ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ছে ঢাকার চার নদীর পানি

মধ্য আগস্টের আগে বন্যার উন্নতি হচ্ছে না

প্রকাশিত: ২২:৩৭, ৩১ জুলাই ২০২০

মধ্য আগস্টের আগে বন্যার উন্নতি হচ্ছে না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মধ্য আগস্টের আগে দেশের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির আশা নেই। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে। এই অবস্থা আরও কিছুদিন চলতে পারে। এরপর পানি কমতে শুরু করলে মধ্য আগস্টেও আগে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। এদিকে বৃষ্টির পানি নেমে আসার কারণে আবারও কোন কোন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এদিকে রাজধানী ঢাকার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির শঙ্কা রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকার চার নদীর পানি এখনও বাড়ছে। ইতোমধ্যে তিন নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে চলেছে। আগামী ৭ দিনের মধ্যে ঢাকার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির কোন আশাও তারা দেখতে পাচ্ছেন না। এই অবস্থায় দেশে নতুন করে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসছে ভারি বৃষ্টির পানি। এ কারণে পাউবোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উজানের পানি এবং দেশের ভেতরের বৃষ্টির পানি এক হয়ে বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে। ফলে বন্যার পানি সম্পূর্ণরূপে নেমে যেতে মধ্য আগস্ট থেকে শুরু করে আগস্টের শেষ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। ফলে এবারের বন্যা মানুষের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি সহসা মিলছে না। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা তিন দফা বন্যায় দেশের ৩১ শতাংশের বেশি নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা অর্ধকোটি ছাড়িয়েছে। সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় দুর্যোগ সমন্বয় কেন্দ্রের (এনডিআরসিসি) বিশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। তারা জানায়, মৌসুমি বৃষ্টি ও ঢলের কারণে গত ২৬ জুন চলতি মৌসুমে প্রথম দফা বন্যা শুরু হয়। তখন অন্তত ১০ জেলায় বন্যার বিস্তার ঘটে। দ্বিতীয় ধাপে আরও আট জেলা প্লাবিত হয়। জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হয় তৃতীয় ধাপের বন্যা। ২৯ জুলাই পর্যন্ত সব মিলিয়ে দেশের ৩১ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বন্যায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নাটোর, টাঙ্গাইল, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নওগাঁ, রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর জেলার ২৭ পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এনডিআরসিসির তথ্য অনুযায়ী, ৩১ জেলার ১৫০ উপজেলার ৯৩৬ ইউনিয়নের ১০ লাখ ৪০ হাজার ২৬৬ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এনডিআরসিসির উপ-সচিব কাজী তাসমীন আরা আজমিরী বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বন্যায় ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৩ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে অনেক এলাকায় বন্যার প্রকোপ কমে আসায় ক্ষতিগ্রস্তদের সবাই এখন পানি বন্দী হয়ে নেই বলে জানান তিনি। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য মতে ঢাকা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, জামালপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলা বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এদিকে ঢাকা জেলার আশপাশের নদীগুলোর পানি বাড়ছে। বিশেষ করে বালু, লক্ষ্যা, তুরাগ ও টঙ্গী খালের কয়েকটি পয়েন্টে পানি এখন বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে যা আগামী ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। একই কারণে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের একেবারে কাছাকাছি এলাকাগুলোর নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির সামান্য অবনতি হতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর পানি বাড়ছে। বাড়ছে তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি। উত্তর পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি কয়েক দিন কমে এলেও আবার বাড়তে শুরু করেছে। ফলে এসব নদীর আশপাশের এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে। এদিকে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া পদ্মা ও গঙ্গা নদীর পানি এখন স্থিতিশীল আছে। যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর মধ্যে বালু নদীর ডেমরা পয়েন্টে পানি বেড়ে বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একইভাবে তুরাগ নদের মিরপুর পয়েন্টে ৮ থেকে বেড়ে ২৩, টঙ্গী খালের টঙ্গী পয়েন্টে ৫ থেকে বেড়ে ১৬ এবং লক্ষ্যা নদীর নারায়ণগঞ্জ পয়েন্টে ২ থেকে বেড়ে ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী সাতদিন নাগাদ ঢাকার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে জানান তারা। সাভার ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ধামরাইয়ে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার পরিবার। এদিকে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে সড়ক, স্কুল-কলেজ, বসতবাড়িসহ শ’ শ’ একর জমির সবজি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার ভাড়ারিয়া, কুল্লা, সূতিপাড়া, রোয়াইল, বালিয়া, সোয়াপুর, বাইশাকান্দা, যাদবপুর, সোমভাগ ও ধামরাই সদর ইউনিয়নসহ মোট ১০ ইউনিয়নের ৭ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত এসব পরিবারের খাদ্য ও কর্মের অভাবে চরম-দুর্দশার মধ্যে দিন কাটছে তাদের। বংশী, ধলেশ^রী, গাজীখালি ও তুরাগ নদের পানি ক্রমশ বাড়তে থাকায় প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে ধামরাইয়ের নতুন নতুন এলাকা। উপজেলা কৃষি অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ১৫শ’ ২০ জন কৃষকের ৫৭০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, আউশ ধান, বুনা আমন, রুপা আমন, বীজ তলা ও বিভিন্ন রকমের সবজি। তবে এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ক্ষতিগ্রস্ত সবজি চাষীরা জানান, ধামরাইয়ের বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার পরিবার সবজি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এ অঞ্চলের সবজি রাজধানী ঢাকাসহ এর আশপাশের এলাকায় সরবরাহ করা হয়ে থাকে। কিন্তু বন্যার পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব অঞ্চলের সবজি খেতগুলো তলিয়ে গিয়ে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন তারা। তাই বন্যা পরবর্তী সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতা চান এসব ক্ষতিগ্রস্ত সবজি চাষীরা। গাইবান্ধা ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়াসহ সব নদীর পানি অব্যাহতভাবে কমতে থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ফলে সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, গোবিন্দগঞ্জ, সাদুল্যাপুর ও সদর উপজেলার চরাঞ্চল থেকে পানি নেমে যাচ্ছে। এসব এলাকার বেশিরভাগ ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে গেলেও এখনও অনেক বাড়িঘর পানিতে নিমজ্জিত অবস্থায় রয়েছে। ফলে বাঁধসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়া বন্যার্তরা ঘরে ফিরতে পারছে না। এছাড়া তাদের অনেকেই আবার নতুন করে বন্যার আশঙ্কা করছে। তাই ঘরবাড়িতে ফিরে যেতে তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। জেলা প্রশাসনের দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী জেলার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, সাদুল্যাপুর, গোবিন্দগঞ্জ ও সদর উপজেলাসহ ৬ উপজেলার ৪৪ ইউনিয়নে বন্যাকবলিত হয়েছে। এসব এলাকার ২ লাখ ৫০ হাজার ৭৮৬ ব্যক্তি বন্যার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার কারণে ৩৫ হাজার ৫৫১ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে জেলা ত্রাণ দফতর জানিয়েছে এ পর্যন্ত বন্যার্তদের মধ্যে ৫১০ মে. টন চাল, ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ৫ হাজার ৬৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, জেলায় কমতে শুরু করেছে নদ-নদীর পানি। পানি কমলেও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে নিম্নাঞ্চলের অনেক পরিবার জলবন্দী হয়ে রয়েছে। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগসহ গবাদির পশুর রোগ; এসব নিয়ে বিপাকে পড়েছে বানভাসিরা। ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে বন্যা কবলিতদের। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, বৃহস্পতিবার সকালে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ২০ সেমি. ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ২২ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৩৩ পয়েন্টে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের তীব্র ¯্রােতে চিলমারী কাঁচকল এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে চিলমারী উপজেলা শহরে পানি ঢুকেছে। এতে শহরবাসী চরম দুর্ভোগে দিন কাটচ্ছে। কুড়িগ্রাম চিলমারী সড়কে শ’ শ’ পরিবার খোলা আকাশে রাত কাটাচ্ছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, বন্যার্তদের ঈদ উপলক্ষে ৪ লাখ ২৮ হাজার ৫২৫ পরিবারের মাঝে ১০ কেজি করে ভিজিএফ চাল বিতরণ চলছে। এছাড়া দু’দফা বন্যায় ৪৯২ দশমিক ৭২ মে.টন জিআর চাল, জিআর ক্যাশ ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার ৫শ’ টাকা, শুকনা খাবার ৬ হাজার প্যাকেট, শিশুখাদ্য ৪ লাখ টাকার ও গো-খাদ্য ৪ লাখ টাকার বিতরণ করা হয়।
×