ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ঘরে বসেই সুস্থ হচ্ছেন করোনা রোগী

সামান্য গরম পানি লেবু লং এলাচই আজ মহৌষধ

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ২৬ জুলাই ২০২০

সামান্য গরম পানি লেবু লং এলাচই আজ মহৌষধ

মোরসালিন মিজান ॥ একটু পেছনে ফিরে যাওয়া যাক। কী দেখব আমরা? যারপরনাই নির্মম নিষ্ঠুর ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠবে। সারাদেশে হাসপাতাল আছে। চিকিৎসক আছে। শুধু যা দরকার, সেই চিকিৎসা নেই। অনেক নন-কোভিড রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ছোটাছুটি করে মারা যাচ্ছেন। ভর্তি হতে পারছেন না। নির্ধারিত হাসপাতালে কোভিড রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বটে। কর্তব্যরত ডাক্তারদের আন্তরিকতা ও সেবার মান নিয়ে উঠছে অযুত প্রশ্ন। রোগীরা অভিযোগ করছেন, অনেক চিকিৎক করোনায় আক্রান্তদের ওয়ার্ডে প্রবেশই করছেন না। মারা গেলে মরদেহ বেডে পড়ে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আরও কত অভিযোগ। ভয়ঙ্কর সব অভিজ্ঞতার বয়ান। এবার বর্তমানে ফেরা যাক। হাসপাতাল আছে। ভর্তি ইচ্ছুক রোগী নেই! নেই মানে, অনেক কম। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কিছুদিন আগের একটি পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সাধারণ শয্যা রয়েছে ১৪ হাজার ৭১৫টি। রোগী ভর্তি আছে ৪ হাজার ৭৯ জন। খালি পড়ে আছে ১০ হাজার ৬৩৬টি। সারাদেশে আইসিইউ শয্যা ৩৭৬টি। রোগী ভর্তি আছে ২১০ জন। খালি ১৬৬টি। সবমিলিয়ে, মোট শয্যার সংখ্যা ১৫ হাজার ৯১টি। এর মধ্যে ৪ হাজার ২৮৯টি শয্যায় রোগী ভর্তি আছে। শূন্য পড়ে আছে ১০ হাজার ৮০২ শয্যা। অথচ করোনাকাল ফুরিয়ে যায়নি। সংক্রমণ বাড়ছে। মৃত্যুও। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা শনিবার যে তথ্য প্রকাশ করেছেন তাতে দেখা যায়, দেশে করোনা আক্রান্তের মোট সংখ্যা ২ লাখ ২১ হাজার ১৭৮ জন। মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৮৭৪ জনের। এর বাইরে বহু মানুষ রোগটিকে জয় করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছেন। আইইডিসিআর বলছে, এ সংখ্যাটি ১ লাখ ২২ হাজার ৯০। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক রোগী সেরে উঠছেন। এবং বিস্ময়কর তথ্য এই যে, সেরে উঠাদের বড় অংশটি বাসায় চিকিৎসা নিয়েছে। হ্যাঁ, একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে, এ পর্যায়ে এসে, বেশিরভাগ চিকিৎসাই চলছে বাসায়। ফোনে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সে অনুযায়ী ওষুধ সেবন করছেন রোগীরা। আক্রান্ত ব্যক্তি বাসার কোন একটি কক্ষে একলা অবস্থান করছেন। স্বেচ্ছায় চলে যাচ্ছেন আইসোলেশনে। নিকটাত্মীয়রা আতঙ্কিত না হয়ে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে রোগীর সেবা করছেন। তাতেই কাজের কাজটি হয়ে যাচ্ছে। সব কিছু ঠিকঠাক চললে ১৪ দিন পরে মিলছে ‘নেগেটিভ’ সার্টিফিকেট। শহর ঢাকার পরিচিত অপরিচিত কয়েকজন কোভিড রোগী ও তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে গৃহ চিকিৎসার নানা দিক ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়েছে। শরীরে করোনা নিশ্চিত হওয়ার পর তারা ফোনে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে পরামর্শ নিয়েছেন। সে অনুযায়ী ওষুধ সেবন করেছেন। ওষুধ বলতে, বিশেষ কিছু নয়। সর্দি জ্বর কাশি গলা ব্যথা হলে যেসব ওষুধ সেবন করার কথা, সেগুলোই। তবে কার্যকর চিকিৎসা ছিল নিজেদের হাতেই। চুলোয় সব সময় গরম পানির পাতিল বসানো থাকত। নাক দিয়ে এ পানির ভাপ নিতেন রোগীরা। আবার লং এলাচ দারুচিনি গোলমরিচ ইত্যাদি মশলা পানিতে ছেড়ে লম্বা সময় ধরে জাল দেয়া হতো। বিশেষ এ পানির ভাপ আরও বেশি কার্যকর হয়েছে। গলা ব্যথা করলে লবণযুক্ত গরম পানি দিয়ে গরগরা করেছেন। ঘন ঘন লেবু চা পান করেছেন। গরম স্যুপ সব সময় তৈরি থাকত। এসবের বাইরে লেবু মাল্টা আমলকিসহ বিভিন্ন উৎস থেকে গ্রহণ করতেন ভিটামিন ‘সি’। এভাবে কয়েকদিন চালানো গেলে বেশিরভাগ করোনা পরীক্ষায় ‘নেগেটিভ’ ফল এসেছে। বাসায় চিকিৎসা নিয়ে করোনামুক্ত হয়েছেন ধানম-ির ইকরামুল হক। রাজধানীর একটি কলেজে পড়ান। অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলছিলেন, করোনা শনাক্ত হওয়ার পর প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। হাসপাতালে ভর্তিরও চেষ্টা করেছি। পরে ব্যর্থ হয়ে বাসায় চিকিৎসা শুরু করি। আমার স্ত্রী কিছুক্ষণ পর পরই পানি গরম করে আমার রুমের সামনে রেখে যেতেন। আমি সে পানিতে ভাপ নিয়েছি। লেবু ও মাল্টার জুস করে দেয়া হয়েছে। খেয়েছি। তাতেই স্বস্তিবোধ করেছি। আমার মনেই হয়নি, করোনা আছে শরীরে। মগবাজারের বাসায় চিকিৎসা নিয়েছেন আসাদুজ্জামান মিলন। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেন। বললেন, ত্রাণ বিতরণ করতে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। হয়ত তখনই করোনায় আক্রান্ত হই। এর পর থেকেই ভোগান্তির শুরু। টেস্ট করাতে অনেক ভুগতে হয়েছে। হাসপাতালে রোগী অনেক। এত রোগীর মাঝে নিজের চিকিৎসা কী হবে, তা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম। অনেক অব্যস্থাপনা ও ভীতিকর অভিজ্ঞতার কথাও শুনেছি। অন্যদিকে, পরিচিত অনেকেই নিয়ম মেনে বাসায় থেকে ভাল হয়েছেন। সবদিক চিন্তা করে আমিও বাসায় চিকিৎসা গ্রহণ করি। কিছুটা শ্বাসকষ্টও ছিল আমার। কিন্তু গৃহচিকিৎসায় সম্পূর্ণ ভাল হয়েছি। এমন উদাহরণ আরও অনেক দেয়া যাবে। তারকা ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজার কথাই ধরা যাক, তার জন্য হাসপাতালের কোন অভাব নিশ্চয়ই ছিল না। এর পরও তিনি বাসায় করোনার চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ভালও হয়েছেন। সরকারের মন্ত্রী সচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও বাসায় থেকে নেগেটিভ হয়েছেন। এদিকে, শুধু করোনা হলেই গৃহচিকিৎসা নিচ্ছেন সবাই, এমন নয়। করোনা ঠেকাতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ওপর বিশেষ জোড় দিচ্ছে মানুষ। শরীরের ইউমিনিটি বাড়াতে অগ্রিম বিভিন্ন ওষুধ সেবন করছেন। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালযের সাবেক ভিসি ডাঃ কামরুল ইসলাম খানের সঙ্গেও। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ঘরে যে চিকিৎসা হচ্ছে তাতে কোন ভুল নেই। যেসব নিয়ম মানা হচ্ছে, পথ্য গ্রহণ করা হচ্ছে তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। তবে সব কিছুর আগে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। সব মিলিয়ে দারুণ আস্থা কুড়িয়েছে গৃহচিকিৎসা। করোনার কালে মানুষ নিজেই নিজের ডাক্তার হয়ে উঠেছেন। ঘরেই সাজিয়ে নিচ্ছেন হাসপাতালের শয্যা। তার চেয়ে বড় কথা, এই দুর্যোগের কালে ঘরে থেকেই মানুষ তার আস্থা ফিরে পেতে শুরু করেছে। এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে?
×