ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জালনোট- সারাদেশে সিন্ডিকেট সক্রিয়

প্রকাশিত: ২২:১৬, ২৭ জুলাই ২০২০

জালনোট- সারাদেশে সিন্ডিকেট সক্রিয়

রহিম শেখ ॥ কি নেই! সব আয়োজনই আছে। কাগজ, প্রিন্টারে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কালি, নিরাপত্তা সিলসম্বলিত স্ক্রিন বোর্ড, গাম, ফয়েল পেপার, কম্পিউটারসহ বিশেষ কিছু যন্ত্রপাতি। নিচে পড়ে আছে জাল নোটের বাণ্ডিল। রাজধানীর বংশাল এলাকার একটি ফ্ল্যাটে গড়ে তোলা হয়েছিল এমনই জাল মুদ্রা তৈরির কারখানা। গত ১৮ জুলাই ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণে জাল টাকা উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ঈদ-উল-আজহাকে সামনে রেখে বাজারে বড় অঙ্কের জাল টাকা ছাড়ার পরিকল্পনা ছিল চক্রটির। এ তো গেল একটি কারখানার গল্প। নগরীতে এমন অন্তত ২৫-৩০ বাসায় কারখানা বানিয়ে জাল মুদ্রা তৈরি করছে বিভিন্ন প্রতারক চক্র। এসব চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে ২০টি দল বা গ্রুপ। এই গ্রুপের বাইরে রয়েছে জাল টাকার ডিলার ও বাজারজাতকারী সদস্য। সম্প্রতি এসব ‘অসাধু কারবারিদের’ খোঁজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও বেড়েছে। গত দেড় মাসে অন্তত ৫ কোটি জাল টাকাসহ বেশ কয়েক সদস্যকে আটক করা হয়েছে। এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পাশাপাশি পশু ব্যবসায়ী এবং সাধারণ জনগণকে নগদ লেনদেনে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিটি কর্পোরেশন। খোঁঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত বছরের দুটি ঈদ উৎসব ও পূজাকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয় জাল নোট চক্রের সদস্যরা। জালিয়াত চক্রের দক্ষ কারিগরদের তৈরি ‘নিখুঁত’ জাল টাকাতেও নিরাপত্তা সুতা বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রতিটি উৎসবের আগ মুহূর্তে জাল নোট তৈরির চক্রগুলোর ভেজাল টাকা নিখুঁত করার বিষয়ে প্রতিযোগিতা চলে। কারণ যে চক্রের টাকা যত নিখুঁত, তার টাকার দাম তত বেশি, বিক্রিও বেশি। ১ লাখ টাকার বাণ্ডিল ১২ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তৈরিকৃত জাল টাকা বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। জাল টাকা তৈরি থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত কয়েকটি ভাগে তারা এ কাজ করে থাকে। প্রথমে অর্ডার অনুযায়ী জাল নোট তৈরি, দ্বিতীয় পর্যায়ে এই টাকাগুলো যে অর্ডার দেয় তার কাছে পৌঁছে দেয়া, তৃতীয় পর্যায়ে জাল টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়। জাল টাকার চক্রগুলো বাজারে জাল টাকা ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি এটিএম বুথেও আসল টাকার সঙ্গে জাল টাকা মিশিয়ে ব্যবসা করছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য আছে, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায় ২০টি দল বা চক্র জাল টাকা ও রুপী তৈরি করে থাকে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের পরিচয় জানাতে চায় না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তার মধ্যে তিনজন কারাগারে আছে। বাকিরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকলেও তারা জাল টাকার বিস্তারের কাজে সক্রিয়। তাদের ধরতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পশুর হাট ও বিপণি বিতানগুলোতে জাল নোট শনাক্তের মেশিন বসানো হয়েছে। অপরাধী চক্র কোথায় অবস্থান করছে বা করতে পারে তা প্রযুক্তির মাধ্যমে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মশিউর রহমান (ডিসি) বলেন, ‘জাল নোটের কারবারিরা এখন অনেক চালাক হয়ে গেছে। ঈদ আসলে এখন আর আগের মতো ঢাকার ভেতরে থাকে না। তারা ঢাকার বাইরে জাল নোট তৈরির কাজ করে, যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তাদের কাজ করতে পারে। তারা এখন ঢাকার বাইরে থেকে তাদের কাজ চালাতে তৎপর রয়েছে। ঈদে জাল টাকার ছড়াছড়ির বেশি সুযোগ পায় বলে তারা ঢাকার বাইরে থেকে কাজ করে তাদের লোকদের নিয়ে টাকাগুলো বাজারে ছড়িয়ে দেয়।’ এসব বিষয় মাথায় নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশও সেইভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশের যে অঞ্চলেই তারা কাজ করুক না কেন তাদের ধরতে আমরা সর্বদা প্রস্তুত আছি। আমাদের বিভিন্ন টিম এই বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ বছরে সারাদেশে জাল নোট সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৮ হাজার ৩৬৬টি। এর মধ্যে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত শতাধিক মামলা হয়েছে। অনেক মামলা নিষ্পত্তি হলেও এখনও ২ হাজারের বেশি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। ১৯৭২ সালের সংশোধিত আইনে জাল নোটের কারবারিদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল। ১৯৭৪ সালে তা যাবজ্জীবন ও অর্থদণ্ড করা হয়। পরে ১৯৮৭ সালে আইন সংশোধন করে আবারও জড়িতদের মৃত্যুদণ্ড বা ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়। কিন্তু এরপরও জাল নোটের কারবারিদের দমানো যাচ্ছে না। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ফেনী, বগুড়া, নীলফামারী, মেহেরপুরসহ অন্তত ৩০টি জেলায় জাল নোটের মামলা বেশি। মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করতে এসপিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এসব মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাক্ষী আদালতে আসেন না। আবার এলেও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করেন। এতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন তারা। এক পর্যায়ে আসামি পার পেয়ে আবারও একই অপকর্ম করে। কারবারিদের একটি তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে, তাতে অন্তত ২৫টি গ্রুপ সক্রিয়। প্রতিটি গ্রুপে ১০-১২ জন সদস্য কাজ করে। তাদের ধরতে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে বলে জানান তিনি। দেড় মাসে ৫ কোটি জাল টাকা উদ্ধার ॥ গত ১৮ জুলাই পুরান ঢাকার বংশাল ছাড়াও ওইদিন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩৫ লাখ টাকার জাল নোট এবং তা তৈরির বিভিন্ন উপকরণসহ তিন জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের করা মামলায় বলা হয়, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে এই চক্রটি জাল নোট তৈরি করছিল। কোরবানির পশুর হাট, শপিংমল ও অন্যান্য জায়গায় এই জাল নোট ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল তাদের। তার আগে গত ৩০ জুন মিরপুর ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দুটি বাসা থেকে চার কোটি টাকার জাল নোটসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করেছিল র্যা ব। এছাড়া গত ২০ জুলাই রাজধানীর বড় মগবাজার ও গত ২৩ জুলাই টাঙ্গাইল সদর উপজেলার করটিয়া পূর্বপাড়া থেকে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা উদ্ধার করা হয়। সম্প্রতি আটক এসব জাল নোটেরও লক্ষ্য ছিল কোরবানির হাট। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে পশুর হাটগুলোতে নগদ লেনদেন বেশি হয়ে থাকে, যা আবার বড় অঙ্কের। আর এই সুযোগটি নিতেই জাল নোটের কারবারিরা এই সময়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এসব হাটকে কেন্দ্র করে এক দল অসাধু চক্র জাল টাকা ছড়াতে পারে এমন চিন্তা থেকে হাটগুলোতে টাকা গণনা ও জাল নোট শনাক্তকরণ যন্ত্র স্থাপন করেছে র্যা ব ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্য সংস্থা। র্যা বের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘জাল নোটের কারবারিরা উৎসব কেন্দ্রিক সক্রিয় হয়ে যায়। কোরবানির হাটকে কেন্দ্র করে এসব চক্রের সদস্যরা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে আমাদের কয়েকটি সফল অভিযানে জাল নোট উদ্ধার এবং জাল নোট তৈরির যন্ত্রপাতি জব্দ করে বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ যে সব এলাকায় ফ্ল্যাটে বা বাড়িতে বসে জাল নোট তৈরি করে সেসব এলাকায় র্যা বের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তিনি। ‘তারপরও হাটগুলোতে র্যা বের টহল থাকবে। হাটে জাল নোট চিহ্নিত করার যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হবে। এরপরও আমরা বলব জনগণ যেন সচেতন হয়ে নগদ লেনদেন করেন।’ রাজধানীর পশুহাটে শনাক্তকরণ বুথ ॥ ব্যাংকগুলোকে কোরবানির পশুর হাটে জাল নোট প্রতিরোধে সেবা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো গুরুত্বপূর্ণ হাটে জাল নোট শনাক্তকরণ বুথ স্থাপন করবে। পাশাপাশি শাখাগুলোতে ব্যাংক নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সম্বলিত ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করতে হবে। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কোন হাটে কোন ব্যাংক দায়িত্ব পালন করবে, তা-ও ঠিক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ’ আইনের খসড়া চূড়ান্ত ॥ যত বেশি নকল মুদ্রা তৈরি বা সরবরাহের অভিযোগ প্রমাণিত হবে তার দণ্ড হবে তত বেশি। শাস্তি হিসেবে সর্বনিম্ন দুই বছর ও সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং এক লাখ থেকে এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান রেখে ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইন, ২০২০’-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই খসড়ার ওপর এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ জনগণের মতামত নিচ্ছে। খসড়া আইনে শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যত বেশি নকল মুদ্রা তৈরি বা সরবরাহের অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তার দণ্ড তত বেশি হবে। আইনের খসড়া অনুযায়ী, যে কোন মূল্যের ১০০টির কম জাল মুদ্রা পাওয়া গেলে দুই বছর কারাদণ্ড বা অনুর্ধ এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। এতে বলা হয়েছে, জাল মুদ্রা প্রস্তুত, ধারণ, বহন, সরবরাহ, আমদানি-রফতানি এবং মুদ্রা প্রস্তুতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিসহ আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি সম্পর্কে তথ্য দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সরকার পুরস্কৃত করবে। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, এখন থেকে জাল নোট বিষয়ে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মামলা করতে পারবে। এতদিন শুধু পুলিশ জাল মুদ্রার মামলা করতে পারত। আবার কারও কাছে জাল মুদ্রা থাকলেই তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। ওই জাল মুদ্রার বাহক আত্মপক্ষ সমর্থন বা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ পাবেন। বাহক যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, তিনি সরল বিশ্বাসে ওই মুদ্রা বহন এবং বৈধ লেনদেনের অংশ হিসেবে ধারণ করেছেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে কোন মামলা হবে না। তবে জাল মুদ্রার বাহক যে উৎস থেকে এই মুদ্রা পেয়েছেন, তাকেও একই বিষয় প্রমাণ করতে হবে। তবে অবশ্যই এক্ষেত্রে জাল মুদ্রার সংখ্যা দশ পিসের কম হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, এতদিন সিভিল পেনাল কোড অনুযায়ী জাল নোটের অপরাধীদের বিচার হতো। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল যার কাছে জাল নোট পাওয়া যেত, তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হতো। এ জন্য প্রস্তাবিত আইনে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রাখা হয়েছে।
×