ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে ঈদ

প্রকাশিত: ০০:৫৪, ৩১ জুলাই ২০২০

করোনাকালে ঈদ

কিছু কিছু শব্দের সঙ্গে আমরা সবাই কম বেশি নতুন করে পরিচিত হয়েছি। বিশেষ করে এই করোনাকালে লকডাউন, আইসোলেশন কিংবা কোয়ারেন্টাইন শব্দগুলো। তবে প্রতিটি শব্দেই রয়েছে সময়ের দীর্ঘশ্বাস। রয়েছে বেদনা, আতঙ্ক ও নিঃসঙ্গতা। কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস নামক ভিলেনের ভয়ে যেন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সবকিছু। মনের কোণে সামান্য আনন্দটুকুও যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে। নিশ্চুপ নিঃশব্দ এক পৃথিবীর চেহারা যেন বিশ্ববাসী দেখতে পেল। থমকে গেছে জীবিকা, আর হবেই বা না কেন যেখানে জীবন বাঁচানোই দায় হয়ে পড়েছে। তবে মানুষ থেমে যেতে শিখেনি। তাই হয়ত করোনা ভয় আস্তে আস্তে মন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে। পৃথিবীকে ফিরিয়ে নিতে চাইছে স্বাভাবিক গতিতে। বহির্বিশ্বের মতো এ দৃশ্য আমাদের দেশেও বিরাজমান। উৎসবের জাতি হিসেবে বাঙালী জাতির পরিচয় নতুন নয়। তবে এই ২০২০ সালে আমাদের দেখতে হয়েছে উৎসবের ভিন্ন রূপ। করোনাকালে আমরা পার করেছি বাঙালীর সবচেয়ে রঙিন উৎসব পহেলা বৈশাখ। যেখানে পহেলা বৈশাখ আসার আগেই চারদিকে সাজ সাজ রব উঠে যায় সেখানে এবার দেখতে হয়ে পুরোই ভিন্ন রূপ। বাতিল হয়েছে বৈশাখ সংক্রান্ত যাবতীয় উৎসব। যার ফলে একদম ফেকাসে হয়েছিল উৎসবের সব রং। কোথাও লাগেনি কোন রঙের ছটা, বাজেনি কোন গান। ব্যাপারটা এমন ছিল ঘরে বসেও মানুষ মনে হয় গান শুনতে আগ্রহী হয়নি। অজানা এক আতঙ্কে কাটিয়েছে দিন। যার ফলে কোন ফাঁক দিয়ে উৎসবের দিন চলে গেল সে হিসাব মনে হয় কেউ নিতে যায়নি। মরণঘাতী এক ভাইরাস ওলোট-পালট করে দিয়েছে সব। বৈশাখী উৎসবের কিছু দিন পরেই মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর পালিত হয়েছে। সেখানেও একই চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। যে উৎসবে একজন আরেকজনের বাড়িতে যাওয়া, ভাল ভাল খাওয়ায় মেতে ওঠাই ছিল মূল চিত্র সেখানে এবার কেউ যায়নি কারও বাসায়। এমনও হয়েছে উৎসবের দিন অনেক বাড়িতে বাড়তি আয়োজনের দৃশ্যপট ছিল না। হাটা চলা ওঠা বসা সবকিছুতেই ছিল সাবধানতা ও আতঙ্কের ছাপ। এমন দৃশ্যও দেখতে হবে ভাবেনি হয়ত কেউ। কিন্তু দেখতে হয়েছে। তবে ওই যে, মানুষ হাল ছাড়ার নয়। সব ছাপিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াই যেন মানুষের মূলমন্ত্র। করোনা এখনও বিদায় নেয়নি তবে একটু একটু মানুষ বাড়িয়েছে তার মনের জোর। জয় করার চেষ্টা করছে করোনাভাইরাসকে। জীবিকার তাগিদে নেমেছে পথে। অর্থনীতির চাকা সচল করায় চেষ্টায় সরব। আর এ চেষ্টার মধ্যেই উপস্থিত হয়েছে মুসলমান আরেক ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-আজহা। তবে ঈদ-উল-ফিতরের চেয়ে ঈদ-উল-আজহার চিত্র কিছুটা ভিন্ন। যে কারণে হালকা হলেও বিরাজমান রয়েছে উৎসবের রং। পশু কোরবানি এ উৎসবের অন্যতম চিত্র। এবারও ব্যতিক্রম হবে না তবে হয়তো আগের মতো সে জোয়ার থাকবে না তারপরেও কিছুটা হলেও যে উৎসবের গতি ফিরছে সেটাই বা কম কি সে? সারা বিশ্ব এখন চেয়ে আছে করোনা ভ্যাকসিনের দিকে। কবে আবিষ্কার হয়ে কাক্ষিত ভ্যাকসিন। তবে সে আশা জিইয়ে রাখলেও বসে নেই মানুষ। মনোনিবেশ করেছে নিত্য নৈমিত্তিক কাজে। খুলে গেছে হাট বাজার। বিভিন্ন শপিংমল ঘুরে দেখা গেছে মানুষ ঈদ-উল-ফিতরে যে কেনাকাটা সারতে পারেনি এ ঈদে সেটা সেরে রাখছে। উপচেপড়া ভিড় না হলেও প্রতিটি শপিংমলে ক্রেতা বিরাজমান। সবাই মানছে স্বাস্থ্যবিধি। এটাও একটা ইতিবাচক দিক। নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরা নিশ্চিত করে নেমে পরেছে পথে। জীবন বাঁচাতে ভাইরাস থেকে যেমন দূরে থাকতে হবে তেমনি সচল রাখতে হবে জীবিকা। তাই সমন্বয় করেই জীবন চালাতে হবে। আর এ কারণেই আবার দেখা মিলছে পরিচিত মুখের। যদিও সবার মুখ মাস্ক দিয়ে ঢাকা তারপরেও মনের টানে কাছের মানুষদের চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না। কথার আদান প্রদান, ভাবের আদান প্রদান যেমন হচ্ছেÑ তেমনি সম্পাদন হচ্ছে জরুরী কাজকর্ম। আর এমনি এক মিশ্র অভিজ্ঞতায় এবার পালিত হবে ঈদ-উল-আজহা। তবে এ জীবন চালাতে জীবন বিপর্যয়ের মুখে ফেলা যাবে না। মানতে হবে সামাজিক দূরত্বসহ সরকার ঘোষিত নানা বিধি নিষেধ। তারপরেও এবারের এই ঈদে আনন্দের কিছু রেশ এখন পরিলক্ষীত। যা কিছুটা আঁচ করা যায় কেনাকাটার ধাঁচ দেখে। অনলাইন থেকে শুরু করে শপিংমল পর্যন্ত বেড়েছে ক্রেতার আনাগোনা। যদিও আশানুরূপ নয় তারপরেও এই সংকালে দৃশ্যটি ইতিবাচক। কেনাকাটার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে পোশাক। তবে অন্যান্য ঈদে মোবাইল এবং ইলেক্ট্রনিক্স এক্সেসরিজের বেশ চাহিদা থাকে কিন্তু এবারে তেমন একটা নেই। খাদ্য দ্রব্য, স্যানিটাইজার টাইপের পণ্য ও পোশাক ছাড়া আর কিছু তে তেমন চাহিদা নেই। আর যারা পশু কোরবানি দিতে মনস্থির করেছে তারা হাটে পশু পছন্দের জন্য এদিক-সেদিক দেখেছে। তবে অনলাইনে এবার পশুর দামদর করার প্রবণতা বেশ বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে পশু কেনাকাটা। দিন যত যাচ্ছে ততই মানুষ অনলাইনে বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। আর এই করোনাকালে তো কথাই নেই। এ সময়টা আরও বেশি অনলাইন নির্ভর করে তুলেছে সবাইকে। আশা করা যাচ্ছে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে এবার শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সীমিত থাকবে না। পরিবারে কাছের মানুষরা একে অন্যের বাসায় যাতায়াতও করবে। বিভিন্ন জনের মনোভাব থেকে বোঝা যায় গত রোজার ঈদের মতো একেবারেই ঘরের কোণে থাকবে না অনেকেই। দিন দিন আক্রান্ত বাড়লেও ভীতি কমে গেছে মানুষের মন থেকে। আর তাই এই সীমিত পরিসরে হলেও আনন্দের ক্ষণ ভাগাভাগি করে নিতে যোগাযোগ সৃষ্টি হবে। বারো মাসে তেরো পার্বণে অভ্যস্ত বাঙালী জাতি উৎসবের আবেশে ভেসে যেতে অভ্যস্ত। সেখানে এবার যেন বাদ সেধেছে করোনাভাইরাস। শঙ্কা কাটিয়ে এবারের ঈদে সবাই শামিল হলেও মনের এক ধরনের ভয় কিন্তু থেকেই যাবে। বলা যায় মিশ্র প্রতিক্রিয়ার এক ঈদ আনন্দ। পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দে মাতলেও হুট করেই বেরিয়ে আসবে না কেউ কোন বন্ধুর বাসা থেকে। দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা থাকলেও সচেতনতার কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠবে না। আর করোনা আক্রান্ত পরিবারে ঈদ বলে তো তেমন কিছুই থাকছে না। সেই সঙ্গে সারাদেশে বিরাজ করছে বন্যা। কিছু কিছু এলাকা তো ঈদের দিনেও থাকবে পানির নিচে। জীবন চালানোই যেখানে দায় হয়ে পড়েছে সেখানে ঈদ আনন্দের কথা ভাবাই যায় না। তাই বলা যায় আনন্দ বেদনার মিশেল এই ঈদ। তারপরেও মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। অন্ধকার দিন পেছনে ফেলে আলো আসবেই। আর সে আলোতেই সবাই গাইব জীবনের জয়গান। সেদিনই হয়ত আনন্দের পূর্ণতা ঘটবে। আপাতত সেদিনের অপেক্ষায়।
×