ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

‘এখনি অন্ধ, বন্ধ কোর না পাখা’

প্রকাশিত: ২১:১৯, ২৯ জুলাই ২০২০

‘এখনি অন্ধ, বন্ধ কোর না পাখা’

রবীন্দ্রনাথ তার এক বিখ্যাত কবিতায় লিখেছিলেন, ‘হায়রে আমার ভাগ্যরাতের তারা/ নিমেষ গণন হয়নি যে তার সারা।’ আমি বিশ্ব ইতিহাসের দিকে চেয়ে ভাবি, তারও ভাগ্যরাতের তারার নিমেষ গণনা শেষ হয়নি। কত কোটি কোটি বছর কেটে গেল। অথচ পৃথিবীর মানুষের ভাগ্য অপরিবর্তিত। কোটি বছর ধরে মানুষের একই অভ্যাস। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘সুখিরা হেসেছে দুখিরা কেঁদেছে/ প্রেমিক যে জন/ভালো সে বেসেছে আজি আমাদেরই মতো।’ শুধুই আবর্তন। পৃথিবী পরিবর্র্তিত হচ্ছে না। যে পরিবর্তন, তা সভ্যতার পরিবর্তন। এই পরিবর্তন চেহারার। চরিত্রের নয়। মানুষ আগের মতোই ভালো মন্দে মিশ্রিত। ভালোর সংখ্যা কম। মন্দের সংখ্যা বেশি। মানুষের মধ্যে রয়েছে হিংস্রতা, বন্যতা, অত্যাচার ও বর্বরতা। নারী ধর্ষণ। প্রতিবেশীর সম্পদ অপহরণের লিপ্সা। যুগে যুগে সুখীরাই সুখী হন। দুঃখীদের কান্নার শেষ নেই। সুখীরা বার বার জেতে। দুঃখীরা বার বার পরাজিত হয়। কখনো সখনো যদি তারা জেতে, তাদের জয় ছিনতাই হয়ে যায়। এই দুখী মানুষদের ভাগ্য ফেরাবার জন্য বহু নবী ও মহাপুরুষ এসেছেন যুগে যুগে। আবার রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি, তাদের আমরা ‘ব্যর্থ নমস্কারে ফিরিয়ে দিয়েছি।’ খ্রিস্টের জন্মের আগের কথা, বুদ্ধের জন্মের আগের কথা আমরা বাদ দিলাম। খ্রিস্টের জন্মের দু’হাজার বছরের ইতিহাস কি বলে? এখন মানুষ সভ্য হয়েছে। কিন্তু অসভ্য আচরণ ছাড়েনি। অসভ্য যুগে রাবন এক সীতাকে হরণ করেছিল। সভ্য যুগে কত লক্ষ সীতাকে হরণ করা হয়েছে, নির্যাতন ও ধর্ষণ করা হয়েছে; তার প্রকৃত ইতিহাস কোথায়? এক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিন থেকে চার লাখ বাঙালী নারী পাকিস্তানের হানাদারদের হাতে ধর্ষিতা হয়েছে। এখনো ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে চলছে ভারতের দখলদার সৈন্যদের হাতে অগণিত কাশ্মীরী নারীর ধর্ষণ ও নির্যাতন। আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ সভ্যতার বর্বরতার কথা আর নাই তুললাম। আবারও রবীন্দ্রনাথের কথায় আসছি। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আমাদের মুখে ভাষা জোগাবার কেউ নেই। তিনি সভ্য যুগের মানুষকে হিংস্র জন্তুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি তাদের যুদ্ধ হুঙ্কারকে ‘মানুষ-জন্তুর হুহুল্কার’ বলে বর্ণনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সঙ্কট’ নিবন্ধে পাওয়া যায় এ যুগের সভ্যতার চেহারা। বর্তমান যুগকে বলা হয় আধুনিক সভ্যতার শীর্ষ যুগ। এ যুগের চার্চিল, হিটলার, বুশ, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্বরতা কি অতীত যুগের চেঙ্গিস, হালাকু, তৈমুর লংয়ের বর্বরতা ছাপিয়ে যায়নি? তৈমুর লং রাশিয়া আক্রমণ করেছিলেন। নাম নিয়েছিলেন সোর্ড অব গড বা ঈশ্বরের তরবারি। তার হামলায় রাশিয়ার মানুষ রাস্তায় নেমে কান্না শুরু করে ছিল, ‘ভগবানের মা, আমাদের রক্ষা করো’। এই তৈমুরও কি এ যুগের ট্রুম্যান কর্তৃক জাপানে এটম বোমা মেরে এক রাতে দশ লাখ নর-নারী ও শিশু হত্যার কথা ভাবতে পারতেন? নাদির শাহের দিল্লী লুণ্ঠন এবং গজনীর সুলতান মাহমুদের সোমনাথের মন্দির লুণ্ঠনের বর্বরতা কি বর্তমান যুগে দখলকার মার্কিন সেনাদের চার হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার সাক্ষী বাগদাদ লুণ্ঠন ও ধ্বংস করার বর্বরতার সঙ্গে তুলনীয়? সে যুগে যারা বর্বরতার শীর্ষ নায়ক ছিলেন তারা এখন আবার রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘শিশুপাঠ্য ইতিহাসে মুখ লুকিয়েছেন।’ বর্তমানের অত্যাচারীরাও একদিন শিশুপাঠ্য ইতিহাসে মুখ লুকাবেন। আসবেন নতুন অত্যাচারীরা। আগের ইতিহাস থেকে তারা শিক্ষা নেবেন না। বার্নার্ড শ’ বলেছেন, ‘ইতিহাসের সবচাইতে বড় শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ কখনো শিক্ষা নেয় না।’ আইয়ুবের ইতিহাস থেকে কি শিক্ষা নিলেন জিয়াউর রহমান? জিয়াউর রহমানের হত্যাকা- থেকে কি শিক্ষা নিলেন এরশাদ? জর্জ বুশ জুনিয়রের ব্যর্র্থতা থেকে কি শিক্ষা নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প? তিনি হুমকি দিয়েছেন আগামী নবেম্বর মাসের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে হেরে গেলে তা তিনি মেনে নেবেন না। মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য এত বড় হুমকি আর কেউ দেয়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে আটলান্টিকের এক যুদ্ধ জাহাজে ব্রিটেনের তখনকার প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাক্কলিন ডি রুজভেল্ট এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। আগের লীগ অব নেশনসের বিশ্ব শান্তি রক্ষায় ব্যর্থতাগুলো মনে রেখে বিশ্বে শান্তি স্থায়ী করা এবং গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে নতুন জাতিসংঘ গঠনের সিদ্ধান্ত এই বৈঠকে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ভারতসহ ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোকে স্বাধীনতা দান এবং দেশগুলোতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে কোন আলোচনায় চার্চিল রাজি হননি। আটলান্টিকের বৈঠকে রুজভেল্ট অবিভক্ত ভারতকে স্বাধীনতা দানের জন্য চাপ দিয়েছিলেন। চার্চিল বলেছিলেন, ‘ভারতের মানুষ এখনো স্বাধীনতা লাভের যোগ্য হয়নি। তা ছাড়া আমি ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যকে নিলামে তোলার জন্য ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হইনি।’ পৃথিবীতে শান্তি ও গণতন্ত্র স্থায়ী করার লক্ষ্যে চার্চিল ও রুজভেল্ট মিলে একটি চার্টার তৈরি করেন। এই চার্টারের নাম আটলান্টিক চার্টার। এক পশ্চিমা প-িত বলেছিলেন, বিশ্বে একদিন ম্যাগনাকার্টার মতো আটলান্টিক চার্টার মানব মুক্তির সনদ বলে বিবেচিত হবে। ‘হায়রে আমার ভাগ্যরাতের তারা।’ কোথায় আজ সেই আটলান্টিক চার্টার। রুজভেল্ট ও চার্চিলের মৃত্যুর আগেই তার নাম নিশানা মুছে যায়। আর জাতিসংঘ! বহু ঘটা করে নিউইয়র্কে এর হেড কোয়ার্টার প্রতিষ্ঠার তিন বছর না যেতেই ট্রুম্যানের আমেরিকা জাতিসংঘের কোন তোয়াক্কা না করে তার পতাকা ব্যবহার করে প্রথম কোরীয় যুুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধেও আমেরিকার হস্তক্ষেপ ঘটে জাতিংঘের কোন অনুমোদন না নিয়েই। জর্জ বুশ জুনিয়র এবং টনি ব্লেয়ার তাদের অন্যায় ইরাক যুদ্ধ শুরু করেন জাতিসংঘের বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে। কঙ্গো সমস্যায় আমেরিকা ও বেলজিয়ামের সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থরক্ষায় সম্মত না হওয়ায় জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব দ্যাগ হ্যামার শোল্ডকে বিমান দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হত্যা করা হয়। আজ জাতিসংঘের অবস্থা ঠুঁটো জগন্নাথের মতো। আগের লীগ অব নেশনসের চাইতেও তার অবস্থা খারাপ। ট্রাম্প তো জাতিসংঘের কোন তোয়াক্কাই করেন না। রবীন্দ্রনাথ যে লিখেছিলেন, ‘শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’ মনে হয় সারাবিশ্বের জন্য আজ এ কথাটাই সঠিক। একটি সুখী শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন তো অনেকেই দেখেছিলেন, পয়গম্বর থেকে দার্শনিকেরা। আমাদের নবী (দ.) তার ধর্মের নামই রেখেছিলেন ইসলাম (শান্তি)। এখন মুসলিম বিশ্বেই সবচাইতে বেশি অশান্তি। বুদ্ধ সারাবিশ্বে অহিংসা ও শান্তির বাণী প্রচার করেছিলেন। কিছুকাল আগে বুদ্ধ-ভক্তদের সহিংসতায় শ্রীলঙ্কা ছিল রক্তাক্ত। এখন মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালিয়ে বিশ্ব আদালতে তারা অপরাধী। যিশু বলেছিলেন, তোমার এক গালে কেউ চড় মারলে অপর গাল পেতে দাও। এখন যিশু-ভক্তদের চড় মারার অবকাশ নেই। পারমাণবিক অস্ত্র হাতে তারা সারাবিশ্বকে চড় মারছে। কার্ল মার্কস চেয়েছিলেন শ্রেণীহীন, শোষণহীন একটি বিশ্ব গড়তে। তিনি ভেবেছিলেন, উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর শ্রমিক শ্রেণীর একদিন মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে। পৃথিবীতে প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই স্বপ্ন আজ গুঁড়িয়ে গেছে। তিনি কি বুর্জোয়া শক্তির হাতে পারমাণবিক মারণাস্ত্রের কথা ভেবেছিলেন, মেহনতি শ্রমিকদের বদলে হোয়াইট কলার শ্রমিক শেণীর আবির্ভাবের কথা ভেবেছিলেন, শ্রমিকের মেহনতি হাতের বদলে যন্ত্রের কাছে সমস্ত উৎপাদন শক্তি চলে যাবে ভেবেছিলেন, স্বপ্নেও ভেবেছিলেন কোন দেশে তার সাম্যবাদী দল ক্ষমতায় গিয়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সঙ্গে হাত মেলাবে? ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত বাংলাদেশে আমার জন্ম। গ্রামে মানুষ হয়েছি। সেই আমলে আমাদের তথাকথিত স্বাধীনতা ছিল না। কিন্তু প্রতিটি গ্রামেই মানুষের নিরাপত্তা ছিল। শান্তি ছিল। খুনখারাবি খুবই কম ছিল। আমরা সেই আমলে মিটিং মিছিলে চিৎকার করতাম, স্বাধীনতা চাই। ব্রিটিশদের শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তি চাই। ভাগ্যদেবতা আমাদের দাবি মেনে নিয়েছেন। আমরা স্বাধীন হয়েছি। স্বদেশী শাসক পেয়েছি। কিন্তু হারিয়েছি আগেকার সেই গ্রামের শান্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি। বিদেশী শাসনের চাইতে স্বদেশী শাসন আরও কঠোর, আরও নির্মম। কলকাতার ক্লাইভ স্ট্রিটের (বর্তমানে নাম পাল্টেছে) বিদেশী বণিকেরা বাংলাদেশে যে শাসন ও শোষণ চালাত, তার চাইতে বহুগুণ বেশি স্বদেশী নব্যধনীদের শোষণ ও লুণ্ঠন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিংস্রতা। বিদেশী শাসনে গোলামি করেছি। সেই গোলামির বিনিময়ে ছিল শান্তি ও নিরাপত্তা। এখন গোলামি নেই। হারিয়েছি শান্তি ও নিরাপত্তা। এই প্রসঙ্গে একটি লোক-গল্প মনে পড়লো। এক ভদ্রলোকের বাড়িতে এক সুন্দরী দাসী কাজ করতো। ভদ্রলোক তাকে ভালো টাকা মাইনে দিতেন। কিছুদিন পর তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ভদ্রলোক নববধূকে জিজ্ঞাসা করলেন, তার কেমন লাগছে? নববধূ বললো, কাজতো আগের মতো সবই করতে হয়। কেবল আগে মাইনে পেতাম, এখন তা পাই না। এই দাসীর উক্তি অনুসরণ করে বলতে পারি, আমরাও আগের মতো শাসিত এবং শোষিত। আগে শান্তি ও নিরাপত্তা ছিলো, তা এখন নেই। সহৃদয় পাঠকেরা আমাকে হতাশাবাদী ভাববেন না। তবে এই করোনা পীড়িত দেশেও একশ্রেণীর ডাক্তার ও মন্ত্রী মিলে মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা করেÑ এটা ভেবে মনটা মুষড়ে যায়। আমরা বলি মানবসভ্যতা, মানবতার কথা। তার স্পর্শ বুঝি এই পৃথিবী কোনদিন পাবে না। এই হতাশা দূর করার জন্যই বুঝি মানুষ স্বপ্ন দেখে প্রতি যুগে শান্তি ও সমৃদ্ধিময় এক নতুন যুগের। সে যুগ না এলে মানুষ আবার সামনের দিকে তাকায় আরেক নতুন ঊষার স্বর্ণদ্বার খোলার আশায়। এই করোনার মৃত্যু তা-বের মধ্যেও আমরা আশা করছি দিন বদলাবে। মৃত্যু নয় জীবনেরই জয় হবে। শোষক নয়, শাসিতদেরই দিন আসবে। এই আশা সেই প্রাগৌতিহাসিক যুগ থেকে মানুষ পোষণ করেছে। এখনো করছে। এই আশা আছে বলেই মানুষ বেঁচে আছে। মানবসভ্যতা, তার চেহারা যাই হোক সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। যুগান্তরের রথচক্রে মানবতা শব্দটি ঠাঁই করে নিয়েছে। আশা নিয়ে বাঁচতে আমাদের ক্ষতি কি? বিশ্ব মানবসমাজের তাকে হারানো চলবে না। [লন্ডন, ২৮ জুলাই, মঙ্গলবার, ২০২০]
×