ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি

প্রকাশিত: ২১:২১, ২৮ জুলাই ২০২০

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি

দেশ এখন করোনার দুঃসহ সংক্রমণে নজিরবিহীন ক্রান্তিকাল পার করছে। সম্ভাবনার ইঙ্গিত সেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। ভয়, আতঙ্ক আর আশঙ্কা নিয়ে প্রতিদিনের জীবন বয়ে চলেছে। মানুষের মূল্যবান জীবন এবং স্বাস্থ্য চরম ঝুঁকিতে। নিত্য সংক্রমণের উর্ধগতিতে হতাশ সবাই। পাশাপাশি মৃত্যুর হারও আশঙ্কাজনক। তবে স্বস্তির ব্যাপার এটুকুই যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সে হার নিচের দিকে। সুস্থতার সংখ্যাও আশার আলো দেখাচ্ছে। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশই শুধু নয় সাধারণ মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের বিপরীতে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হলে সংক্রমণ কমে যাবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি ভ্যাকসিন তৈরিতেও উন্নত বিশ্বের গবেষক ও বিজ্ঞানীরা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে আশার আলোও দৃশ্যমান হচ্ছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যেতে আরও কত সময় ব্যয় করতে হবে তা বলা মুশকিল। উন্নত বিশ্বে উদ্ভাবিত এ প্রতিষেধক আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ কবে পাবে এবং কতজনকে তা দেয়া যাবে তেমন প্রশ্নও উঠে আসছে। তবে বাংলাদেশ সরকার ভাবছে যারাই আবিষ্কার করুক না কেন বাংলাদেশ প্রয়োজনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজের চাহিদা ব্যক্ত করবে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রকে, যা এখনও সময়ের ব্যাপারে। এই মুহূর্তে জরুরী করোনা সংক্রমণকে মোকাবেলা করতে সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধিকে আমলে নিয়ে সময়োপযোগী সুষ্ঠু কর্মপ্রবাহ অবারিত ও মুক্ত করা। কিছুদিন ধরে যে সংবাদ প্রবাহ দেশের মানুষকে হতবাক ও দিশেহারা করে দেয় তা হলো স্বাস্থ্য পরিষেবায় জঘন্য অপকর্ম এবং অসহনীয় দুর্নীতি। স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা দেশের জন্য নতুন কোন খবর নয়। বহুবার এ ব্যবস্থাপনার অসততা, দুর্বৃত্তায়ন এবং অর্থ আত্মসাতের মতো চরম অভিযোগ উঠে এসেছে। কিন্তু সংস্কার কিংবা কাঠামোগত পরিবর্তনের কোন আলামত দেখা যায়নি। কিন্তু করোনার আকাল যখন সব মানুষের বিপদ এবং আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠল তখন থেকেই স্বরূপ উন্মোচন হতে থাকে সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার। চিকিৎসা সেবায় হাসপাতালগুলোর অদক্ষতা সীমিত কার্যক্রম সঙ্গে দুর্নীতি আর অপকীর্তির কঠিন বেড়াজাল সবাইকে বিমূঢ় করে দিল। মানব সেবার মহান ব্রত নিয়ে চিকিৎসক হওয়ার জীবনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে দেশের কৃতী ও মেধাবী প্রজন্মই আজ বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসক। মেধা ও মননের অবিমিশ্র সম্মিলনে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করে কোন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগমাত্র তৈরি হয়। তারপর দীর্ঘ ৫ বছর কঠোর অধ্যয়ন, অনুশীলন, স্বাস্থ্যবিধির সমস্ত নীতি-নৈতিকতাকে লালন-ধারণ করে এই মূল্যবান সময়টুকু পার করতে হয়। অধ্যবসায়ের সঙ্গে লেখাপড়ায় নিবিষ্ট মনোসংযোগ ছাড়াও মানবিক মূল্যবোধও নিজেকে প্রতিনিয়ত শাণিত করতে হয়েছে। একজন চিকিৎসক শুধু নিজের স্বপ্নের বাস্তবায়নই করে না মানুষের সেবায়ও উৎসর্গিত হতে হয়। কারণ অতি গুরুত্বপূর্ণ এ কার্যক্রমটি মানুষের স্বাস্থ্য ও প্রাণ ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দিতে প্রাসঙ্গিক সমস্ত ব্যবস্থাপনাকে নিয়ম বিধির আওতায় এগিয়ে নিতে হয়। ন্যক্কারজনক ঘটনার উন্মোচন করোনা সংক্রমণের দুঃসহ সম্প্রসারণের কঠিন সময়ে। প্রথমেই আপত্তি ওঠে ইতালি থেকে যখন প্রবাসী বাঙালীরা নিজ দেশে ফিরে এলো তাদের যথেষ্ট সুরক্ষায় কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থার দৃষ্টিকটু গাফিলতি, যা করোনার উর্ধগতি সংক্রমণকে বহুল বিস্তারে এগিয়ে নিয়ে যায়। এর পরই অভিযোগ এলো স্বাস্থ্যবিধির আওতায় নিরাপদ মাস্ক ও পিপিই সরবরাহের ব্যাপারে। এন৯৫ মাস্ক নিয়েও চলে অনেক ছলচাতুরী। তারপরে প্রতিটি হাসপাতালের যে বিপন্ন চিত্র সবাইকে আশাহত করে তা হলো করোনা সঙ্কটকালের শুরু থেকেই চিকিৎসা সেবায় চরম অনিয়ম এবং গাফিলতিই শুধু নয় কেন্দ্রীয় অক্সিজেন থেকে শুরু করে ভেন্টিলেশনের অপর্যাপ্ততায় রোগীদের নাভিশ্বাস হওয়ার উপক্রম। দায় শুধু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নয় পুরো ব্যবস্থাপনার বিশৃঙ্খলতা, সমন্বয়হীনতার অভাব এবং চিকিৎসা সেবাকে জরুরী ভিত্তিতে আমলে না নেয়ার হরেক রকম অপকৌশল ক্রমান্বয়ে দৃশ্যমান হতে থাকে। এ তো গেল সরকারী হাসপাতালগুলোর দুর্দশা। আর বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান করোনা দুর্ভোগকে তোয়াক্কা না করে চিকিৎসা দিতে পর্যন্ত আপত্তি জানানো। সঙ্গত কারণে সারা বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ যখন ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে সে পরিস্থিতিও মোকাবেলা করতে সেবাদান ব্যবস্থাপনাকে হিমশিম খেতে হয়। শুরুতে রোগ শনাক্তকরণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অভাবে এই প্রক্রিয়া শুধুমাত্র ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকে। প্রথম দিকে তো শুধু আইইডিসিআরে। ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের অন্য অনেক প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালে পরীক্ষা ত্বরান্বিত হলে অন্তত প্রতিটি জেলায় শনাক্ত করণের আপাত সমস্যা দূরীভূত হলেও অভ্যন্তরীণ অনেক সঙ্কট ভেতর থেকে প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধের যে দৃশ্য উঠে আসে তা যেমন মর্মস্পর্শী একইভাবে অপমানবিকও। এখানে নাকি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই করোনা শনাক্ত করণের রিপোর্ট দেয়া হতো। শুধু তাই নয় প্রচুর অর্থ আত্মসাতেরও তথ্য প্রকাশ হয়। সবচেয়ে দুঃখজনক ৩-৪ হাজার টাকা দিয়েও কেউই সঠিক রিপোর্ট পর্যন্ত পায়নি। বিড়ম্বিত এবং হতভাগ্য অসুস্থ মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে যে জীবন মরণের খেলা তাও কোন সভ্য দেশে কিভাবে সম্ভব তা বলা মুশকিল। এরই মধ্যে উন্মোচিত হলো সাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজের অনিয়ম ও দুর্নীতি, যা পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার চরম দুঃসময়কে চিহ্নিত করে। বিশিষ্টজনেরা বলছেন দুর্নীতি শুধু ব্যক্তিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, সামগ্রিক কাঠামোর মূল ব্যবস্থাপনায় তা গ্রথিত। তাই মহাপরিচালক কিংবা পরিচালক নয়তবা সচিবসহ উর্ধতন কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিলে মূল সমস্যার উৎপাটন হবে না। কাঠামোর প্রতি স্তরে যে দুর্নীতি এবং অপশাসন ছড়িয়ে সেখান থেকেই তার শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে। কাঠামোর মধ্যেই সমস্যার বীজ জিইয়ে রাখলে তা পুনরায় নতুন উদ্যোমে বেড়ে উঠবে। স্বাস্থ্য এবং মানুষের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলে তাদের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে যথার্থ অভিযুক্তরা চিহ্নিত হলে আইনের আওতায় তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও জরুরী। মানব সেবার মহৎ কাজে নিয়োজিত হয়ে যারা অমানবিক অসততায় গর্হিত অন্যায় করে তারা পার পেয়ে গেলে মানবতার স্খলন এবং মনুষ্যত্বের চরম বিপর্যয় হবে। সভ্য যুগে সভ্যতাবিবর্জিত কোন অপকর্মই মেনে নেয়া যায় না। আর চিকিৎসকরা যে ব্রত নিয়ে মানুষের কল্যাণ কামনায় এই অনন্য পেশায় নিজেকে যুক্ত করেন শুধু টাকার মোহে তারা বিপথে চলে যান সেটাও গ্রহণীয় নয়। মানুষের মূল্যবান জীবন ও স্বাস্থ্য নিয়ে যারা উন্মত্ত খেলায় মেতে ওঠেন সেটা শুধু আইন দিয়ে প্রতিকার করার চাইতেও ভেতরের শুভশক্তি, বিবেচনাবোধ, মানবিক দায়বদ্ধতা এবং মানুষের প্রতি সহমর্মিতা জাগ্রত করার মধ্য দিয়ে তৈরি করাই অপেক্ষাকৃত মঙ্গল। এটা শুধু যারা অপরাধী তারা নয় সব মানুষের মধ্যে বিচার বুদ্ধি, ন্যায়-অন্যায় বোধ, মনুষ্যত্বের পরম বিকাশকে যদি নিয়তই পরিচর্যা করা যায় তাহলেই অশুভ সমস্ত অপকৌশল সমূলে উৎখাত হতে সময় লাগবে না। জাতি হিসেবে আমরা এখন বীর কদমে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। করোনা দুর্যোগ দেশের অনেক খাতের ওপর দুর্ভোগের ছায়া ফেললেও আমাদের পেছনে তাকানোর সুযোগ নেই। সমস্ত অন্যায়, অপবাদ, অভিযোগ আর অমানবিকতাকে পশ্চাতে ফেলে শুভশক্তির অভ্যুদয়কে ভেতর থেকে আবেদন জানাতে হবে। মানুষের মধ্যে দুটো শক্তিই প্রবলভাবে বিদ্যমান থাকে। ব্যক্তি মানুষের ওপরই নির্ভর করে সে কোন শক্তিতে নিজেকে শাণিত করবে। মানুষ মানুষের জন্য এই মর্মবাণী আমরা সমাজের সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে পারলে সমস্ত পাশবিক ও অপশক্তি দূরীভূত হতে সময় লাগবে না। করোনা দুর্যোগ মোকাবেলা করতে গিয়ে আমরা যে দুঃসহ চিত্র দেখলাম পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার তা একেবারে মূল থেকে ঢেলে সাজানো ছাড়া বিকল্প কোন রাস্তায় এর সমাধান মিলবে না। ত্রুটিবিচ্যুতি পুরো কাঠামোগত প্রক্রিয়াকে বন্ধন জালের মতো ছেঁকে ধরেছে। সে জাল ছিন্ন করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন গতি সঞ্চার করতে সব ধরনের প্রাসঙ্গিক কার্যক্রমককে বিবেচনায় নিতে হবে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, দক্ষ মানব সম্পদ, সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা ও দেশের জন্য অকৃত্রিম মমতা, সর্বোপরি সর্বজনের মঙ্গল কামনায় এমন একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে যা জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত আকাক্সক্ষা। লেখক : সাংবাদিক
×