ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় টিউশনি বন্ধ, বিপাকে জবি শিক্ষার্থীরা

প্রকাশিত: ২৩:৩৯, ২৬ জুলাই ২০২০

করোনায় টিউশনি বন্ধ, বিপাকে জবি শিক্ষার্থীরা

মোঃ মামুন শেখ, জবি ॥ সম্পূর্ণ অনাবাসিক হওয়ার ফলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রায় শিক্ষার্থীকে থাকতে হয় মেস বাড়িতে। আর সিংহভাগ শিক্ষার্থীই অতিরিক্ত এই মেস ভাড়ার জোগান দেন টিউশনি, কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে কিংবা পার্টটাইম জব করে। এমনকি অনেক শিক্ষার্থী পরিবারের আর্থিক সঙ্কটের কারণে সংসার খরচও এই আয় থেকে জোগান দিয়ে থাকেন। বর্তমানে তাদের আয়ের উৎস বন্ধ। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও করোনা সঙ্কটের কারণে ঢাকায় এসে মিলবে না টিউশন কিংবা পার্টটাইম জব। প্রশাসন থেকে সমাধান মিলবে এই আশায় কয়েক মাসের মেস ভাড়াও দেননি অনেক শিক্ষার্থী। এছাড়াও বাড়ি থেকে যারা মেস ভাড়া নেন তাদের অনেকেরই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষমের টাকায় যাদের পড়াশোনা ও মেস ভাড়া চলত, সে সব মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীরা পড়েছেন চরম বিপাকে। জবির গণিত বিভাগের ছাত্র সাব্বির রহমানের বাড়ি রাজবাড়ী। থাকতেন মুরগিটোলা একটি মেস বাড়িতে। ভাড়া সতেরো শ’ টাকা। খাবারসহ সব মিলিয়ে মাসে তার খরচ হতো সাড়ে চার থেকে পাচ হাজার টাকা। টিউশনির টাকায় চলতেন। বাড়িতেও কিছু টাকা পাঠাতেন। কিন্তু করোনার কারণে সাব্বিরের সব ওলটপালট হয়ে গেছে। কয়েক মাস ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তার টিউশনিও বন্ধ হয়ে গেছে। উপার্জনের পথ বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন এই শিক্ষার্থী। বললেন, দুটি টিউশনি করে আট হাজার টাকা পেতেন। এই টাকা থেকে নিজের খরচ বাদে বাকি টাকা বাড়িতে দিতেন। বাবা কৃষি কাজ করেন, বড় ভাই আলাদা থাকেন। ফলে তাকেই পরিবারের দেখভাল করতে হয়। টিউশনি না থাকায় ঢাকা ছেড়েছেন আরও আগেই। এখন বাড়িতে কৃষি কাজ করেন। এর মধ্যেই আবার মুরগিটোলা থেকে চার মাসের মেস ভাড়ার টাকা চাওয়া হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জবি দর্শন বিভাগের একজন ছাত্র জানালেন, তিনি কলতাবাজার মেসে থাকতেন। গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম। রাজধানীর বংশালে অষ্টম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে পড়িয়ে মাসে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা পেতেন। এই টাকায় নিজের খরচের পর অবশিষ্ট টাকা বাড়িতে পাঠাতেন। বাবা কৃষক, মা গৃহিণী। এমন পরিস্থিতিতে টিউশনি বন্ধ থাকায় তিনি গ্রামের বাড়িতে আছেন। বললেন, এখন ধার দেনা করে চলতে হচ্ছে। করোনায় বাসাভাড়া নিয়ে চরম সঙ্কটে পড়েছে দেশের একমাত্র অনাবাসিক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। উচ্চশিক্ষা লাভের তাগিদে একমাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী মেস ভাড়া করে ঢাকায় থাকেন। করোনা পরিস্থিতিতে সব ধরনের ইনকামের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে চরম সঙ্কটে পড়েছেন এই শিক্ষার্থীরা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার তাগিদে মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের এই চরম সঙ্কট তৈরি হলেও নীরব ভূমিকায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দায়সারা কিছু সাহায্য-সহযোগিতা ও শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সঙ্কট নিরসনে একটি কমিটি গঠনের এক মাস পার হলেও যার ফল এখনও পাওয়া যায়নি। জানা যায়, করোনায় শিক্ষার্থীদের মেস ভাড়া নিয়ে বাড়িওয়ালাদের বিভিন্ন হুমকির মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দ্বারস্থ হন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সাহায্য নেয়ার আশ্বাস দেয়া হলেও হয়রানি বাড়ে শিক্ষার্থীদের। এরপর গত ১০ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ছাত্রসংগঠনের ১৯ নেতা শিক্ষার্থীদের করোনায় সঙ্কটকালীন শিক্ষাবৃত্তির দাবি জানান। পরদিন ১১ জুন শাখা ছাত্রলীগের নেতারাও মৌখিকভাবে শিক্ষাবৃত্তির দাবি জানান। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ জুন সঙ্কট নিরসনে মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদকে নিয়ে এক সদস্যের কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটি গঠনের ২৩ দিন পর গত ৭ জুলাই শিক্ষাবৃত্তির প্রস্তাব দিয়ে প্রস্তাবনা দেয় তদন্ত কমিটি। এরপর ১৭ দিন পার হয়ে গেলেও এখনও কোন পদক্ষেপ নেয়নি বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন। গত ২৫ জুন শিক্ষার্থীদের সঙ্কট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে লিখিত পাঁচ দফা দাবি জানায় শাখা ছাত্রলীগ। তাদের দাবি অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন, তাদের মালপত্র সরাতে মাঠে সক্রিয় কাজ করে আসছেন শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে দাবি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্পষ্ট কোন অগ্রগতি না হওয়ায় গত ৪ জুলাই শাখা ছাত্রলীগের পাঁচ কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে অনশনে বসেন। এরপর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কোন ব্যবস্থা নেই কর্তৃপক্ষের। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সময়ক্ষেপণের মধ্যে মেস ভাড়া সঙ্কটে চরম অনিশ্চয়তা বাড়ছে শিক্ষার্থীদের। তাদের অভিযোগ, মেস ভাড়া নিয়ে বাড়ি মালিকদের হুমকির মুখে বাসা ছাড়ছেন তারা। বাসা ছাড়তে ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় আসতে হচ্ছে। বাসার মালপত্র রাখা ও বহন করতে বাড়তি ঝামেলায় পড়ছেন। সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের মালপত্র রাখতে বিভিন্ন বিভাগ থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি না পাওয়ায় সেটা আর সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অফিস থেকে পার্শ্ববর্তী থানায় সহযোগিতার কথা বললেও পুলিশ প্রশাসনের সাড়া মিলছে না। এ বিষয়ে সঙ্কট নিরসন কমিটির একমাত্র সদস্য মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. নুর মোহাম্মদ জানান, আমাকে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে, আমি শিক্ষাবৃত্তির প্রস্তাবনা দিয়ে রিপোর্ট সাবমিট করেছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। শিক্ষার্থীদের সঙ্কট নিরসনে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এই প্রস্তাবনা তৈরি করেছি। যার কারণে সময়ক্ষেপণ হয়েছে বেশি। আমি বলেছি, আগের চেয়ে ১০ গুণ শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেয়ার জন্য, যার সময়কাল হবে এক বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মোঃ ওহিদুজ্জামান বলেন, কমিটি একটা রিপোর্ট সাবমিট করেছে। সেটা আমি উপাচার্যের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি, তিনি দেখে ব্যবস্থা নেবেন। পরবর্তী কোন একাডেমিক মিটিং হলে সেখানে এটি উপস্থাপন করা হবে তারপর সবাই মতামত দেবেন। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানকে কল দিলে বলেন, ‘আমি ফোনে বাসা ভাড়ার বিষয়ে কোন কথাই বলব না। তুমি এটাই লেখে দাও’।
×