ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কুতুবদিয়া খাদ্য গুদামের সব চাল বিক্রি ॥ তদন্ত কমিটি

খাদ্য কর্মকর্তা উধাও

প্রকাশিত: ২১:২৮, ৩১ জুলাই ২০২০

খাদ্য কর্মকর্তা উধাও

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ আশ্চর্য হলেও সত্যি, খাদ্যগুদাম খালি করে দিয়ে উধাও হয়ে গেছে কুতুবদিয়ার খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা। কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় সাড়ে তেরো হাজার পরিবারের মাঝে ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দুস্থদের খাদ্য সহায়তা প্রদান করতে হিমশিম খাচ্ছে উপজেলা প্রশাসন। জেলার প্রতিটি উপজেলার দুস্থ পরিবার ঈদের আগে ভিজিএফের চাল পেলেও খাদ্য কর্মকর্তার দুর্নীতির কারণে কুতুবদিয়াবাসীর কপালে দুঃখ নেমে এসেছে। গুদামভর্তি ভিজিএফ, ভিজিডি ও সরকারী ত্রাণসামগ্রীসহ গরিবের চাল বিক্রি করে খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা উধাও হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। জানা যায়, কুতুবদিয়া উপজেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা পলাশ পাল চৌধুরী দুই সপ্তাহ আগে হঠাৎ নিখোঁজ হন। সরকারী অফিসেও আসেন না, অফিসের অন্য কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগও করেন না। উর্ধতন কর্মকর্তার কাছ থেকে ছুটিও নেননি বলে জানা গেছে। ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানরা বন্যাকবলিত, বিভিন্ন দুর্যোগ আক্রান্ত এবং দুস্থ পরিবারগুলোর মধ্যে চাল বিতরণ করতে খাদ্য অফিসে যোগাযোগ করলে ঘটনা জানাজানি হয়ে পড়ে। এতে জনপ্রতিনিধিরা জানতে পারেন যে, খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা দুই সপ্তাহ ধরে উধাও। এ ঘটনা অবহিত হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক বরাবরে জরুরী পত্র ইস্যু করেন। জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন কুতুবদিয়ার ইউএনও’কে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এবং কুতুবদিয়ার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। এদিকে গত তিনদিন ধরে তদন্ত কমিটি খাদ্যগুদামসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তদন্ত করে চলছে। জেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তাও গত দুইদিন ধরে ঘটনাস্থল তথা খাদ্যগুদাম পরিদর্শন ও কুতুবদিয়ায় যাওয়া আসা করছেন। বুধবার আপাতত একজন কর্মকর্তাকে কুতুবদিয়ার খাদ্যগুদামে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা বাদী হয়ে তার অধীনস্থ কর্মকর্তা পলাশ পাল চৌধুরীসহ ছয়জনকে আসামি করে কুতুবদিয়া থানায় এজাহার দিয়েছে। মামলায় কুতুবদিয়ার খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা ছাড়াও নাইটগার্ড, কক্সবাজারের হিমায়ন সী ফুডসের স্বত্বাধিকারি দিলরুবা ও কক্সবাজারস্থ মোহনা এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটর সেলিম রেজাসহ আসামির সংখ্যা ছয়জন। উল্লেখিত ব্যক্তিগণ খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা পলাশ পালের সঙ্গে যোগসাজশে সরকারী চাল আত্মসাত করেছে বলে এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। এখানে অবাক হওয়ার মতো বিষয় কুতুবদিয়া খাদ্যগুদামে যেখানে সরকারের বিভিন্ন প্রোগ্রামের বরাদ্দের শত শত মে.টন চাল থাকার কথা, সেখানে আছে মাত্র চার টন চাল। সরকারী বিভিন্ন প্রকল্পের নামে বরাদ্দ এবং কক্সবাজার জেলা খাদ্যগুদাম থেকে ডেলিভারি হওয়া শত শত মে.টন চালের হদিস নেই। কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জিয়াউল হক মীর বলেন, গত ২৫ জুলাই থেকে উপজেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তার কোন হদিস নেই বলে খবর আসে। আমি তৎক্ষণাৎ জেলা প্রশাসককে অবহিত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণার্থে পত্র প্রেরণ করি। জেলা প্রশাসক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। ওই কমিটি তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সরেজমিনে তদন্তকালে গুদামে যা থাকার কথা, সে পরিমাণ চাল নেই বলে জানিয়ে ইউএনও আরও বলেন, ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে কুতুবদিয়া উপজেলার ১৩ হাজার ৫২০ পরিবারের জন্য ভিজিএফ চাল বরাদ্দ আসে ১৩৪.৭ মে.টন। গুদামে তল্লাশি করে দেখা গেছে, ওই সমপরিমাণ চাল সেখানে রক্ষিত নেই। তারপরও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় বিভিন্ন উপায়ে দুস্থদের মধ্যে চাল বিতরণ করার চেষ্টা চলছে। জানা গেছে, গত ২০১৭ সালের ৩১ মার্চ পলাশ পাল চৌধুরী কুতুবদিয়ায় খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। তিন বছরের বেশি সময় ধরে পলাশ পাল ব্যাপক দুর্নীতি ও ভিজিএফ, ভিজিডি, টিআর কাবিখা ও বিভিন্ন প্রকল্পের সরকারী চাল লুটপাট করে গেছেন। এছাড়াও অফিসের ভুয়া বিল-ভাউচার জমা করে হাতিয়ে নিয়েছেন সরকারের হাজার হাজার টাকা। গোপনে আঁতাত থাকায় জেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা এসব দুর্নীতি-পুকুর চুরির তথ্য জেনেও তাকে কুতুবদিয়ায় বহাল তবিয়তে রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও কক্সবাজারের খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) দেবদাশ চাকমার সঙ্গেও তার গোপন আঁতাত ছিল বলে তথ্য মিলছে। কুতুবদিয়ার কার্ডপ্রাপ্তরা মাসিক ৩০ কেজি করে ভিজিডি চাল পাবার স্থলেও খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা পলাশ পালের কারণে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে কুতুবদিয়ার খাদ্যগুদাম কর্মকর্তাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানরা ইউএনও’কে অবহিত করলে উপজেলার সর্বত্র ঘটনা জানাজানি হয়ে পড়ে। কেউ কেউ বলেছেন, সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে গেছে কুতুবদিয়ার খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা পলাশ পাল চৌধুরী। জেলা খাদ্য কর্মকর্তা বলেন, কুতুবদিয়া খাদ্যগুদামে বরাদ্দের চাল রক্ষিত থাকার কথা ১৯২ টন। তবে সেখানে সমপরিমাণ চাল নেই। পাশাপাশি আরও কি কি ঘাপলা আছে, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কুতুবদিয়া থানার ওসি একেএম শফিকুল আলম চৌধুরী বলেন, জেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তার এজাহার পেয়ে থানায় জিডি করতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এজাহারটি দুর্নীতি দমন ব্যুরো (দুদক) বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছে। দুদক কর্মকর্তা বাদী হয়ে মামলা দিলে পুলিশ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। জেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা আপিফ আল মাহমুদ ভূঁইয়া বৃহস্পতিবার দুপুরে বলেন, কুতুবদিয়া খাদ্যগুদাম কর্মকর্তার দুর্নীতির বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ওই গুদামটি সিলগালা করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ইউএনও’র সভাপতিত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির উপস্থিতিতে তালা খোলা হয়েছে। মামলার আসামি হিমায়ন সী ফুডসের দিলরুবার পক্ষে প্রতিনিধি জানে আলম বলেন, পরিবহন ঠিকাদার হিসেবে ৩০ জুনের মধ্যে ২৫০ টন চাল আমি কুতুবদিয়া খাদ্যগুদামে পৌঁছে দিয়েছি। মাল বুঝে পাবার রিপোর্টও জমা আছে। উল্লেখ্য, ঈদের আগে দুস্থদের মাঝে চাল বিতরণ করতে বৃহস্পতিবার ২০০ মে.টন বরাদ্দের ১১২ মে.টন চাল কুতুবদিয়ায় পৌঁছেছে বলে জানা গেছে।
×