ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল ॥ অভিযুক্তই তদন্ত কমিটির প্রধান

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ২৭ জুলাই ২০২০

বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল ॥ অভিযুক্তই তদন্ত কমিটির প্রধান

রশিদ মামুন ॥ ভুতুড়ে বিলের দায় নিয়ে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) প্রহসনের বিচারের আয়োজন করেছে। ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (তথ্য যোগাযোগ) এর নির্দেশেই গ্রাহকের মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিদ্যুত বিল কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় স্থানীয় কার্যালয়। পরে তুমুল সমালোচনা শুরু হলে তদন্তের উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রীয় এই বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানি। তদন্তভার দেয়া হয় ডিপিডিসির সেই নির্বাহী পরিচালককে। ফলে যিনি অতিরিক্ত বিল আদায় করার আদেশ দিয়েছিলেন তিনিই খুঁজতে শুরু করেন এর জন্য দায়ী কে বা কারা! নিজের সব আদেশ নির্দেশ দূরে সরিয়ে রেখে দায় চাপিয়ে দেন অধস্তনদের ওপরে। আর এতে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পাশাপাশি কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। মার্চে দেশে করোনা ধরা পড়ার পর সরকার গ্যাস এবং বিদ্যুত বিল দিতে গ্রাহককে আর ব্যাংকে না যাওয়ার পরামর্শ দেন। প্রথম আদেশে বলা হয় ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের বিল একবারে মে ’৩০ তারিখের মধ্যে পরিশোধ করলেই চলবে। এক্ষেত্রে গ্রাহককে কোন বিলম্ব মাসুলও দিতে হবে না। পরে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন জুন মাস পর্যন্ত বিলের ওপর থেকে বিলম্ব মাসুল তুলে নেয়ার জন্য আরও একটি আদেশ জারি করেছে। অর্থাৎ ৩০ জুলাই এরমধ্যে বিলম্ব মাসুল ছাড়া ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বিল পরিশোধ করা যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ভবিষ্যতে আর এ ধরনের কাজ যেন না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। ডিপিডিসি সেই সতর্কতা অভিযুক্তকে দিয়েই বাস্তবায়ন করছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। গ্রাহকের বিলে এখন বিলম্ব মাসুল চার দশমিক ৭৯ ভাগ। কিন্তু মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই তিন মাসের বিলের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ গ্রাহকের দেড় থেকে দ্বিগুণ বিল করেছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। করোনার মধ্যে যেখানে মানুষের হাতে টাকা নেই সেখানে কেন এই অতিরিক্ত বিদ্যুত বিল তা নিয়ে বিদ্যুত বিভাগের তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। বিদ্যুত বিভাগের কোন কোন কর্মকর্তা বলেন, সরকার এতদিন ধরে বিদ্যুতখাতের উন্নয়ন করে যে সুনাম কুড়িয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলোর জন্য তা একবারে নষ্ট হয়ে গেছে। শুরুতে বিতরণ কোম্পানির পক্ষে অবস্থান নিলেও পরে সাধারণ গ্রাহকের পক্ষে অবস্থান নেয় বিদ্যুত বিভাগ। বিতরণ কোম্পানিগুলোকে দায়ীদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশ দেয়। এ বিষয়ে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্সও গঠন করে দেয়া হয়। কিন্তু ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সেখানে দায়িত্ব দেয়া হয় নির্বাহী পরিচালক (আইসিটি) শহিদুল ইসলামকে। অভিযোগ আছে, এই শহিদুল ইসলামই মার্চের শুরুর দিকে নেটওয়ার্ক অপারেশন এ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস (এনওসি)গুলোকে একটি ই-মেইল করেন। সেই ই-মেইলে কোন এলাকায় কত ভাগ বেশি বিল করতে হবে তার একটি তালিকাও দেয়া হয়। যদিও সেই তালিকার চেয়ে অনেক বেশি বিল করেছে ডিপিডিসির এনওসিগুলো। করোনার কারণে যেহেতু মিটার রিডাররা যেতে পারছেন না তাই ‘অটো মিটার রিডিং ইনক্রিজিং’ শীর্ষক একটি তালিকাও এনওসির নির্বাহী প্রকৌশলীদের কাছে পাঠান শহিদুল ইসলাম। সেই তালিকায় প্রত্যেকটি এনওসি কোন কোন এলাকায় কত বিল বেশি করবেন সে বিষয়ে একটি নির্দেশনাও রয়েছে। এখানে দেখা যায় কোন কোন এলাকায় ৫০ ভাগের বেশি বিল করারও নির্দেশনা ছিল। ডিপিডিসি অতিরিক্ত বিলের অভিযোগে একজন নির্বাহী প্রকৌশলীসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত, ৩৬টি এনওসির নির্বাহী প্রকৌশলীদের কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছে। এছাড়া আরও ১৩ জন মিটার রিডার এবং ডাটা এন্ট্রি অপারেটরসহ মোট ১৪ জনকে চুক্তিভিত্তিক কাজ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। যে ৩৬ এনওসির নির্বাহী প্রকৌশলীদের কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয়েছিল সেখান থেকে উত্তর পেয়েছে ডিপিডিসি। নির্বাহী প্রকৌশলীরা তাদের অতিরিক্ত বিল করার আদেশের বিষয়টি আইসিটি বিভাগ থেকে দেয়া হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ দর্শানোর উত্তরে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী লিখেছেন আইসিটি দফতর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের বিলের সঙ্গে তুলনা করে মার্চ মাসের বিল বাড়িয়ে করতে বলা হয়। এক্ষেত্রে সকলের বিল একই হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এখন যেসব গ্রাহক শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার না করে শুধুমাত্র লাইট এবং ফ্যান ব্যবহার করেছেন তাদের বিদ্যুত বিল বেশি এসেছে। আবার যেসব গ্রাহক শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার করেছেন তাদের বিদ্যুত বিল তুলনামূলক কম এসেছে। এ সময় যারা বাসাবাড়িতে ছিলেন না তাদেরও বিদ্যুত বিল দেয়া হয়েছে। এমনকি বন্ধ দোকান ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও বিদ্যুত বিল দেয়া হয়েছে। তিনি ওই কারণ দর্শানোর নোটিসে লিখেছেন মূলত মিটার না দেখে বিল করাতে এই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। বিদ্যুত বিল আদায়ে একটি বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা বছরের শুরু থেকেই ধরিয়ে দেয়া হয়। অর্থবছরের শেষ মাসে অর্থাৎ জুনে গিয়ে যার হিসেব হয়। এই হিসাব মেলাতে গিয়ে এনওসিগুলো মে মাস থেকে গ্রাহকের বিল একটু একটু করে বাড়িয়ে দেখায়। অনেকদিনের পুরোনো এই অভিযোগের সঙ্গে এবার খোদ কোম্পানি থেকে বাড়তি বিল করতে বলাতে গ্রাহক দুই ধরনের বাড়তি বিলের শিকার হয়েছেন। এ বিষয়ে জানার জন্য ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (আইসিটি) শহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। বিকেল ৩টা ২৪ মিনিট এবং ৪টা ৪০ মিনিটে কয়েকবার ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। কথা বলার আগ্রহের কথা জানিয়ে তাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তার উত্তর দেননি তিনি। জানতে চাইলে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান জনকণ্ঠকে বলেন, আইসিটি বিভাগ তো বিল করে না। তবে এটিকে ভুল বোঝাবুঝি উল্লেখ করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমরা বিষয়টি দেখছি কি করা যায়।
×