামাইয়ের কাছে কথা দেয়ার মনে থাকলেও, কথা আর ঠিক রাখতে পারে না। আর কারণ হলো, প্রত্যেক ভাইবোনের বাসায় থাকা চাই। আর কোন ভাইবোন একদিনের থাকাকে মেনে নিতে পারে না। বিশেষ করে বড় বোনের বাসায় এলে তো সে নিজে মেহমান না হয়ে উল্টো নিজেই মেহমানদারিতে কাজে নেমে পড়ে। বড়বোনের বাসায় থাকার পরিবেশ বিউটির খুবই পছন্দ। খোলামেলা পরিবেশে নিজের বাসার মতো চলতে ফিরতে পারে। যা অন্যদের বাসায় কেন জানি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। অন্য ভাইদের মধ্যে বাবুলের বাসায় খাওয়া দাওয়া ছাড়া আর কিছুতেই যুতসই মনে হয় না। ভাবি হিসেবে বেবীর আদর আপ্যায়ন বিউটির কাছে বেশ ভালই মনে হয় কিন্তু আরেক বড় ভাবি নিজেদের সংসার নিয়ে এতই ব্যস্ত যে, বিউটির সঙ্গে যে একটু খোশ গল্প করবে তার কোন ফুরসত নেই। যে কারণে বিউটি বেশি সময় ধরে যেথাকবে সে ইচ্ছে অনেক সময় উবে যায়। তবে ভাই মোস্তাক অনেক যতœ প্রিয়। বিউটির হাতে টাকা পয়সা আছে কিনা সে খোঁজ-খবর নিতে তার কখনও ভুল হয় না। বিউটির যাওয়া নিয়ে অনেক সময় দেরি হলে মোস্তাক জামাইকে টেলিফোনে বুঝিয়ে দেয়। আর জামাই মোস্তাকের কথা বেশ মানে। মানার একটাই কারণ, মোস্তাকের হাত ধরেই বিউটির সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তবে এই বিয়েতে বিউটির ফ্যামিলি থেকে বেশ কিছুটা আপত্তি উঠেছিল। প্রথমত জামাইয়ের বয়স বেশি। তার উপর সেই ঢাকার বাইরে। যে মেয়ে মা বাবার অনুপস্থিতিতে ভাইদের কাছে ছোটবেলা থেকে বড় হয়ে উঠেছে। সে কেমন করে ঢাকা ছেড়ে থাকবে। বিয়ের কথা যখন বিউটির কানে আসে সে অনেকটা মন খারাপ করে ফেলে। মন খারাপের একটাই কারণ, ঢাকা ছেড়ে কিভাবে থাকবে। পরে অবশ্য নিজের থেকেই বুঝতে পারে মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছে তখন একদিন না একদিন শ্বশুরবাড়ি যেতেই হবে। বিউটি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে অল্প দিনেই সবার মন জয় করে ফেলে। ফেলে আসা দিনগুলোর সাংসারিক আচার-আচরণ দিয়েই বুঝিয়ে দেয়, আসলে এটাই তার সংসার। সংসার র্ধম তার কাছে আপন মনে হলো। তবে ভাইদের কথা মনে করে মাঝে মধ্যে মন খারাপ যে করে না তা নয়। কারণ মা-বাবা হারা যে ময়েটিকে ভাইয়েরা যেভাবে মানুষ করেছে তাতে কখনও বুঝতে এতটুকু পারেনি মা-বাবার শূন্যতা। যখন মন খারাপ দেখেছে তখনই জামাই ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছে। যখন পেরেছে সঙ্গে এসেছে, আর যখন পারেনি তখন একাই পাঠিয়েছে। একমাত্র ছেলে রিফাত যখন তার শরীর নিয়ে বেড়ে উঠেছে, তখন বিউটির মনে কত না আনন্দ। ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করা থেকে শুরু করে তার পড়াশোনার সবকিছুই যেন চোখের সামনে নিয়ে এলো। মাঝে মধ্যে ভাইদের কাছে আবদার জানায় স্কুলের গ-ি পেরলে তাকে ঢাকায় নামী-দামী কোন কলেজে ভর্তির ব্যাপারে সাহায্য করে। বোনের আবদার ফেলেনি কোন ভাই। কিন্তু মাকে ছেড়ে রিফাত ঢাকায় কেমন থাকবে এই প্রশ্নও উঁকি দিয়েছে বিউটির মনে। জামাইতো কোন মতেই রাজি না। একমাত্র ছেলে তাদের ছেড়ে ঢাকায় থাকবে তা কখনও হয়? দিনে দিনে বিউটির ইচ্ছে ডানা মেললো। স্কুলের গ-ি শেষ না হতেই সে চলে এলো ঢাকায় ভাইদের কাছে। তার ইচ্ছের কথা জানাল। ইচ্ছের সঙ্গে বাস্তবতা মেলাতে চেষ্টা করল মোস্তাক। তার পড়াশোনার খরচ কে বহন করবে। কোথায় থাকবে আর মা ছেড়ে থাকবেই বা কি করে। প্রথম প্রথম বিউটি অনেক হিসাব মেলাতে চেষ্টা করল। মানুষের মতো মানুষ করতে হলে ঢাকায় রেখে পড়াশোনা করানো ছাড়া তার কোন উপায় নেই। পড়াশোনার খরচ আপাতত জামাই দেবে। কিন্তু থাকা-খাওয়ার খরচ বহন করবে কে, এই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল বিউটির মনে। এক ফাঁকে সাহস নিয়ে বলেই ফেলল মোস্তাককে। সে জানে মোস্তাকের বেশ কিছুটা মানবিক। কোন ধরনের দ্বিধা না করে মোস্তাক রাজি হয়ে গেল। আপাতত তার কাছে থেকেই পড়াশোনা করবে। পরে কোন এক হোস্টেল দেখে সেখানে রেখে দেবে। বিউটি মোস্তাকের কথা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচল। মোস্তাকের কাছে থেকে বিউটির বেড়ে উঠা থেকে শুরু করে একেবারে বিয়ে দেয়া পর্যন্ত বিষয়গুলো কারও অজানা নয়। সেই জানা থেকে মোস্তাকের কথা বিউটি বেশ মেনে চলে। তবে তার কথা হচ্ছে, সংসার আগে তারপর সবকিছু। মাঝে মধ্যে জামাইয়ের সঙ্গে কোন কোন ব্যাপারে মনোমালিন্য হয়। বিউটি রাগ করে ঢাকায় চলে আসতে চায়। কিন্তু মোস্তাক কখনও চায় না। সামান্য বিষয় নিয়ে সে ঢাকায় চলে আসুক। সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেক বিষয় নিয়ে মাঝেমধ্যে মনোমালিন্য হতে পারে। কিন্তু সেটা কখনও স্থায়ী হয় না। মোস্তাক তার নিজের সংসার থেকেই এই কঠিন শিক্ষা পেয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে বিউটি বেশ কিছুটা অসুস্থ। খবর এলো ভাইদের কাছে। জামাইকে বলাও হলো, ভাল চিকিৎসা করার জন্য। ঢাকা শহরের মতো যোশরে ভাল চিকিৎসা পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। অনেক চিন্তাভাবনার পর জামাই রাজি হলো। কিন্তু শর্ত হলো, ডাক্তার দেখিয়ে ক’দিন থেকে আবার ফিরে আসবে। ছোট ভাই লাডলা অবশ্য আগে থেকে সপ্তাহ খানেকের আভাস দিয়েছে। জামাইয়ের এতে কোন আপত্তি নেই। এরপর কখনও কখনও সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। আর পেরোলেই শুরু হয় একটু আধটু বাক বিত-া। সারা দিনে পানি নিয়ে এত কাজ করে বিউটি। জামাই কত মানা করে, এরপরও শোনে না। মাঝে মধ্যে সর্দি-কাশি নিয়ে ওষুধ খেতে বলে। কিন্তু বলে কোন লাভ হয় না। সর্দি-কাশি নিয়ে বেশ কিছুদিন ভুগলো। রীতিমতো জ্বর এলো। টানা সাতদিন পর হঠাৎ তার বুকে ব্যথা হলো। ছিমছাম উপশহরে বসবাসা করা ডাক্তারকে দেখাল। কিন্তু পুরোপুরি আর সুস্থতায় প্রাণ ফিরে পাচ্ছে না বিউটি। বায়না ধরলো ঢাকায় বড় এক প্রফেসরকে দেখাবে। বিউটির বায়নার কাছে জামাই অনেক সময় নতজানু। ঢাকায় এলো। প্রথমে কার বাসায় উঠবে,এ নিয়ে অনেক সময় তালগোল পাকিয়ে ফেলে। বড় ভাই মোস্তাক থাকে ঝিগাতলায়। আরও এক বড় ভাই থাকে ধানম-ি। আর বাবার বাসা পিলখানা তো রয়েছে। এই ভাইদের বাসায় একদিন দুদিন থাকতে থাকতে সময় কেটে যায়। দিনও চলে যায় অনেক। কিন্তু সপ্তাহ পেরিয়ে গেলে জামাইয়ের ফোনের পর ফোন। হয়ত মোস্তাক বোঝায়, আবার বাবুল বোঝাতে চেষ্টা করে আরও কিছুদিন থাকুক। শরীরটা ভাল হোক। কিন্তু এতে জামাই কিছুটা হলেও, বিরক্তি প্রকাশ করে নানাভাবে। একদিন মোস্তাক আর বাবুল নিজেই বিউটিকে চলে যেতে বলে জামাইয়ের কষ্টের কথা ভেবে। তখন আর বিউটির থাকা হয় না। চলে যেতে হলো। যেদিন চলে গেল সেদিন সবার মন খারাপ। কারণ সবাই নিজের চোখের সামনে দেখেছে আসলে বিউটির শরীর অনেক খারাপ। মনের কথা নাইবা বলল। মালিবাগে তার এক ভাইয়ের সঙ্গে বিউটির কথা হয়। কথায় কথায় বলে ফেলে তার উপশহরে যেন আর ভাললাগে না। জামাইকে যেন সে কথা বুঝিয়ে বলে, এমন অনুরোধ করেছিল। কিন্তু পারল না মুখ ফুটে বলতে। কারণ, এখন বিউটির জীবনের সব দায় দায়িত্ব তো জামাইয়ের। ঢাকায় এসে ব্যবসা বাণিজ্য করবে, সে অবস্থাও নেই। কারণ, পুরো তল্লাটের দেখাশোনার দায়িত্ব এখন জামাইয়ের ওপর। জমিজমা থেকে শুরু করে বাগান গাছ-গাছালি দেখার এখন কেউ নেই। জামাইকে বুঝতে পারে সবাই, কিন্তু মাঝে মধ্যে বিউটি হয়ে যায় বাচ্চা শিশুর মতো অবুঝ। সে কথা ভেবে ভাইদের মধ্যে আলাপ হয়। এমনকি, ছেলে রিফাত মায়ের এই অবুঝ বায়নার কাছে যেন মাঝেমধ্যে অসহায় হয়ে পড়ে। বিউটির ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়া ভাই বোনদের মনে একধরনের বিষাদের ছায়া নেমে আসে। পরে সেই ছায়া কখন যে বাস্তবে মিলিয়ে যায়, তা টের পায় না। যখন টের পায় তখন এক ঝলকে ফোনের আশ্রয় নেয়। কেমন আছিস, কি করছিস, এই বাক্যের মধ্যে আটকে যায় সবকিছু।
×