ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আগে জীবন পরে উৎসব

প্রকাশিত: ১৯:০৯, ২৭ জুলাই ২০২০

আগে জীবন পরে উৎসব

রোজগার না থাকলে মানুষ না খেয়ে মরবে। সে আলামত ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। রাস্তাঘাটে ফকির-মিসকিন বেড়েছে। তাদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। অনাহারে শীর্ণ দেহ জানান দিচ্ছে, এভাবে বেশি দিন বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। এদের ৮০ শতাংশ মানুষই দিনমজুর, গৃহকর্মী, পরিবহন শ্রমিক, দোকান কর্মচারী ইত্যাদি। এদের বাইরে আরও এক বিশাল সংখ্যক মানুষ আছে। তারা ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানে ছোট চাকরিজীবী, টিউটর, হকার ইত্যাদি। কেউ বা বাড়ি ভাড়া থেকে সংসার চালান। অনেকে নানা ধরনের সঞ্চয়পত্র থেকে পাওয়া মুনাফায় সংসার চালান। তারা সে টাকা তুলতে পারছেন না। অনেকেই ব্যাংক থেকেও টাকা তুলতে পারছেন না নানা কারণে। তারা প্রায় সবাই সরকারী সাহায্য থেকে বঞ্চিত। তারা না পাচ্ছেন সাহায্য, না পারছেন সাহায্য বা ভিক্ষে করতে। আমাদের গরিব দেশ। আবার ছোট্ট ভূখণ্ডে এত মানুষের বাস। জনঘনত্বে পৃথিবীতে সর্বোচ্চের কাছাকাছি। সাধারণীকরণ করলে দেখা যাবে, যদি দেশের চার কোটি মানুষ সরকারের সরাসরি সাহায্য কর্মসূচীর মধ্যে এসে থাকে তাহলে অন্তত আরও ১২ কোটি মানুষ সত্যিই অসহায় হয়ে পড়েছে। তাদের পক্ষে আরও তিন বা চার সপ্তাহ টিকে থাকা সত্যিই কঠিন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হলে এরা রোজগার করতে পারবে। বিপুল সংখ্যক মানুষ ইতোমধ্যে চাকরি হারিয়েছে। চাকরি হারানোর ভয়ে আছে তার চেয়েও বেশি মানুষ। পোশাক শ্রমিকসহ অন্যদের দুর্দশাও কম নয়। এমন বাস্তবতায় সরকার নানাজনের সঙ্গে পরামর্শ করে, অনেক ভেবেচিন্তে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। আর তা হলো মানুষকে কাজে ফিরে আসার সুযোগ করে দেয়া। দুনিয়ায় সামাজিক প্রাণীর সংখ্যা বেশুমার। কিন্তু মানুষই একমাত্র অর্থনৈতিক প্রাণী। মানুষ জানে বিনিময় করতে, বিক্রি করতে, কিনতে। জিনিসে জিনিসে বিনিময় হতো এক কালে। সে যুগ শেষ। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মানুষ প্রথমে ছিল গোষ্ঠীকেন্দ্রিক। ধীরে ধীরে তা অঞ্চলের গণ্ডি পেরিয়ে দেশ, মহাদেশে প্রসারিত। চীনে করোনা সংক্রমিত হতে শুরু করলে মানুষ প্রথম ধাক্কা খেয়ে জানল যে, চীন এখন বিশ্বের পণ্য উৎপাদনের কারখানা। চীন অচল মানে সারা দুনিয়া অচল। কিন্তু এই ছবি তো ছোট পরিসরেও সত্য। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মানুষের সমাজ অযুত নিযুত বন্ধনে যুক্ত। সেটা একটা বিশাল চেইন। কোনো একটা জায়গায় সমস্যা হলে গোটা ব্যবস্থাকে কম-বেশি সমস্যায় ফেলে। যত তাড়াতাড়ি সেটা মেরামত করা যায়, ততই আবার চাকা ঘুরতে শুরু করে। স্বাভাবিক হয় উৎপাদন, বিপণন, ভোগ, জীবনযাপন। জীবন এবং জীবিকার মধ্যে এ রকম দ্বন্দ্ব এই প্রথম নয়। সুপ্রাচীন কাল থেকে মানুষ এ সমস্যা মোকাবেলা করছে। তবে বিবেচনা করতে হবে কোনটা আগে। জীবিকা প্রাণ বাঁচাবে? না, বেঁচে থাকলে কোন না কোন জীবিকা জুটবে? কাজেই সরকারের সিদ্ধান্ত ভাল না মন্দ এখনই সে বিচার করা কঠিন। তবে অন্য কোন বিকল্পই কি খুঁজে পাওয়া যেত না? আমরা কি তা যথাযথভাবে চর্চা করে দেখেছি? বিশ্বজুড়ে আমরা অবাক হয়ে মানুষের আরেকটি প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। মানুষ হামলে পড়েছে জিনিস মজুদ করতে। আমি বলছি সাধারণ ভোক্তাদের কথা। তারা পকেট উজাড় করে, দোকান খালি করে জিনিস কিনে ঘর ভরেছে। পাশাপাশি এটা ভাবেনি যে, আগামী দিনগুলো আরও কঠিন হবে। তাই ভোগের লাগাম এখন থেকেই টেনে ধরতে হবে। অভ্যস্ত জীবনের ধরন বদলাতে হবে। সেটা এক দিনে হবে না জানি। কিন্তু অভ্যাস করতে হবে; পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে। একটা দেশের মানুষকে তিন সপ্তাহ বাঁচিয়ে রাখার জন্য এমন ঝুঁকিপূর্ণ জীবিকার পথ খুলে দেয়া কতটা বুদ্ধিমানের কাজ? ঈদ কি এমনই এক আনন্দ উৎসব, যা পালন করতেই হবে ঘটা করে? এমনিতেই ধর্মীয় বিবেচনায় ঈদ ওয়াজিব; ফরজ নয়। ঈদের বাজারের জন্য দোকানপাট খোলা, বিপুল জনসমাগম কতটা ঝুঁকি তৈরি করবে? সময়টা আবার ঠিক তখন যে সময় সংক্রমণ সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছানোর মুহূর্ত। মৃত্যুও পৌঁছাবে সর্বোচ্চে ধাপে। অথচ সংক্রমণ এড়ানোর এখনও পর্যন্ত জানার উপায় হচ্ছে, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা। ঈদের ব্যবসা না হলে ব্যবসায়ীদের বিশাল ক্ষতি। সে কথা যেমন ঠিক, তেমনি ব্যবসা করতে গিয়ে সংক্রমণ বাড়লে তা সামাল দেয়া অনেক বেশি কঠিন হবে। তখন সামাল দেব কীভাবে? বেশি সংক্রমণ মানে বেশি মৃত্যু। আমরা কি তা চাইতে পারি? সামনে ভয়াবহ দিনের তৈরি হওয়া উচিত। রোজগার কমছে; ভোগ কমাতেই হবে। ভোগলিপ্সা কমাতে হবে। তাই দরকার ছিল কৃচ্ছ সাধনের আহ্বান জানানো। কঠিন সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বিশ্ব যদি এ বছরের মধ্যে করোনা নিয়ন্ত্রণ করতেও পারে তবু মানুষের জীবন অন্তত ৫০ বছর পেছনের অবস্থায় ফিরে যাবে। করোনা দুনিয়ার অনেক কিছুই বদলে ফেলেছে, আরও বদলে দেবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় যে বিপুল পরিবর্তন ঘটাবে তা অতীতে আর কখনও ঘটেনি। তবু বোঝার সুবিধার জন্য বলি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ যেভাবে বদলে গিয়েছিল কিংবা সারা দুনিয়ায় উপনিবেশগুলো যেভাবে ভেঙে গিয়েছিল, তৈরি হয়েছিল এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা তার চেয়েও অনেক বেশি বদলে যাবে পৃথিবী সামনের দিনগুলোতে। মানুষের প্রাণ বাঁচাতে হবে সবার আগে। এখন চাই সংহতি, মানুষে মানুষে ভালবাসা।
×