ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রুহুল আমিন ভূঁইয়া

সিনেমাশূন্য ঈদ, চলছে কাদা ছোড়াছুড়ি

প্রকাশিত: ২৩:৫৬, ৩০ জুলাই ২০২০

সিনেমাশূন্য ঈদ, চলছে কাদা ছোড়াছুড়ি

টানা পাঁচ মাস ধরে সিনেমার শূটিং নেই বিএফডিসিতে। গেল ঈদে প্রেক্ষাগৃহে ছিল না নতুন পুরনো কোন ছবি। করোনা সবার জন্যই মহামারী। এর ওপর আবার যোগ হয়েছে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি। তাই এ পরিস্থিতিতে হল খোলার আপাতত সিদ্ধান্ত নেই বলে জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। ফলে এই ঈদেও ছবি শূন্যই থাকছে সিনেমা হলগুলো। এতে ক্ষতিগ্রস্ত মালিক ও কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা প্রকাশ পেয়েছে। শূটিং না থাকলেও অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগে মুখর চলচ্চিত্রের আঁতুরঘর এফডিসি। চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের সাক্ষী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বলছেন কাদা ছোড়াছুড়ি না করে চলচ্চিত্রের এ সঙ্কটে এক হয়ে কাজ করা। সিনেমার স্বার্থ বিরতি কর্মকা- ও অনিয়মের অভিযোগে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বয়কট করেছে চলচ্চিত্রের ১৮ সংগঠন। একই অভিযোগে কয়েক মাস আগে বয়কট করা হয় শিল্পী সমিতির সভাপতি দর্শকপ্রিয় তারকা মিশা সওদাগরকে। তার পর পরই উত্তপ্ত হয় এফডিসি আঁতুরঘর। চলচ্চিত্রের নির্মাণ ব্যয় কমানোর জন্য চলচ্চিত্রের সব সংগঠন মিলে শিল্পীদের কনভেন্স বাতিল করা হয়। জায়েদ খান শিল্পীদের নেতা হিসেবে দায়িত্বের জায়গা থেকে ১৮ সংগঠনের এই সিদ্ধান্তকে না মানার জন্য শিল্পীদের খুদে বার্তা পাঠান। যার কারণে অভিযোগ এনে বয়কট করা হয়। যদিও আঠারো সংগঠন উল্লেখ করেছে ব্যক্তি মিশা-জায়েদকে বয়কট করেছেন। কিন্তু জায়েদের প্রশ্ন হচ্ছে শিল্পীদের নেতা হিসেবে তারা খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন তাহলে নেতা মিশা-জায়েদ নয় ব্যক্তি মিশা জায়েদ বয়কট কেন? এও তারা বলছেন ব্যক্তি মিশা-জায়েদ হলে নেতা মিশা-জায়েদকে কেন তারা পদত্যাগ করতে বলছেন? যদিও নিয়ম অনুযায়ী এক সমিতি অন্য সমিতির পদত্যাগ কখনই দাবি করতে পারে না। তার পরও আঠারে সংগঠন মিশা-জায়েদের পদত্যাগ দাবি করছেন। তারপর সমঝোতা করবেন। এদিকে, এফডিসির সামনে মানববন্ধন করে গত নির্বাচনে ভোটাধিকার হারানো ১৮৪ জন শিল্পী। তবে এ মানববন্ধনে দেখা যায় অনেক অচেনা মুখ। মানববন্ধনে অংশ নেয় নামের আগে নায়ক যুক্ত করা হিরো আলম। যিনি কিনা শিল্পী সমিতির সদস্য না। আলমের মানববন্ধনে অংশ নেয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ করে গোটা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে। একই দিনে ১৮ সংগঠনের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি। যেখানে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন মিশা-জায়েদ। চলচ্চিত্রর আঠারো সংগঠনের দাবি তারা শিল্পী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বয়কট করেননি করেছে ব্যক্তি মিশা-জায়েদ খানকে। তবে তাদের বয়কট নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন কারণ, যে কোন শিল্পীকে কারণ দর্শানোর চিঠি দিলে তা সাত দিনের মধ্যে জবাব দেয়ার নিয়ম থাকলেও আঠারো সংগঠন চিঠি দেয়ার তিন দিনের মাথায় বয়কট করে সমালোচনার মুখে পড়েন। যে দিন সংবাদ সম্মেলন করে জায়েদকে বয়কট করা হয় সেদিন জায়েদ ছিলেন প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোরের শেষ কৃত্যতে রাজশাহীতে। চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া শত শত গান সুপার হিট হয়েছে যা এখনও মানুষের মুখে মুখে। সেই দেশ বরেণ্য শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের শেষ কৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাননি শিল্পী সমিতির প্রতিনিধি ছাড়া অন্য কেউ। তবে করোনার কারণে অংশ নিতে পারেননি বলে জানান পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন। সারা দুনিয়া করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করছে, তার ওপর দেশের তিন ভাগের এক ভাগ অঞ্চল বন্যাকবলিত, দেশের সব সিনেমা হল বন্ধ। সিনেমা পাড়ায় শূটিং-ডাবিং নেই বললেই চলে। আর তখন কিনা নিজেরা নিজেরা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছেন। দীর্ঘ দিন ধরে সিনেমা হল বন্ধ। অনেক হলই নতুন করে খোলার সম্ভাবনা নেই সেখানে হল খোলা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। সবাই ব্যস্ত কাদা ছোড়াছুড়ি নিয়ে। মঙ্গলবার (২৮ জুলাই) প্রযোজক সমিতির নির্বাচনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। অথচ নির্বাচনের আগে সিনেমা নির্মাণের অনেক কথা বললেও এক বছরের ফলাফল শূন্য। এখানে যত না সিনেমা হচ্ছে তার চেয়ে সংগঠন বেশি। সিনেমার উন্নয়নের চেয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি বেশি। অসংখ্য ছবির অভিনেতা মিশা সওদাগর বলেন, চলচ্চিত্রর সবাই আমরা একটা পরিবার। চলচ্চিত্রকে মানব শরীরের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। চলচ্চিত্রের আত্মা প্রযোজক, মাথা পরিচালক আর অভিনেতারা হচ্ছে চোখ। শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গ হলো, নৃত্যপরিচালক, ক্যামেরাম্যান, মেকআপ ম্যানসহ অন্যরা। এদের কাউকে বাদ দিয়ে সিনেমা হবে না। প্রযোজক অর্থ লগ্নি করেন। পরিচালক মেধা ও চিন্তার প্রকাশ ঘটান। সেই চিন্তা পর্দায় ফুটিয়ে তোলেন অভিনেতারা। শরীরের কোনো অংশ বাদ দিয়ে মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে না। তেমনি চলচ্চিত্রের কোন অংশ বাদ দিয়ে পরিপূর্ণ সিনেমা হবে না। তাই আমি এখন যাই বলব, তাতেই কোন না কোন অংশ কাটা পড়বে। কাটা শরীর নিয়ে কথা বলতে চাই না। তবে চলচ্চিত্রের এই কাটা শরীর দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে বলে মিশা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। চলচ্চিত্র না থাকলেও চলচ্চিত্র তৈরির তীর্থস্থান বিএফডিসি উত্তাপ্ত। এফডিসির মানুষেরা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এবং বিভক্ত হয়েছেন। দর্শকদের মনে এতে নেতিবাচক ধারণা জন্ম হচ্ছে। স্থবির বিএফডিসিতেও থেমে নেই কাদা ছোড়াছুড়ি, সঙ্কট মোকাবেলায় এক যোগে কাজ করার আহ্বান জ্যেষ্ঠদের। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা ববিতা বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে অবগত নই। তার পরও বলব কোন বিভাজন থাকা উচিত নয়। আমাদের সময় চলচ্চিত্রের সবাই একটা পরিবারের মতো ছিলাম। সেই পরিবারের মতো আমরা কেন থাকতে পারছি না আমি নিজেও বুঝতে আছি না। এ সব কাদা ছোড়াছেড়ি শুনলে খুব খারাপ লাগে। যখনই জানতে পাই মনটা খারাপ হয়ে যায়। সবারই একত্রে চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবতে হবে। চলচ্চিত্রের উন্নয়নের কথা চিন্তা করতে হবে।’ দীর্ঘদিন থেকে যেখানে নেই নতুন সিনেমার শূটিং, বন্ধ সিনেমা মুক্তিও। অন্যদিকে ভাঙ্গা হচ্ছে এফডিসির তিন চার নম্বর ফ্লোর। সেখানে তৈরি হচ্ছে পনেরো তলা বিএফডিসি কমপ্লেক্স। চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সাক্ষী এ কমপ্লেক্স ভাঙ্গা নিয়ে নেই কারও মাথাব্যথা। এমন একটা অবস্থায় দাঁড়িয়ে এমন কাদা ছোড়াছুড়িকে অযৌক্তিক বলছেন সিনিয়র শিল্পীরা। তাঁরা মনে করেন নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি না করে সমঝোতা করে যে যার কাজ শুরু করুক। এসব কাদা ছোড়াছুড়ির পক্ষে নন আলমগীর। তিনি মনে করেন কাদা ছোড়াছুড়ি না করে চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবলে ভাল হয়। টানা পাঁচ মাস সিনেমার কোন কার্যক্রম না থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন সিনেমার হাজারও কলাকুশলী। এমন বাস্তবতায় সিনেমার উন্নয়নের চিন্তা না করে সমিতিগুলোর এমন বির্তকিত হওয়াকে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য অশনিসঙ্কেত বলছেন চলচ্চিত্রের সিনিয়র শিল্পীরা।
×