ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পবিত্র হজের আর ৩ দিন বাকি

প্রকাশিত: ২২:৫০, ২৬ জুলাই ২০২০

পবিত্র হজের আর ৩ দিন বাকি

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ পবিত্র ঈদ-উল-আজহা বা কোরবানি আমাদের অন্যতম প্রধান উৎসব। ‘কোরবানি দান’ কেন উৎসবের মর্যাদা পেয়েছে তা আমাদের অনুধাবনের প্রয়োজন রয়েছে। কোরবানি অর্থ যে কোন ধরনের ত্যাগ। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় ত্যাগে আবার উৎসব বা আনন্দের কি আছে? এত বেদনার এবং হারানোর। আসলে আমরা যদি একটু গভীরে চিন্তা করি তাহলে দেখব কোরবানি বা ত্যাগ, যে উৎসর্গ যে আত্মদান মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়, তা তো অন্তর থেকে স্বতঃস্ফূর্ত নিঃসরিত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ (ত্যাগের) উৎসব। ‘ঈদ-উল-আজহার’ শব্দগত ও পারিপার্শ্বিক মর্মের স্বার্থকতা এখানেই। বলা হয়েছে ‘ফা সোয়াল্লি লি রাব্বিকা ওয়ান হার’- তোমার পালনকর্তার নামে নামাজ আদায় কর এবং কোরবানি দাও।’-(১০৮/২)। কোরানের ৪র্থ পারার শুরুতে রয়েছেÑ ‘কস্মিনকালেও কল্যাণলাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে তোমরা ব্যয় না কর। আর তোমরা যা যা কিছু ব্যয় (বা দান) করবে আল্লাহ তা জানেন।’ হুজুরেপুর নূর (সা) এরশাদ করেছেন, ‘আল ইয়াদুল ওলিয়া খাইরমি মিন ইয়াদিস সুফলা— ওপরের হাত নিচের হাত হতে উত্তম।’ অর্থাৎ দান গ্রহণকারী থেকে দান সাদকাকারী ব্যক্তি উত্তম। এ হাদীসে ত্যাগের মাধ্যমে আনন্দ লাভের জন্য উৎসাহিত করা হলো। ইতিহাসে একটা বিষয় লক্ষণীয়। প্রভূকে খুশি করার জন্য কিংবা উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য দুনিয়ার সব ক’টি প্রাচীন ধর্ম ও মতবাদে কোরবানি প্রথা দেখা যায়। যদিও তখনকার বিশ্বাস ও ধারণার পদ্ধতিগত বিষয়ে কিছুটা গলতি পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে পশু কিংবা মানুষের বলিদানের দৃষ্টান্ত বহু। যা একালেও স্বীকৃত এবং ইসলাম ধর্ম এ প্রথাকে পরিমার্জিত সহজতর ও সহজসাধ্য করে জগতবাসীর সামনে ধরে রেখেছে। প্রাচীনকালে আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের মধ্যে মানব বলি দেয়ার কথা জানা যায়। বিশেষত, মেক্সিকোর আদিম সম্প্রদায় বিভিন্ন দেবতার নামে মানুষ উৎসর্গ করত। আফ্রিকার আদিম অধিবাসীরাও অবিবাহিতা যুবতীদের উৎসর্গ করত। প্রাচীন মিসরীয় এবং গ্রীক রোমানদের মধ্যে নর বলির ব্যাপক প্রচন ছিল। মিসরীয় নীল নদের নামে প্রতিবছর একটি করে মেয়ে উৎসর্গ করত। তাদের বিশ্বাস ছিল তাতে নদী সন্তুষ্ট হয়ে পুরো দেশ পানিতে স্বয়ংম্বর করে দেবে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রাদি) এ ঘৃণ্য রেওয়াজ কঠোর হস্তে বন্ধ করেন। আদি যুগের কোন কোন কোরবানি প্রথার বর্ণনা স্বয়ং পবিত্র কোরানেও দেখা যায়। কোরান থেকে প্রাপ্ত ধারণা মতে, কোরবানি উৎসর্গের রেওয়াজ আদি পিতা হযরত আদম (আ)-এর দু’সন্তান হাবিল ও কাবিলের সময় থেকে প্রচলিত হয়েছিল। হাবিল ও কাবিলের কোরবানিকেই আদি কোরবানি বলে ধরে নেয়া হয়। তাদের দু’জনের বিয়েকে কেন্দ্র করে পশু কোরবানির ঘটনা আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়েদায় সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। বিশ্বের বুকে এটি সর্বপ্রথম কোরবানির ঘটনা এবং কাবিল কর্তৃক হাবিলকে হত্যা করার ঘটনাটি ছিল প্রথম মানব হত্যা। নূহ নবীর (আ) আমলে এ প্রথা বিদ্যমান ছিল। মিসরের প্রখ্যাত আলিম মুহাম্মদ ফরিদ ওয়াজদী দায়েরাতুল মা’ আরিফ গ্রন্থে প্রমাণ সহকারে বলেন, হযরত নূহ জন্তু জবেহ করার উদ্দেশ্যে একটি কোরবানি গাহ নির্মাণ করেছিলেন। তাফসীরে হাক্কানীর ভাষ্যনুযায়ী, ইব্রাহিম উত্তর সমস্ত নবী-রাসূলের জামানায় পশু কোরবানি শরিয়তের বিধান রূপলাভ করে। মূসা নবীর (আ) যুগের একটি বিশেষ ঘটনা উঠে এসেছে সূরা বাকারায়। বনি ইসরাঈলের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছিল। তা হত্যাকারী কে তা জানা যাচ্ছিল না। তখন আল্লাহর নির্দেশে মূসা তাদেরকে একটি গরু যবেহ করে এর এক টুকরা গোস্তের দ্বারা নিহত ব্যক্তিটির গায়ে আঘাত করতে বলেন। তার আদেশ মতো কাজ করলে নিহত ব্যক্তিটি জীবিত হয়ে ওঠে এবং হত্যাকারীর নাম বলে দিয়ে পুনরায় মারা যায়। আবার জাহিলিয়াত যুগের একটি ঘটনার কথা ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। তখন সন্তানদের দেবতার নামে কোরবানি করা হতো। আমাদের মহানবীর দাদা আবদুল মুত্তালিব জমজম কূপ খননের সময় এক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হন। তার একমাত্র পুত্র হারেস ছাড়া আর কেউ তাকে সাহায্যকারী ছিল না। এ অবস্থায় তিনি মান্নত করলেন যে, তার যদি দশ পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে তাহলে অন্য লোকের সহাযোগিতার প্রয়োজন হবে না এবং তিনি একজনকে হুবেল দেবতার নামে উৎসর্গ করবেন। তার পুত্র সন্তান দশজন হলে তিনি একজনকে কোরবানি দিতে লটারি টানলেন। লটারিতে আবদুল্লাহর নাম আসে। তিনি আবদুল্লাহকে জবেহ করতে মনস্থ করলেন। কিন্তু তার কন্যারা ও কুরাইশরা এতে বাধা দিয়ে আবদুল মুত্তালিবকে একজন গণকের কাছে যেতে পরামর্শ দিল। গণকের সুন্দর পরামর্শে আবদুল্লাহ প্রাণে বেঁচে যান। তা আরও বিস্তারিত রয়েছে গোলাম মোস্তাফা রচিত ‘বিশ্ব নবীতে’। পাঠক জেনে রাখলে ভাল হয় এই আবদুল্লাহই ছিলেন পরবর্তীতে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সালল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌভাগ্যবান পিতা। আর এটাও সুখকর অবগতি যে, আজ আমরা যে ইব্রাহিম-ইসমাঈল হাজেরা (আ) পবিত্র স্মৃতি নির্ভর কোরবানি দিয়ে আসছি হযরত আবদুল্লাহর জন্ম ছিল এদেরই বংশে। আর আমাদের মহানবী (স) এ বংশরেই উজ্জ্বলতম ও কাক্সিক্ষত আলোকবর্তিকা। আল্লাহর তামাম জাহানে সর্বশ্রেষ্ঠ কোরবানি ছিল হযরত ইব্রাহিম ও তার স্ত্রী হাজেরা (আ) কর্তৃক পুত্র কোরবানি। পরওয়ার দিগারের নির্দেশকে অকুণ্ঠচিত্তে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার এ ছিল এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। নবী ইব্রাহিমের উত্তরসূরি হিসেবে আমাদেরকেও যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে। আজ উদ্ভূত করোনা পরিস্থিতিতে ভোগের চাহিদা পরিহার করে পরস্পর ত্যাগী মনোভাবে উজ্জীবিত হতে পারলেই কেবল এ মুসিবত থেকে উত্তরণ সম্ভব। ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারস... হে আল্লাহ অবশ্যই আমি তোমার নিকট পানাহ চাই স্বেতী, উন্মাদ, কুষ্ঠরোগ এবং সকল প্রকার কঠিন ব্যাধি থেকে।’ -(আবু দাউদ, তিরমিজি শরিফ)।
×