ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা শঙ্কার মধ্যে রাজধানীতে বসছে পশুর হাট

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ২৬ জুলাই ২০২০

করোনা শঙ্কার মধ্যে রাজধানীতে বসছে পশুর হাট

রহিম শেখ ॥ করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যেই রাজধানীতে বসছে কোরবানির পশুর হাট। সংক্রমণের উর্ধমুখী প্রবণতার মধ্যেই চলছে হাটের প্রস্তুতি। নিয়ম অনুযায়ী ঈদ-উল-আজহার ৫ দিন আগে থেকেই হাটে পশু কেনা-বেচার জন্য আনা হয়। কিন্তু এবার রাজধানী ঢাকার সব অস্থায়ী হাটে নির্ধারিত সময়ের আগেই আসতে শুরু করেছে কোরবানির পশু। এতে পশুবাহী ট্রাকের বাড়তি চাপে যানজটসহ নানা ভোগান্তির আশঙ্কা করছেন নগরবাসী। এদিকে পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে বলা হলেও কোন হাটেই দেখা যায়নি ন্যূনতম পদক্ষেপ। তবে করোনা নিয়ে ভয়ে না থাকলেও পশু বিক্রি নিয়ে ভয়ে আছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে ঢাকার বাইরের হাটগুলো খুব একটা জমে ওঠেনি। কোরবানির হাটগুলোতে পশু আমদানি থাকলেও ক্রেতার উপস্থিতি নেই। এছাড়া দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে অনলাইনে বেসরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারও এগিয়ে এসেছে। রাজধানীসহ প্রায় সারাদেশে বসিয়েছে ডিজিটাল হাট। বিভাগীয় কমিশনার, অনেক জেলার জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে এবার স্থানীয়ভাবেও অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট, এ্যাপস ও ফেসবুক পেজে চলছে প্রচার। দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, এবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় ১১টি এবং উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় ৫টিসহ মোট ১৬ টি অস্থায়ী পশুর হাটে কোরবানির পশুর বেচা-কেনার জন্য ইজারা দিয়েছে কর্পোরেশন। আর এসব হাটের প্রস্তুতির জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছে শনিবার থেকে আগামীকাল সোমবার পর্যন্ত দুদিন। আর ২৮ জুলাই থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত মোট পাঁচদিন চলবে পশু কেনা-বেচা। এ সময়ের আগেই কোনভাবে পশুবাহী ট্রাক রাজধানীতে প্রবেশ করতে পারবে না বলেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা না করেই বিক্রির জন্য দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসতে শুরু করেছে কোরবানি হাটের পশু। এরই মধ্যে সব হাটেই পশু নিয়ে আসতে দেখা গেছে। যদিও অনেক হাটের প্রস্তুতি এখনও শেষই হয়নি। তবে দুই সিটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, নির্ধারিত সময়ের আগেই হাটে পশু আনলেও তেমন কিছু করার নেই। তবে যদি নির্ধারিত সময়ের আগে পশু বিক্রি করে আর সে খবর বা কোন অভিযোগ কেউ কর্পোরেশনকে দিয়ে থাকে তবে ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে দুই সিটি। সরেজমিনে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির কয়েকটি পশুর হাট ঘুরে দেখা যায়, ইতোমধ্যে হাটের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। দুয়েকটি এখনও প্রস্তুতি নিচ্ছে। কোন কোন হাটে বাঁশের খুঁটি, শামিয়ানা টানানো হয়ে গেছে। পশু বিক্রেতারাও পশু নিয়ে নিজেদের পছন্দের জায়গায় অবস্থান নিয়েছেন। তবে এখনও তেমন মিলছে না ক্রেতা। ব্যাপারীরা গরু-ছাগল নিয়ে অপেক্ষায় সময় কাটাচ্ছেন। লালবাগের রহমতগঞ্জ খেলার মাঠ, পোস্তগোলা, গোপীবাগ বালুরমাঠ, দনিয়া কলেজ মাঠ, ভাটারা সাঈদ নগর হাটের ব্যাপারী এবং আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যাপারীরা ভাল জায়গা দখল করতে নির্ধারিত সময়ের আগেই হাটে চলে এসেছে পশু নিয়ে। আর আসার আগেই তারা আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলেই এসেছেন। এতে ব্যাপারীরা বলছেন, তাদের আসতে বলার পর তারা হাটে এসেছে। আর আয়োজকরা বলছেন, সিটি কর্পোরেশনের নিয়মানুযায়ী সময় থাকে ৫ দিন। এ অল্প সময়ে পশু বেচা-কেনার তেমন সুযোগ থাকে না। এতে ব্যাপারী যেমন বিপাকে পড়েন তেমন কাক্সিক্ষত হাসিল না পেলে ব্যবসা ভাল হয় না। তাই আসতে বলা। কুষ্টিয়া থেকে শনিবার সকালে তিনটি গরু নিয়ে পোস্তগোলা হাটে এসেছেন জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, প্রতিবছরই এই হাটে গরু নিয়ে আসি। আমরা গেরাম থাইক্যা আইছি। ওই হানে করোনাটরোনা নাই। করোনা নিয়া ভয়ও পাই না। গোপীবাগ বালুরমাঠে পশু নিয়ে আসা গাইবান্ধার কামরুল ইসলাম জানান, গত শুক্রবার তিনি ছোট ২০টি গরু নিয়ে হাটে এসেছেন। কোরবানির বাজার শেষ হওয়ার পর পর্যন্ত এই জায়গার জন্য তাঁকে দিতে হবে ৪৬ হাজার টাকা। তিনি আরও জানান, অতিরিক্ত টাকা দেয়ার কারণে এখন গরুর দামও বেশি রাখতে হচ্ছে। শনিবার বিকেল পর্যন্ত তিনি ছোট আকারের দুটি গরু এক লাখ পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। নির্ধারিত সময়ের আগে কেন এলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তো সিটি কর্পোরেশনের নিয়ম জানি না। এটা তো হাটের আয়োজকরা বলতে পারবে। তবে আমাদেরকে আসার কথা বলছে বিধায় আমরা আসছি। অপর এক ব্যাপারী আব্দুল সাঈদ বলেন, গতবার পটুয়াখালী থেকে গরু নিয়ে আসার সময় ফেরিঘাটে সমস্যা ছিল। এতে দুটা গরু মারাও গেছে। এবার তাই আগেই চলে এলাম। এখন বিক্রি হইলেই বাঁচি। নির্ধারিত সময়ের আগে কিভাবে হাটে পশু এলো এমন প্রশ্নে হাটের আয়োজকদের একজন মুনির উদ্দিন বলেন, ব্যাপারীরা বারবার ফোন দিচ্ছে আসার জন্য। তাই বলছি নিজ দায়িত্বে থাকতে পারলে আসুক। তবে নির্ধারিত সময়ের আগে বিক্রি হবে না। যদিও ব্যাপারীরা চায় সব সময় দ্রুত পশুটা বিক্রি হোক। এতে বাড়তি খরচ থেকে বেঁচে যাবে এটা তাদের মত। তবে হাটগুলোয় এখনও ব্যবসায়ী ও ইজারাদারদের লোক ছাড়া ক্রেতাদের দেখা তেমন মেলেনি। এদিকে যাঁরা হাটে আছেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা মানার ব্যাপারে কারোরই কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। জীবাণুমুক্ত করার উপকরণ তো দূরের কথা, বেশিরভাগ ব্যবসায়ীর মুখে মাস্ক পর্যন্ত নেই। নেই পশুর হাটের আশপাশে হাত ধোয়ার কোন ব্যবস্থা। নেই তাপমাত্রা পরীক্ষার ব্যবস্থাও। তবে হাট জমে উঠলে এসব ঠিক করা হবে বলে জানিয়েছেন ইজারাদাররা। পোস্তগোলা শ্মশানঘাট বালুরমাঠ হাটের ইজারাদার মইন উদ্দিন চিশতী বলেন, করোনার কারণে আমরা জীবাণুরোধক ব্যবস্থা রাখছি। যেসব গেট দিয়ে ক্রেতারা প্রবেশ করবে সেখানে স্প্রে করে ক্রেতাদের ঢুকতে দেয়া হবে। আমরা ১০ হাজার মাস্ক রাখছি। যেসব ক্রেতা মাস্ক ছাড়া হাটে আসবে তাদের এই মাস্ক দেয়া হবে। এ ছাড়া গরু বিক্রেতা ও গরুর সঙ্গে আসা লোকজনকেও মাস্ক দেয়া হবে। সাঈদনগর পশুর হাটের ইজারাদার ইকবাল হোসেন খন্দকার বলেন, এখনও হাটে ক্রেতা নেই। তবে বিক্রেতারা গরু নিয়ে আসা শুরু করেছেন। হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানতে আমরা বাধ্য। এই ব্যাপারে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোঃ মোজাম্মেল হক বলেন, নির্ধারিত সময়ের আগে সাধারণ ব্যাপারীরা আসতে শুরু করে। এটা প্রতিবছরই হয়ে থাকে। তবে এতে যেন দুর্ভোগ সৃষ্টি না হয় সেজন্য আমরা ইজারাদারদের নির্দেশনা দিয়েছি। মূলত জনদুর্ভোগ হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত আছেন। জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, করোনাভাইরাসের গণসংক্রমণ এড়াতে প্রত্যেক ইজারা গ্রহীতাকে কোরবানি পশুর হাটে সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় ইজারা বাতিল করা হবে। হাট মনিটরিং করার জন্য ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সমন্বয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। তারা হাটগুলো প্রতিদিন পরিদর্শন করবেন। এছাড়া প্রতিটি হাটে একটি করে মোবাইল কোর্ট থাকবে। স্বাস্থ্যবিধি ও অন্যান্য শর্ত মেনে চলছে কিনা তা নিশ্চিত করতে একটি করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। তিনি আরও বলেন, করোনার সংক্রামণ এড়াতে আমরা এবার অনলাইনেও পশু বিক্রির ব্যবস্থা করে দিয়েছি ডিজিটাল হাট নামে একটি প্ল্যাটফর্মে। সেখানে দুই থেকে তিন হাজার পশুর তালিকা রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী আরও সরবরাহ করা হতে পারে। এর মাধ্যমে আমরা মনে করি, একদিকে হাটে না গিয়ে যেমন ঘরে বসেই কোরবানির পশু কেনা যাবে। অন্যদিকে কোরবানি পশুর হাটে স্বাস্থ্য বিধি এবং অন্যান্য শর্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা মনিটরিংয়ের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে (ডিএনসিসি) ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি হাটে একটি করে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হবে। এদিকে, দেশে পর্যাপ্ত কোরবানির পশু থাকায় অন্যান্যবারের মতো এবার দেশের বাইরে থেকে কোন পশু আসছে না বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী এস এম রেজাউল করিম। তিনি বলেন, আমাদের এবার চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পশু দেশেই রয়েছে। তাই এবার বাইরে থেকে কোন পশু আমদানি করা হচ্ছে না। সেই সঙ্গে প্রতিটি কোরবানির পশু স্বাস্থ্যসম্মত কিনা সেটিও পরীক্ষা করতে মন্ত্রণালয় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম এ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে গত বছর সারা দেশে এক কোটি ৫ লাখ পশু কোরবানি হয়েছে। ঢাকা বিভাগে ২৫ লাখ এবং শুধু ঢাকা মহানগরীতে ১৮ লাখ পশু কোরবানির জন্য বিক্রি হয়েছিল। তবে এবার করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এ বছর বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কায় আছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা। সারাবছর কসাইখানায় গরু বিক্রির সুযোগ থাকলেও ক্ষুদ্র খামারিদের লক্ষ্য থাকে কোরবানির হাটে বেশি লাভে পশু বিক্রি করার। বিশেষ করে যারা কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে একটি বা হাতে গোনা কয়েকটি গরু লালনপালন করছেন, তারা এ বছর আকর্ষণীয় দামে গরু বিক্রি করতে পারবেন কিনা, সেটা নিয়ে সংশয়ে আছেন। মুন্সীগঞ্জ জেলার সিঙ্গারটেক গ্রামের বাসিন্দা মোঃ আলী সাত মাস ধরে দুটি গরু লালনপালন করে আসছেন। গরু দুটি তিনি কিনেছিলেন ৭০ হাজার টাকায়। প্রতিমাসে এই গরুর পেছনে তার খরচ হয়েছে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। তিনি ভেবেছিলেন এবারের কোরবানির ঈদে ঢাকার পশুর হাটে ভাল দামে তার গরু দুটি বিক্রি করে লাভ তুলে নেবেন। কিন্তু করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে লাভ তো দূরে থাক, এই গরু বিক্রি করে সারা বছরের খরচটাও তুলতে পারবেন কিনা সেটা নিয়েই সন্দেহে আছেন। তিনি জানান, আমার তো ইচ্ছা ছিল অন্তত দেড় লাখ টাকায় গরু দুটো বেচব। আগের বছরগুলোয় এমন দামেই বিক্রি করেছি। কিন্তু করোনার কারণে এবারে ওই দাম পাব না। কিন্তু বিক্রি তো করতেই হবে। আরও এক বছর এই গরুর খাওয়া চালানো সম্ভব না। ঢাকার বাইরের হাটও জমে ওঠেনি ॥ কোরবানির হাটগুলোতে পশু আমদানি থাকলেও ক্রেতার উপস্থিতি কম ঢাকার বাইরের হাটগুলোতেও। পাবনা সদরের আরিফপুর হাজিরহাট, টেবুনিয়া, পুষ্পপাড়া, ঈশ্বরদীর আওতাপাড়া, অরনকোলা, বেড়ার চতুর হাট, কাশিনাথপুর, চাটমোহরের রেলবাজার, ভাঙ্গুড়ার শরৎনগরসহ বিভিন্ন হাটে দেখা গেছে, নানা দামের, নানা রঙের কোরবানির পশু উঠেছে। কিন্তু বিক্রেতারা ক্রেতা সঙ্কটে দিশেহারা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাটে অবস্থানের পর বিক্রি না হওয়ায় পশু নিয়ে আবার বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। সুজানগরের সাতবাড়িয়া পদ্মাপাড়ের আশু শিকদার জানান, প্রতিবারই তিনি দুটি করে গরু লালন-পালন করেন। ঈদের আগে বাইরের ব্যাপারী এসে কিনে নিয়ে যায়। কিন্তু এবার করোনার কারণে বাইরের ব্যাপারী না আসায় তিনি গরু দুটি নিয়ে বিপাকে আছেন। হাজিরহাটের বাদশা মিয়া বলেন, বাড়িতে ১৫টি করে গরু পালন করে কোরবানির সময় বিক্রি করি। কিন্তু এবার বাড়িতে কোন ক্রেতা না যাওয়ায় হাটে এনেছি। কিন্তু লোকই নেই, গরুর দাম বলবে কে? মেহেরপুরের খামারি মহির উদ্দিন বলেন, করোনার আগে যে গরুর দাম ব্যাপারীরা তিন লাখ টাকা বলেছেন, এখন সেই গরু দুই লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারছি না। গরুর দাম কমে যাওয়ায় আমার মতো অনেকেই চরম বিপাকে পড়েছেন। প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন ঝিনাইদহের মহেশপুরের খামারি কুদ্দুস। তিনি বলেন, করোনার আগে আমার একটি গরুর দাম ব্যাপারীরা ৬৫ হাজার টাকা বলেছিলেন। কোরবানির ঈদের আগে আরও বেশি দাম পাওয়া যাবে, এই আশায় তখন বিক্রি করিনি। এখন সেই গরু ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। ‘ভিড় বাড়ছে’ অনলাইন হাটে ॥ মহামারীর মধ্যে কোরবানির ঈদ সামনে রেখে চালু করা পশুর অনলাইন মার্কেট প্লেসগুলোতে ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। ক্রেতারা ওয়েবসাইটগুলোতে গিয়ে পশুর দরদাম যাচাই করছেন। তবে ডিজিটাল হাটে আড়াই হাজারের বেশি কোরবানির পশু উঠলেও তেমন বিক্রির খবর নেই ব্যবসায়ীদের কাছে। ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল জানান, ক্রেতাদের ভিড় বাড়ছে ডিজিটাল হাটে। ডিজিটাল হাটে গত কয়েক দিন প্রায় এক লাখ ভিজিটর তাদের পছন্দসই গরু যাচাই-বাছাইয়ের চেষ্টা করেছেন। এখনও বিক্রি তেমন নেই। তবে আশা করছি, ঈদের আগে বিক্রি বাড়বে। করোনাভাইরাস মহামারীকালে কোরবানির পশু কেনাবেচায় গত ১১ জুলাই থেকে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘ডিজিটাল হাট’ শুরু হয়। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম এ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে বাস্তবায়িত হয়েছে এই ডিজিটাল হাট। প্রায় দুই হাজার পশু কোরবানি এবং মাংস প্রক্রিয়াজাত করে ঢাকায় হোম ডেলিভারি দিতে প্রস্তুতি নিয়েছে ‘ডিজিটাল হাট’। প্রচলিত হাটে পশু কেনায় হাসিল দিতে হলেও এখানে ক্রেতাদের কোন হাসিল দিতে হবে না। তবে অনলাইন হাটগুলোতে গরুর দাম নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে ক্রেতাদের। এ বিষয়ে অনলাইন বিক্রেতারা বলছেন, ক্রেতারা এখনও অনলাইনে কেনাকাটার ‘সুবিধা বুঝতে পারছেন না’। আব্দুল ওয়াহেদ তমাল জানান, ৫৪টি অনলাইন বিক্রয় পার্টনারের সহায়তায় আড়াই হাজারের বেশি গরু সংযুক্ত হয়েছে ডিজিটাল হাটে। তাই রং, আকার, ছোট-বড়, দেশী-বিদেশী সব ধরনের গরু, ছাগল, মহিষ কেনা যাবে এই হাট থেকে। আর ন্যায্যমূল্যের বিষয়টি তদারকি করছে উত্তর সিটি কর্পোরেশন। তাই দাম নিয়ে ক্রেতাদের ‘ভাবতে হবে না’। এখনও ক্রেতা না পাওয়ার কারণ হিসেবে তমাল বলেন, ক্রেতাদের বোঝানো যাচ্ছে না কীভাবে গরু কিনে তারা সুবিধা করতে পারবেন। অনেকেই ছবি বা ভিডিও দেখে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। একটি লাইভ গরুর ওজন অনুযায়ী বিক্রির সুবিধা থাকায় ক্রেতাদের সহজেই অনুমান করার সুযোগ রয়েছে, গরুর আসল ওজন কত হবে। ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন সদস্যদের মধ্যে প্রায় ১০০ ব্যবসায়ী কোরবানির পশু অনলাইনে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান তমাল। এ প্রসঙ্গে তার পরামর্শ হচ্ছে, শুধু ফেসবুকভিত্তিক বা অপরিচিত ওয়েবসাইট থেকে গরু কেনার আগে ভাল করে যাচাই-বাছাই করে নেয়া উচিত। বিশেষ করে তারা যেন বিশ্বাসযোগ্য ওয়েবসাইট থেকে গরু কেনেন। তিনি বলেন, কোন ওয়েবসাইট থেকে কেনার আগে সেটার বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করে দেখা উচিত। প্রয়োজনে আগের ক্রেতাদের রিভিউ দেখা যেতে পারে। ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশনের সদস্য কিনা সেটাও দেখা উচিত। কোরবানির পশু বিক্রি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং সাদেক এ্যাগ্রোর মালিক মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, অনলাইনে বিক্রি ভালই হচ্ছে। আমার খামার থাকায় ক্রেতারা সুবিধাও বেশি পাচ্ছেন। অনলাইনে পছন্দ করে খামারে এসে চূড়ান্ত করে যাচ্ছেন। ৩৮ লাখ টাকার গরু অনলাইনে পছন্দ করার পর সরাসরি খামারে এসে সেটা কিনে নিয়েছেন বলেও জানান ইমরান। ঈদের তিন থেকে চার দিন আগে বিক্রি বাড়ার আশা প্রকাশ করে সাদেক এ্যাগ্রোর মালিক বলেন, তার অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এখনও হাজারের বেশি পশুর ছবি দেয়া আছে বিক্রির জন্যে। বেচা-বিক্রি নিয়ে আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর বলেন, ঈদের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে। প্রতিদিনই সাইটে ক্রেতাদের ভিজিট বেড়ে চলছে। ঈদের কয়েক দিন আগে বিক্রি বাড়বে বলে আশা করছি। বেঙ্গল মিটের হেড অব রিটেইল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান বলেন, এবার কোভিড-১৯ মহামারী বিবেচনায় কোরবানির জন্য শুধু প্রক্রিয়াজাত মাংস সরবরাহের উদ্যোগ নিলেও গ্রাহকের চাহিদায় এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন তারা। বর্তমানে ক্রেতাদের জন্য প্রসেসড ছাড়াও কোরবানির পশু সরবরাহ করা হচ্ছে। এবার অনলাইনে গরু কেনাকাটা নিয়ে ব্যাপক প্রচার দেখা গেলেও এ পদ্ধতিতে কোরবানির পশু বেচাকেনার বিষয়ে একেবারেই পরিচিত নন প্রান্তিক খামারিরা। এমন অবস্থায় অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যারা কাজ করেন, তারা চেষ্টা করছেন ক্ষুদ্র খামারিদের বোঝাতেÑ কিভাবে তারা হাটে না গিয়েই পশু বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব থাকায় তারা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও ভরসা করতে পারছেন না। পশু কোরবানির জন্য ২৫৬টি স্থান নির্ধারণ ॥ আসন্ন ঈদ-উল-আজহায় পশু কোরবানির জন্য ২৫৬টি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই নির্ধারিত স্থানে নগরবাসীকে পশু কোরবানি করার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি (ডিএনসিসি) কর্পোরেশনের মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম। একই সঙ্গে ডিএনসিসি হালাল উপায়ে পশু কোরবানি করার জন্য ২৫০ জন ইমাম ও ২৫০ জন মাংস প্রস্তুতকারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ও পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য মোট ১১ হাজার ৫০৮ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলেও জানান মেয়র। শনিবার কোরবানি পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে ডিএনসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে অনলাইন সভায় তিনি এ আহ্বান জানান। সভায় অন্যদের মধ্যে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আবদুল হাই, সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়ূয়া, প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমোডর এম সাইদুর রহমান, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন, প্রধান প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম, প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক, মহাব্যবস্থাপক (পরিবহন) আবদুল লতিফ খান এবং আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় কোরবানি পশুর হাট এবং কোরবানি পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়ে মেয়র বলেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে কোরবানি পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নের জন্য মনিটরিং জোরদার করা হবে। ইতোমধ্যে ১০ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি করা হয়েছে। তিনি বলেন, কোরবানি পশুর বর্জ্য অতিদ্রুত পরিষ্কার করে একটি দুর্গন্ধহীন সুন্দর শহর উপহার দেয়াই আমাদের লক্ষ্য। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা চাই একটি সুন্দর কোরবানি পশুর হাট এবং একটি সুন্দর শহর। মেয়র বলেন, কোরবানির পশুর বর্জ্য সুষ্ঠুভাবে অপসারণের জন্য অতিরিক্ত জনবল ও যানবাহন বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে ডিএনসিসির নিজস্ব, আউটসোর্সিং এবং প্রাইমারি ওয়েস্ট কালেকশন সার্ভিস প্রোভাইডার (পিডব্লিউসিএসপি) কর্মীসহ মোট ১১ হাজার ৫০৮ পরিচ্ছন্নতা কর্মী এবং ডিএনসিসির সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী প্রস্তুত থাকবে। এজন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বর্জ্য অপসারণের জন্য ভারি ও হালকা মিলিয়ে মোট ৪৩০টি যানবাহন প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বিশেষভাবে ১১টি পানির গাড়ির মাধ্যমে স্যাভলন ও বিচিং মিশ্রিত পানি ছিটিয়ে কোরবানির স্থান দূষণমুক্ত করা হবে। পরিবেশ সুরক্ষা ও দূষণমুক্ত রাখার লক্ষ্যে প্রায় ৫১ টন ব্লিচিং পাউডার ও পাঁচ লিটার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ৯৬০ ক্যান তরল জীবাণুনাশক ছিটানো হবে। এছাড়া পরিবেশসম্মতভাবে বর্জ্য সংরক্ষণের জন্য ডিএনসিসি থেকে প্রায় ছয় লাখ বিশেষ ধরনের ব্যাগ বিতরণ করা শুরু হয়েছে। সভায় জানানো হয়, কোরবানি ঈদের দিন প্রায় ১০ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হবে। ডিএনসিসি প্রতিবছরের মতো এ বছরও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এসব বর্জ্য অপসারণ করা হবে। নির্ধারিত স্থানে কোরবানি দেয়া এবং যত্রতত্র কোরবানির পশুর বর্জ্য না ফেলতে জুমার নামাজের খুতবার সময় জনসচেতনতামূলক বার্তা শোনানোর জন্য প্রত্যেক মসজিদের ইমামদের মেয়রের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া মাইকিং, লিফলেট, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যত্রতত্র পশু জবাই করা থেকে বিরত থাকা এবং পরিবেশসম্মতভাবে নির্ধারিত স্থানে পশু কোরবানি দিয়ে নির্ধারিত ব্যাগে বর্জ্য সংরক্ষণ করার জন্য জনসাধারণকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
×