ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্যবিধি মানার তোয়াক্কা নেই, নৌ-সড়কপথে সর্বোচ্চ ঝুঁকি

সারাদেশে অবারিত চলাচল

প্রকাশিত: ২২:৩৩, ৩১ জুলাই ২০২০

সারাদেশে অবারিত চলাচল

রাজন ভট্টাচার্য ॥ অন্যান্য বারের মতো এবারের ঈদে বাস-ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনালে ঘরে ফেরা মানুষের তীব্র চাপ না থাকলেও স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন সবাই। বিশেষ করে সড়ক ও নৌ-পথে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বালাই নেই। মানা হচ্ছে না সরকারের দেয়া স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা। গাদাগাদি করে করে যাত্রী পরিবহনের চিত্রও দেখা গেছে। তেমনি সড়ক পথে রাস্তায় রাস্তায় যাত্রী তোলারও খবর পাওয়া গেছে। তবে রেলপথে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট যাত্রীরা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ছেন, করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি না মানায় ঈদের পর পরিস্থিতি আবারও খারাপের দিকে যেতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে ঈদে ঘরে ফেরা নিরুৎসাহিত করা হলেও গণপরিবহন চলাচলে কোন রকম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়নি। চলাচলে অবারিত দেশ। ফলে সাধারণ মানুষ তাদের ইচ্ছেমত চলাফেরার সুযোগ পাচ্ছেন। তাছাড়া গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কি না তাও কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে না। ফলে ঘরে ফেরা মানুষসহ গ্রামের মানুষেরও পদে পদে সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েই গেছে। জানতে চাইলে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, মানুষের এভাবে যাতায়াত গ্রামে করোনাভাইরাস সংক্রমণ আরও বাড়াবে। এসব মানুষ যখন ঢাকায় ফিরবেন, তখন ঢাকায়ও সংক্রমণের তীব্রতা বাড়বে। গত ঈদের তিক্ত অভিজ্ঞতা এ কথাই বলছে। তিনি বলেন, মানুষের নিজের মধ্যে সচেতনতা আনতে হবে। ঘরের বাইরে বের হলেই পুরো সময় মাস্ক পরে থাকতে হবে। কিছু সময়ে মাস্ক পরবেন, কিছু সময় পরবেন না তা হবে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। জনগণকে মনে রাখতে হবে, সুরক্ষা নিজের জন্য। একই পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বার্থ বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে অনেক মন্ত্রীকে বলতে শুনেছি এবারের ঈদে সাধারণ মানুষকে বাড়ি না যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু গণপরিবহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অথচ অন্যান্য দেশে এখনও সপ্তাহে দুইদিন লকডাউন কার্যকর করা হচ্ছে। তাছাড়া গণপরিবহনে দ্রুত ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাই করোনায় সংক্রমিত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকি তো আছেই। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিবহন চলছে কি না তা কঠোরভাবে দেখভাল করা হচ্ছে না। ফলে সামনের দিনগুলোতে করোনার বিপদ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। ঈদযাত্রা নিয়ে গেল এক সপ্তাহে অন্তত চার দিন ঘরমুখো মানুষকে সতর্ক করে সর্বোচ্চ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ঈদযাত্রা করলে এ যাত্রাই অনেকের জন্য শেষযাত্রা হতে পারে। তিনি পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা করে গাড়ি পরিচালনা করারও আহ্বান জানান। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকি থাকায় যাত্রীদের সতর্কভাবে চলাচলের আহ্বান জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। অতি প্রয়োজন না হলে ঈদযাত্রা না করারও অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। বুধবার নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দফতর ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিপত্র (এপিএ) স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান। এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, লঞ্চ টার্মিনালে জীবাণুনাশক টানেল স্থাপন করেছি এবং তাপমাত্রা পরিমাপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। লঞ্চ মালিকরাও ব্যবস্থা নিয়েছেন। সব থেকে বড় কথা হচ্ছে- লঞ্চের নক্সা করোনার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আমরা যাত্রীদের বিনীত অনুরোধ করব- ডেকের যাত্রীদের জন্য যে মার্কিং করে দেয়া হয়েছে, সেটা যেন মেনে যাতায়াত করেন। তিনি বলেন, আমরা তো কখনও কল্পনা করিনি এ ধরনের ছোঁয়াচে রোগ আসবে। তবে ভবিষ্যতে যখন নতুন লঞ্চের অনুমোদন দেয়া হবে, তখন ছোঁয়াচে রোগ প্রতিরোধের বিষয়গুলো দেখা হবে। অরক্ষিত নৌ-পথ ॥ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নৌযাত্রীদের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম ঢাকা নদীবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, এ বন্দরে ৭টি জীবাণুনাশক টানেল থাকলেও বুধবার তা সরিয়ে নেয়া হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে প্রবেশপথগুলোয় যাত্রীদের মাস্ক আছে কি না, তা মনিটরিং করা হচ্ছে। যাদের মুখে মাস্ক নেই, তাদের বিনামূল্যে মাস্ক সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এছাড়া যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রা করতে মাইকিং করা হচ্ছে। কিন্তু ঢাকা থেকে বরিশালসহ বিভিন্ন রুটে ছেড়ে যাওয়া, চাঁদপুর, সুন্দরবন-১২, সুরভী-৯, কর্ণফুলী-১৩, কুয়াকাটা-২, মানিক-২সহ কয়েকটি লঞ্চের ডেকে যাত্রীরা সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে যাত্রা করতে দেখা গেছে। অনেকেরই মুখে মাস্ক ছিল না। জটলা পাকিয়ে গল্প করতেও দেখা গেছে। এসব লঞ্চে যাত্রীদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে লাল রঙের চিহ্ন এঁকে দেয়া হয়েছে। যাত্রী বাড়ার সঙ্গে লঞ্চের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার দিনভর লঞ্চের সংখ্যা একশ’র কাছাকাছি ছিল। আবার ডেকেও যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লঞ্চগুলোর যাত্রীরা স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনরকম তোয়াক্কাই করছেন না। কোথাও যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা দেখা যায়নি। লঞ্চ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাত্রীরা অনেক সময় স্বাস্থ্যবিধি মানতে নারাজ। তখন কারও কিছু করার থাকে না। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক বলেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে যাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করছি, মাইকিং করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা তা মানছেন, অনেক ক্ষেত্রে মানছেন না। সেক্ষেত্রে তাদের ওপর বল প্রয়োগ করাও সম্ভব হচ্ছে না। জীবাণুনাশক টানেল উঠিয়ে দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যাত্রীদের সঙ্গে শিশুও থাকে। তাদের শরীরে জীবাণুনাশক পানি ছিটালে ক্ষতি হতে পারে- এমন শঙ্কায় সেগুলো সরিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। তবে প্রবেশ গেটে যাদের মুখে মাস্ক নেই, তাদের মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে। বেশি অরাজকতা সড়কপথে ॥ বুধবার বিকেল পর্যন্ত খুব একটা যাত্রী না হলেও বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনালে ঘরমুখো মানুষের চাপ বাড়ে। বুধবার অফিস করে শুরু হয় সরকারী ছুটি। তাই চাপ সামলানোর প্রস্তুতিও আছে পরিবহন মালিকদের। মহাখালী, গাবতলী, সায়েবাদ, ফুলবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে কোন টার্মিনালেই জীবাণুনাশক টানেল সচল নেই। অভিযানের কথা শোনলে একটু সচল রাখার চেষ্টা করা হয়। খবর নেই কোন ভিজিলেন্স টিমের। মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, সৌখিন, সোনার বাংলা, এনা, অনন্যা, শাহজালাল পরিবহনসহ কোন বাস কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপার কোন ব্যবস্থা করেনি। হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেয়ারও কোন প্রস্তুতি দেখা যায়নি অনেক পরিবহন কোম্পানির। যাত্রীরা নিজ উদ্যোগে নিজেদের সুরক্ষিত রেখে গন্তব্যে ফেরার চেষ্টা করছেন। নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন রুটে বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। তেমনি গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে শ্যামলী, ডিপজল, উত্তরবঙ্গ, এস আলমসহ বিভিন্ন পরিবহন কোন রকম স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই বিভিন্ন গন্তব্যে বাস ছেড়ে যাচ্ছে। ভাল ভাল পরিবহন কোম্পানিগুলো আসনপ্রতি একজন যাত্রী নিয়ে বাস ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। মহাখালী, সায়েদাবাদ, গাবতলী টার্মিনালে নামী দামী বাস কোম্পানির গাড়ি সঙ্কট দেখা গেছে। যাত্রীদের এ কারণে দীর্ঘ সময় বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বগুড়া, নেত্রকোনা, রাজশাহী, শেরপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার যাত্রীদের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। চালকসহ হেলপারদের মাস্ক ব্যবহার না করে গাড়ি পরিচালনা করতে দেখা গেছে। অনেক টিকেট কাউন্টারে যারা টিকেট বিক্রি করছেন তাদের মুখেও মাস্ক ছিল না। যাত্রীদের ক্ষেত্রে এমন শৈথিল্যের চিত্র দেখা গেছে। জানতে চাইলে মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, যাত্রী চাপ বাড়ায় কিছুটা বিড়ম্বনা হচ্ছে। তবে বিকেল থেকে বাস আরও বাড়ানো হয়েছে। যাত্রী নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেও মানুষের ভিড়ে তা যথাযথ পালন সম্ভব হয় না। এজন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। এমন প্রেক্ষাপটে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডাঃ এএসএম আলমগীর বলেন, অন্যান্য বছরের মতো এবার ঈদে এখন পর্যন্ত গ্রামে ফেরার ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তবে কিছু মানুষ বাড়ি ফিরছেন। আজকালের মধ্যে হয়তো ভিড় আরও বাড়বে। একইভাবে ঢাকাসহ কয়েকটি স্থানে কোরবানির হাটে তেমন একটি বিশৃঙ্খলা না হলেও দেশের অন্যান্য স্থানে পরিস্থিতি ততটা ভাল নয়। কয়েকটি এলাকার কোরবানির হাটের কিছু ছবি এসেছে। তাতে ন্যূনতম সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি পালনের চিত্র নেই। এমনকি অনেকে মাস্কও ব্যবহার করছেন না। এটি সত্যিই আতঙ্কের। সংক্রমণ বাড়বে। ঈদের ১২ থেকে ১৫ দিন পর বাস্তব চিত্র পাওয়া যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডাঃ মোজাহেরুল হক বলেন, সংক্রমণ নিম্নমুখী হয়েছে, এটি বলা যাবে না। কারণ নমুনা পরীক্ষা বাড়লে আক্রান্ত বেশি শনাক্ত হয়। আর নমুনা পরীক্ষা কমলে আক্রান্ত কম শনাক্ত হয়। আবার দেখা যায়, এক জায়গায় নমুনা পরীক্ষা বেশি হচ্ছে আবার অন্য জায়গায় নমুনা পরীক্ষা কম হচ্ছে। এ অবস্থায় সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে সঠিক ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায় হলো- যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা। যেসব মানুষ এসব মানবেন না, তাদের মানাতে বাধ্য করতে হবে। এ ছাড়া সংক্রমণ কোনদিনই নিয়ন্ত্রণে আসবে না। সুতরাং, কোরবানির হাটে ভিড় কিংবা শহর থেকে গ্রামে আসা-যাওয়ার অবারিত সুযোগ দেয়া হলে সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও বাড়বেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডাঃ নজরুল ইসলাম বলেন, করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে শুরু থেকেই স্বাস্থ্য বিভাগের অব্যবস্থাপনা ছিল এবং এখনও সেটি আছে। সুতরাং, এই অবস্থায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার প্রসঙ্গ অবান্তর। একদিকে চলাচলে অবারিত গোটা দেশ। নিয়ন্ত্রণ নেই গণপরিবহনে। যারা পশু নিয়ে হাটে আসবেন তাদের মাধ্যমে যেমন রোগ আসতে পারে, একইভাবে যারা হাটে পশু কিনতে যাবেন তাদের মাধ্যমেও রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। পাশাপাশি মাংস কাটাকাটি ও মাংস সংগ্রহ যারা করবেন তাদের মাধ্যমেও রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই আগস্ট মাসে যে নিম্নমুখী সংক্রমণের কথা বলা হচ্ছে, তা বাস্তবে কাজে নাও আসতে পারে। সুতরাং, এটি সবার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে যাচ্ছে। ফেরিঘাটে ভয়াল করোনা ॥ বুধবার পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, শিমুলিয়া, কাঁঠালবাড়িসহ দেশের সবকটি ফেরিঘাটে ঘরমুখো মানুষের প্রচ- ভিড় দেখা গেছে। কোন ঘাটেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বালাই নেই। গাদাগাদি করে যাত্রী ও পরিবহন আনা নেয়া করতে দেখা গেছে। গায়ে গায়ে লেগে দাঁড়িয়ে আছেন যাত্রীরা। পারাপারের চিত্র দেখে মনে হবে করোনা চাষের উপযুক্ত জায়গা প্রতিটি ফেরি। তেমনি ফেরি সঙ্কটের কারণে অনেক ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিবহন আটকে থাকতে দেখা গেছে। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার শিমুলিয়ায় ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভিড় বেড়ে যাওয়ায় সহস্রাধিক গাড়ির জট লেগেছে। বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের এজিএম শফিকুল ইসলাম জানান, বর্তমানে তিনটি ঘাট দিয়ে ১০টি ফেরি চলাচল করতে পারছে। গত কয়েক দিনের তুলনায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বেশি গাড়ি পার করা সম্ভব হচ্ছে। তিনি বলেন, অন্যবারের তুলনায় এবার ঘাটে গাড়ির চাপ অনেক কম। তবু সহস্রাধিক গাড়ি এখনও পার হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সব ফেরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সবার আগে ব্যক্তির সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিদিনই সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করে যাচ্ছে। কিন্তু জনগণকে সেগুলো আমলে নিতে হবে। ইদানীং রাস্তাঘাটে মানুষের ভিড় বাড়ছে। যানজট বাড়ছে। এতে সামাজিক দূরত্ব ও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধির ব্যত্যয় ঘটছে। এগুলো না মানলে দেশকে কোনদিনই করোনামুক্ত করা সম্ভব হবে না। এটি যথাযথভাবে পালনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানাই। তিনি বলেন, ঈদ যাত্রায় করোনা পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। বাড়তে পারে রোগীর সংখ্যা । সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, দূরপাল্লার রুটে রাজধানীতে চলাচলকারী লোকাল বাস চলার কথা নয়। কিন্তু কেউ যদি রিজার্ভ করে নিয়ে যায় এবং স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যাত্রী বহন করে তবে ওই গাড়ির চালক ও মালিক দায়ী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এসব দেখা উচিত। রেলপথে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল ॥ টিকেট কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন, তড়িঘড়ি করে স্টেশনে প্রবেশ, যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়, গাদাগাদি করে ট্রেনে ওঠা, ঈদ এলেই এমন দৃশ্য চিরচেনা। কিন্তু চিত্র পাল্টে দিয়েছে মহামারী করোনা। ঈদযাত্রায় নেই আগের মতো ভিড়। অনলাইনে কাটা টিকেটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্টেশনে প্রবেশ করতে হচ্ছে যাত্রীদের। টিকেট ছাড়া কোন যাত্রীকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না কমলাপুর রেল স্টেশনে। এদিকে রেলওয়ে জানিয়েছে, প্রতিদিন ১২টি ট্রেনে ৪ হাজার ৮৫৪ জন যাত্রী বহন করা হচ্ছে। বাকি আসন খালি রেখে ট্রেন চলাচল করছে। সামনের দিনে এভাবেই চলবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শওকত জামিল বলেন, প্রতিটি ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছার পর জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। যাত্রীদের মাস্ক পরে যাত্রা করার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে মাইকে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর কমলাপুর স্টেশনে এমন চিত্র দেখা গেছে। প্রতিটি যাত্রী জীবাণুনাশক টানেল দিয়ে স্টেশনে ঢুকতেই টিকেট আছে কিনা তা চেক করা হচ্ছে। যাদের কাছে টিকেট আছে শুধু তারাই স্টেশনে প্রবেশ করতে পারছেন। প্ল্যাটফর্মে তেমন ভিড় নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্টেশনে যাত্রী প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার স্টেশনে অভিযানে আসে ভ্রাম্যমাণ আদালত। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, কমলাপুরে স্বাস্থ্যবিধির চিত্র সন্তোষজনক। আমরা যাত্রীদের সচেতন করেছি। তবে বেশিরভাগ মানুষ ব্যবস্থাপনায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। স্টেশন ম্যানেজার আমিনুল হক জুয়েল বলেন, মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে এবার ঈদে স্পেশাল কোন ট্রেন চালু করা হয়নি। সীমিত আকারে যে ট্রেনগুলো চালু ছিল সেগুলোই চলছে। এখন ১২টি ট্রেন চালু আছে। এগুলো সময়মতো আসছে এবং সঠিক সময়ে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাচ্ছে। আজ ১২টি ট্রেন ঢাকা থেকে ছেড়ে যাবে। তিনি বলেন, আগামীকাল থেকে ঈদ উপলক্ষে সরকারী ছুটি শুরু হবে। আজ বিকেল থেকে যাত্রীর চাপ বাড়বে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। এ জন্য আমরা স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনসহ সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। বাড়তি চাপ সামলাতে আমরা অতিরিক্ত কর্মী নিয়োজিত করেছি। এছাড়া র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের নিরাপত্তাজনিত সব ধরনের সহযোগিতা করছে। বিকল্প পথে যাত্রা আর ভোগান্তি ॥ যারা একটু বেশি সচেতন তারা ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে ফিরেছেন গ্রামের বাড়ি। বিশেষ করে করোনার কারণে এ্যাপ ভিত্তিক যানবাহনগুলো এখনও চলাচলের অনুমোদন পায়নি। কিন্তু বসে নেই সেসব বাহনের চালকরা। চুক্তি ভিত্তিক ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করছেন তারা। তাই সকাল থেকে মাইক্রো ও প্রাইভেটকারে বিভিন্ন গন্তব্যে নগরবাসীকে গ্রামের পথে যাত্রা করতে দেখা গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-ময়মনসিংহসহ উত্তরাঞ্চলের রুটে এমন চিত্র বেশি দেখা গেছে। তাছাড়া বিকেলের পর থেকে গাবতলী বাস টার্মিনালে বাড়তে থাকে মানুষের স্রোত। বাস সঙ্কটের কারণে টিকেট কাটার রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়। গাবতলী-পাটুরিয়া রুটে পথে পথে বাসে জন্য যাত্রীদের অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। একটু পর পর মানুষের জটলা দেখা যায়। অনেকে গাড়ি না পেয়ে ভেঙ্গে বাড়ির উদ্দেশে ছুটে চলেন। আবার কেউ কেউ চলতি গাড়িগুলোতে থামানোর চেষ্টা করেন। কেউ হেঁটে যাত্রা শুরু করেন। একই চিত্র দেখা গেছে, ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল রুটেও। গাবতলী, নবীনগর, সাভার, আশুলিয়া এলাকায় গার্মেন্টস ছুটি হওয়ায় গাড়ির জন্য দীর্ঘ সময় যাত্রীরা দাঁড়িয়েছিলেন। ফলে গাবতলী থেকে পাটুরিয়া ঘাট পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হয়। থেমে থেমে চলে গাড়ি। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত যানজটের খবর পাওয়া গেছে।
×