ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কক্সবাজার হাসপাতাল যেন দুর্নীতির আখড়া

প্রকাশিত: ০০:৩৮, ২৬ জুলাই ২০২০

কক্সবাজার হাসপাতাল যেন দুর্নীতির আখড়া

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ সরকার স্বাস্থ্য বিভাগে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করছে ঠিকই। তবে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের খাবার প্রদানে ঠকিয়ে লাখ লাখ টাকা বিল তুলে নিচ্ছে ঠিকাদারি সিন্ডিকেট। ডিম-ঝোল দিয়ে বিল করা হচ্ছে মাছ ও মাংসের। ভুয়া বিল পাস করিয়ে সরকারের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে হাসপাতালের কয়েক কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি সিন্ডিকেট। জানা যায়, সরকারী নিয়ম অনুযায়ী রোগী প্রতি প্রায় ৩১০ গ্রাম মুরগির মাংস পাওয়ার কথা থাকলেও দেয়া হচ্ছে মাত্র ১২০ গ্রাম। আবার একদিন পর পর মাছ দেয়ার নিয়ম থাকলেও মাছের দেখা পায়না রোগীরা। এছাড়া মাছ-মাংসের বদলে ডিম দেয়ার নিয়ম না থাকলেও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সহযোগিতায় ঠিকাদারি সিন্ডিকেট শুধু ডিম আর ঝোল দিয়েই চালিয়েছে প্রায় দেড় মাস। এভাবে সদর হাসপাতালে রোগীর খাবারে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে। এই অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে হাসপাতালের উর্ধতন কর্মকর্তাসহ ঠিকাদার সিন্ডিকেট জড়িত থাকায় নি¤œমানের খাবার কেন? এ কথা কেউ বলার সাহস পাচ্ছেনা। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা খাবার দেয়ার নিয়ম থাকলেও সাধারণ রোগীদের খাবার দিয়েই হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কোটি টাকা। ২৯০ থেকে ৩’শ রোগীর ২ বেলা খাবারের জন্য মাত্র ৩০ কেজি মুরগি আনে ঠিকাদারের নিয়োজিত সিন্ডিকেট সদস্যরা। ডাল এবং সবজি দুই কেজি। সরেজমিনে শুক্রবার সকাল ১০টায় হাসপাতালের রান্নাঘরে গিয়ে দেখা গেছে, রান্নার কাজে নিয়োজিত কয়েকজন মুরগির মাংস কাটছে। জানতে চাইলে তারা বলেন, এখানে শুনেছি ৩৫ কেজি মুরগির মাংস এনেছে। সেখান থেকে আলাদা চলে যাবে ৫ কেজি। সে হিসেবে থাকবে মাত্র ৩০ কেজি। যা দিয়ে রোগীদের ২ বেলা খাবার দিতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুক্রবার ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২৭২ এবং রোহিঙ্গাসহ মিলিয়ে প্রায় ৩০০ রোগী আছে। ২৩ জুলাই ছিল ২৬৬ জন এবং রোহিঙ্গাসহ ২৯০ জন। তাদের রান্নার জন্য আনা হয়েছিল সেই ৩০ কেজি মাংস। ২ কেজি ডাল ১০ কেজি আলু এবং কিছু সবজি। আর এ সব কিছু রান্নার জন্য আদা দেয়া হয়েছে আধা কেজি, পেঁয়াজ ২ কেজি অর্থাৎ মসলার পরিমাণও খুবই অল্প। তাই কোন মতে পানি বেশি দিয়ে ঝোলের বন্যা করে রোগীদের খাওয়ানো হচ্ছে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে। এভাবে গত কয়েক দিনের তথ্য নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন অন্তত ৩০০ জনের খাবার রান্না করতে হয়, তবে মাংস বা উপকরণ থাকে খুব অল্প। এদিকে হাসপাতালের অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৪ মাস আগে টেন্ডারের মাধ্যমে হাসপাতালের খাদ্য সরবরাহের কাজটি পায় আবদুল হামিদের মালিকানাধীন শাহরিন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি বান্দরবানের বাসিন্দা। তবে এখানে রয়েছে তার আরও বেশ কয়েকজন সহযোগী। যারা মিলেমিশে সিন্ডিকেট করে হাসপাতালে রোগীদের খাদ্য সরবরাহের নামে লুটপাট করছে। এছাড়া এপ্রিলের শুরু থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত শুধু ডিম দিয়ে রোগীদের খাবার সরবরাহ দেয়া হয়েছে। লকডাউন অবস্থায় ভর্তি রোগী কম থাকলেও হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার যোগসাজশে ঠিকাদার কাগজে কলমে রোগী বাড়িয়ে দিয়ে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে সরকারের লাখ লাখ টাকা। ওই সময় এই বিরাট অনিয়মের প্রতিবাদ করায় হাসপাতালের তৎকালীন সুপার ডাঃ মহিউদ্দিন ওই কর্মচারীদের মারতে আসেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, স্থানীয় রোগীদের খাবারের জন্য দৈনিক ১২৫ টাকা বিল। রোহিঙ্গাদের খাবারের জন্য দৈনিক ২৫০ টাকা বিল পাবে ঠিকাদার। তবে রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা কোন খাবারের ব্যবস্থা না করে নি¤œমানের খাবার দিয়ে বাড়তি বিল করা হচ্ছে। এছাড়া সকালে নাস্তায় ডিম পাউরুটি ও দুধ থাকার নিয়ম থাকলেও খাবার অযোগ্য কলা এবং বাসি পাউরুটি দেয়া হয়। এই খাদ্য তালিকা বা মালামাল দেখার প্রাথমিক কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত হাপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার নোমান টাকার লোভে ঠিকাদারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি সরকারী কর্মচারী হয়েও ঠিকাদারের পক্ষে উল্টো কম পণ্য দিয়ে রান্না করার জন্য চাপ দেন বাবুর্চিদের। সেই নোমান ঠিকাদারের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, লকডাউন চলাকালে বাজারে মাছ-মাংস না থাকায় ১ মাস ডিম দেয়া হয়েছিল সত্য। তবে মাঝে মধ্যে মুরগি দেয়া হয়েছে। আর একদিন পর মাছ দেয়ার কথা থাকলেও দিচ্ছেনা কেন জানতে চাইলে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ সব জানে বলে এড়িয়ে যান তিনি। এ বিষয়ে ঠিকাদার আবদুল হামিদের কাছে ফোনে জানতে চাইলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে লাইন কেটে দেন। হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ রফিকুচ্ছালেহীন এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। আমতলীতে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নৈরাজ্য নিজস্ব সংবাদদাতা আমতলী থেকে জানান, সরকারী নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে লাইসেন্সবিহীন ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে বরগুনার আমতলীতে ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সরকারী মূল্য তালিকা ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মূল্য তালিকায় রয়েছে আকাশ পাতাল ব্যবধান। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে পাঁচগুণ মূল্যে টেস্ট করছে। অদক্ষ ও হাতুড়ে প্যাথলজিস্ট, টেকনেশিয়ান ও এক্সরে টেকনেশিয়ান দিয়ে চলছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কার্যক্রম। এক্সরে মেশিন স্থাপনে সরকারী নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। এ নিয়ে ভুক্তভোগীদের নানাবিধ হয়রানির অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। নীরব জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর এ নৈরাজ্য রোধের কোন কার্যকরী ব্যবস্থা নেই। ভুক্তভোগীরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এ নৈরাজ্য বন্ধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন। সরকারী নির্দেশনা তারা মানছেন না। নিজেদের গড়া এ্যাসোসিয়েশনের নির্দেশনাই তাদের মূল ভিত্তি। জানা গেছে, আমতলী উপজেলার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের পঞ্চাশ থেকে এক শ’ গজ দূরত্বে চারপাশে গড়ে উঠেছে ৭ ডায়াগনস্টিক সেন্টার। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ঘিরে রেখেছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো। এর মধ্যে বেলিভিউ, মেডিনোভা, সময় মেডিকেয়ার হসপিস, তামান্না, আমতলী ডিজিটাল, হাসিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গা-ঘেঁসে পঞ্চাশ থেকে এক শ’ গজ দূরত্বে এবং আমতলী মাতৃসদন ক্লিনিক দুই কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। সরকারী নির্দেশনা উপেক্ষা করে এ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো গড়ে উঠেছে। এ সকল ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মধ্যে অধিকাংশের সরকারী কোন অনুমোদন নেই। অভিযোগ রয়েছে এ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে পাঁচগুণ মূল্যে টেস্ট করছে। সরকারী কোন নিয়মনীতি তারা মানছেন না। তাদের নিজেদের নিয়মই চলছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো। অদক্ষ প্যাথলজিস্ট, টেকনেশিয়ান ও এক্সরে টেকনেশিয়ান দিয়ে চলছে আমতলী ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কার্যক্রম। এদের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কেউ নেই এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। খোঁজ নিয়ে যানা গেছে, আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্সরে মূল্যের চেয়ে ছয়গুণ বেশি নিচ্ছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো। প্যাথলজি পরীক্ষা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে পাঁচ থেকে ছয়গুণ বেশি নিচ্ছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ। সরকারী হাসপাতালে এক্সরে মূল্য ৮/১০ ইঞ্চি ৫৫ টাকা। ওই এক্সরে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৩শ’ ৫০ টাকা। ১৪/১৪ ইঞ্চি এক্সরের মূল্য ৭০ টাকা। ওই এক্সরে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিচ্ছে ৪শ’ ৫০ টাকা। এভাবেই ডিজিটাল এক্সরে মেশিন বলে পুরাতন মেশিন দিয়ে এক্সরে করে রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে পাঁচগুণ টাকা। এছাড়া আমতলী হাসপাতালে প্যাথলজি বিভাগে ১৮ ধরনের পরীক্ষা করা হয়। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো প্যাথলজি পরীক্ষায়ও সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে পাঁচগুণ টাকা বেশি নিচ্ছে। সরকারী হাসপাতালে টিসি, ডিসি, ইএসআর ও হিমোগ্লোবিন পরীক্ষার মূল্য এক শ’ ৫০ টাকা। ওই পরীক্ষায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে নিচ্ছে ৪শ’ টাকা। আরএ টেস্ট সরকারী হাসপাতালে ৬০ টাকা। ওই টেস্ট ডায়াগনিস্টিক সেন্টারে ৩শ’ ৫০ টাকা। এইচবিএসএজি টেস্ট সরকারী হাসপাতালে এক শ’ ৫০ টাকা। ওই টেস্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৪শ’ ৫০ টাকা। সরকারী হাসপাতালে প্রস্রাব পরীক্ষায় বিটি সিটির মূল্য ৩০ টাকা। ওই পরীক্ষা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৩শ’ টাকা। প্রেগনেন্সি টেস্ট হাসপাতালে ৮০ টাকা। ওই টেস্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিচ্ছে ২শ’ ৫০ টাকা। আলট্রা¯েœাগ্রাম প্রকারভেদে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিচ্ছে ৪শ’ ৫০ টাকা থেকে ৭শ’ টাকা। যা পাশর্^বর্তী কলাপাড়া উপজেলায় ২শ’ টাকা। এভাবেই প্রতি পরীক্ষায় সরকার নির্ধারিত মূল্যেও চেয়ে পাঁচ থেকে ছয়গুণ বেশি নিচ্ছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো। এ মূল্য প্রতিরোধে নেই কোন কার্যকরী ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন অবস্থা হলেও তিনি দেখে না দেখার ভান করছেন। আমতলী পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর মোঃ ফকু মিয়া বলেন, আমতলী ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর নৈরাজ্য দেখার কেউ নেই। আমতলী উপজেলা ডায়াগনস্টিক এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ নজরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, সরকারী অনুমোদন ও নির্দিষ্ট দূরত্বে ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপন করেছে কিনা তা আমার জানা নেই। তিনি আরও বলেন, সরকারীভাবে টেস্টের কোন মূল্য তালিকা নেই। সরকারী মূল্য তালিকা দেয়া হলে তা মেনে নিয়ে টেস্টের ফি নেয়া হবে। আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ শংকর প্রসাদ অধিকারী ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে মূল্য তালিকায় গরমিলের কথা স্বীকার করে বলেন, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো হাসপাতালের খুবই কাছাকাছি। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো সরানোর জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। বরগুনা জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ হুমায়ূন শাহিন খান বলেন, উপজেলা হাসপাতালের কাছাকাছি ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপন করা যাবে না। কেউ যদি করে থাকে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের মূল্য তালিকার সঙ্গে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মূল্য তালিকার অনেক হেরফের রয়েছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লাঘবে মূল্য তালিকা সংশোধনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×