ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তিন ফুটবলারের দুঃখগাথা...

প্রকাশিত: ০০:৫০, ২৯ জুলাই ২০২০

তিন ফুটবলারের দুঃখগাথা...

প্রাণঘাতী মহামারী করোনাভাইরাসের আক্রমণে আজ পুরো বিশ্বই স্থবির। ব্যবসা-বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, শিক্ষাঙ্গন, ক্রীড়াঙ্গন ... সবই মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও তাই। বিশেষ করে খেলাধুলার অবস্থা বড়ই সঙ্গীন। জনপ্রিয় খেলা ফুটবলে সবধরনের লীগ এবং গোটা ফুটবল মৌসুমই পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। ফলে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল), বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লীগ (বিসিএল), প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগ এবং পাইওনিয়ার লীগ ... সব লীগের সব ফুটবলারেরই উপার্জন এখন বন্ধ। তাদের অনেকেই আর্থিক দুর্দশার মধ্যে পড়েছেন। জনকণ্ঠ চেষ্টা করেছে ঘরোয়া ফুটবলের শীর্ষ তিনস্তরের তিন লীগের তিন ফুটবলারের কষ্ট ও দিনাতিপাতের আদ্যোপান্ত জানতে। ওমর শরীফ রিয়াদ। ২০১৭ সালে ঢাকার ল্যাব এইড হাসপাতালের ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসায় কিডনিজনিত সমস্যায় মরতে বসেছিলেন এই গোলরক্ষক। ভুল চিকিৎসার কারণে শুধু ক্যারিয়ারই নয়, এই কৃতী গোলরক্ষকের জীবনই হয়ে পড়ে সঙ্কটাপন্ন। ভারতে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা করে প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন হয় বেশ কয়েক লাখ টাকার। অথচ হাতে পর্যাপ্ত নেই টাকা। চোখে ঘোর অমানিশা। হৃদয়ে বেঁচে থাকার সুতীব্র আর্তি ও বাসনা। ঢাকা আবাহনী, মুক্তিযোদ্ধা, ব্রাদার্স, শেখ রাসেল ও শেখ জামালের মতো বড় দলে এক সময় খেলা সেই মৃত্যুপথযাত্রী রিয়াদকে নিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে কাজ হয়। রিয়াদকে সাহায্য করতে অনেকেই এগিয়ে আসেন। চিকিৎসা করে শুধু সুস্থই হননি, মাঠে নেমে আবারও প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলাতেও ফেরেন নেত্রকোনার ছেলে। সর্বশেষ তিনি খেলেছেন বিপিএলের দল রহমতগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবে। খেলা না থাকায় এখন পুরোপুরি বেকার-অলস জীবন কাটাচ্ছেন রিয়াদ। আয় নেই, তাই মনে কোন সুখও নেই। দুশ্চিন্তায় কাটছে দীর্ঘ দিবস আর রজনী। মোহাম্মদ ফারুক। বয়স ২২। সর্বশেষ খেলেছেন বিসিএলের দল ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবে। দেড় লাখ টাকা পারিশ্রমিক ছিল। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। থাকেন ঢাকার আরামবাগে। প্লেয়িং পজিশন ডিফেন্ডার। রাইট ও লেফটব্যাক দুই জায়গাতেই সমান পারদর্শী। করোনার কারণে লীগ বাতিল হয়ে যাওয়াতে তারও আয়-উপার্জন পুরোপুরি বন্ধ। তিনি পরিবারের একমাত্র সন্তান। বাবা-মা দু’জনই গ্রামে থাকেন। তাদের বয়স হয়ে গেছে, কিছু করেন না। ফলে ফারুকই তাদের ভরসা। কিন্তু ফুটবল খেলা বন্ধ, আয়ও বন্ধ। তাহলে নিজের কিভাবে চলছে? বাবা-মাকেই বা কিভাবে সাহায্য করছেন? ‘বন্ধু-বান্ধবদের কাছে ধারদেনা করেই নিজে চলছি, বাড়িতেও টাকা পাঠাচ্ছি। এভাবে ধার করে ইতোমধ্যেই দেড় লাখ টাকা ঋণ করে ফেলেছি। এদিকে আরামবাগে যে বাসায় থাকি সেটারও ভাড়া বাকি পড়ে গেছে চার মাসের মতো। বাড়িওয়ালা প্রতিনিয়ত ভাড়া চেয়ে চাপ দিচ্ছে। কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি।’ ফারুকের অসহায় ভাষ্য। ফাহিমউদ্দিন সোহেল। বয়স ১৯। তিনি খেলেন প্রথম বিভাগের দল পিডব্লিউডির হয়ে। খেলেন উইঙ্গার পজিশনে। নিবাস চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে। সোহেলরা তিন ভাই, দুই বোন। তিনি সবার বড়। বোনদের বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। মেজো ভাই জুয়েল হোসেনও একসময় ফুটবল খেলতেন চট্টগ্রামের কালারফুল ক্রীড়া সংঘের হয়ে। সোহেলও এই ক্লাব দিয়েই ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। তাদের দুই ভাইয়েরই ফুটবল গুরু একজনÑ এমএ রহিম। পিডব্লিউপির হয়ে ৬০ হাজার টাকায় চুক্তি হলেও সোহেলের উদ্ভাসিত নৈপুণ্যের কারণে ক্লাব তাকে ১৫ হাজার টাকা বেশি দিয়েছিল। এখন খেলা নেই, আয়ও বন্ধ। তাহলে সংসার চলছে কি করে? সোহেল বলেন, ‘ছোট ভাই জুয়েল এখন মালামাল পরিবহনের ট্রাক ড্রাইভার। সে আমাকে কিছু দিয়ে সাহায্য করে যাচ্ছে। কিন্তু এতে তো চলে না। এমনই অর্থকষ্টে পড়েছি যে, লজ্জায় কাউকে কিছু বলতেও পারছি না! লীগটা যদি চালু থাকত তাহলে বেঁচে যেতাম। মনেপ্রাণে চাইছি যেন খুব শীঘ্রই নতুন মৌসুমের লীগটা আবারও শুরু হয়।’
×