ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দেশের অর্ধেক এলাকা প্লাবিত

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে

প্রকাশিত: ২২:৪২, ২৬ জুলাই ২০২০

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের বন্যার স্থায়িত্ব এক মাস পেরিয়েছে। এরপরও পরিস্থিতির উন্নতির কোন সুখবর নেই। বরং এখনও পর্যন্ত দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এ অবস্থায় আরও অবনতি হওয়ার আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এদিকে একমাস পরেও প্রধান নদ নদীর পানি বাড়ার আভাসের ফলে বন্যার স্থায়িত্ব আর দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। ইতোমধ্যে বন্যায় দেশের অর্ধেক এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ লোক। অধিকাংশ নদীর পানি এখনও বাড়ছে। ফলে বন্যার স্থায়িত্বের সঙ্গে বিস্তৃতি বাড়ছে নতুন নতুন এলাকায়। দেশের অন্যান্য এলাকার মতো রাজধারীন চারদিকে নিম্নাঞ্চল দীর্ঘসময় ধরে বন্যার কবলে রয়েছে। এখনও পানি কমার কোন আভাস নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে রাজধানীর ঢাকার চারদিকে বন্যা পরিস্থিতি আরও এক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা এবং ধলেশ্বরীর পানি বাড়ছেই। আজকের মধ্যেই পানি বেড়ে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এছাড়া সারাদেশে বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে। দুদিনের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে (পিকটাইমে) পৌঁছাতে পারে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে পানি নামতে শুরু করবে। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বন্যার পানি নেমে যাবে। তবে জানা গেছে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি করতে পারে। সে কারণে এই সময়ে সাগরে পানির লেবেল বাড়বে। ফলে পানি নেমে যেতে দেরি হতে পারে। পানি নামতে দেরি করলে এবার বন্যার স্থায়িত্বও আরও বেড়ে যেতে পারে। প্রতিমন্ত্রী জানান মৌসুমের তৃতীয় দফা বন্যায় দুর্গত দেশের ১৬ জেলায় আরও দুদিন পানি বাড়বে। সমুদ্রে জোয়ারের কারণে দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যার পানি কমতে দেরি হতে পারে। আর জোয়ারে সমস্যা না হলে অগাস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দেশের সব জায়গা থেকে বন্যার পানি নেমে যেতে পারে। শনিবার সচিবালয় থেকে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, এক মাস হয়ে গেল বন্যা। ২৬ জুন থেকে বন্যা শুরু হয়, ১১ জুলাই থেকে দ্বিতীয় দফায় পানি বাড়ে এবং ২১ জুলাই থেকে তৃতীয় দফায় পানি বাড়ছে। বন্যার পূর্বাভাস তুলে ধরে তিনি বলেন, আগামী দুই দিনে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ঢাকা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নাটোর, বগুড়া, জমালাপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল এবং নওগাঁ জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে, তারপর পানি কমতে শুরু করবে। বন্য পূর্বাভাস কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়ছে, এটা কিছুদিন অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা ও পদ্মা নদীর পানি বাড়তে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদীর পানি কমছে। ঢাকা জেলার আশপাশের নদীর পানি আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে আজকের মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় বন্য পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। অন্য জেলায় ২৭ জুলাই পর্যন্ত পানি বাড়ার পর আস্তে আস্তে কমতে শুরু করবে। তিনি বলেন, বন্যার্তদের জন্য গত ২৮ জুন থেকে ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তিন কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার নগদ টাকা, ৫২ হাজার ১০ মেট্রিকটন চাল, এক লাখ ২১ হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট, গো-খাদ্য কিনতে এক কোটি ৪৮ লাখ টাকা এবং শিশু খাদ্য কিনতে আরও ৭০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। কয়েক জায়গায় ঘরবাড়ি নদীতে ভেঙ্গে গেছে, সেগুলো নির্মাণের জন্য ৩০০ বান্ডেল টিন এবং ৯০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। তিন দফায় দেশের ৩১টি জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে। ১৪৭টি উপজেলায় আট লাখ ৬৫ হাজার ৮০০টি পরিবারের ৩৯ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩৭ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তিনি বলেন ত্রাণের কোথাও কোন সঙ্কট নেই। পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ আছে, তেমনি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড লেভেলেও পর্যাপ্ত মজুদ আছে। সারাদেশের বন্যা পরিস্থিতি কেরানীগঞ্জ, ঢাকা ॥ ধলেশ্বরী নদীতে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে ভয়াবহ নদী ভাঙ্গন। উপজেলার মুগারচর ও লাকীরচর গ্রামের ৩০টি বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে গেছে। এই ভাঙ্গনের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের সহ¯্রাধিক বাড়িঘর। রোহিতপুর ইউনিয়নের মুগারচর ও লাকীরচরে গত সপ্তাহ থেকে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ধলেশ্বরী নদীর তীরে এই এলাকায় প্রায় সাত কিলোমিটার ভেঙ্গে নদীতে চলে গেছে। ভাঙ্গন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পার্শ¦বর্তী আরও কয়েকটি গ্রামের প্রায় সহ¯্রাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মাদারীপুর ॥ উজান থেকে নেমে আসা পানিতে মাদারীপুরের ৪ উপজেলার ৩০ ইউনিয়ন বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিবচর উপজেলার পদ্মা বেষ্টিত চরাঞ্চলের গ্রামগুলো। চরের ৪ ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রামের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, হাট-বাজার পানিতে তলিয়ে গেছে। জেলায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ২০ হাজার পরিবার। বন্যায় ক্ষতিগস্ত প্রায় ৩ হাজার মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদীতে ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। বিলীন হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ি, রাস্তা ঘাটসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারী-বেসরকারী স্থাপনা। ধ্বংস হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। কুড়িগ্রাম ॥ সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরির্বতিত রয়েছে। ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি ধীর গতিতে কমলেও প্রতিটি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন স্থানে বেড়িবাঁধে ভেঙ্গে গেছে। দীর্ঘ এক মাস ধরে জেলার ৬৫টি ইউনিয়নে ৪০৫টি চরদ্বীপ চরের প্রায় সাড়ে ৬ শতাধিক গ্রামে সাড়ে ৪ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী মানুষ চরম কষ্টে দিন কাটােেচ্ছ। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন চরাঞ্চলের কর্মজীবী মানুষেরা। বন্যা আর বৃষ্টির ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এ অঞ্চলের বানভাসিদের। গাইবান্ধা ॥ গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আবারও মারাত্মক অবনতি হওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গাইবান্ধা পৌর এলাকার কিছু কিছু এলাকাসহ জেলা শহরের পার্শ্ববর্তী নিচু এলাকাগুলোতে বসতবাড়ি ও সড়কে পানি উঠতে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে গাইবান্ধা সদর, সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ, গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ি উপজেলায় নদী ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে ভাঙ্গন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে এসব এলাকার মানুষ। বগুড়া ॥ বগুড়ায় যমুনা ও বাঙালী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনটে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। শনিবার বিকেল পর্যন্ত সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ১২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং বাঙালীর পানি বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন উজানে বৃষ্টি ও ঢলের পানির কারণে দুই নদীতেই পানি বৃদ্ধির হার বাড়ছে। কিশোরগঞ্জ ॥ জেলার হোসেনপুরে কয়েক দিনের টানা ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চলের সহ¯্রাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এছাড়া নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় তীব্র ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে উপজেলার চরাঞ্চলের অনেক ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও সবজিক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া চরাঞ্চলের রাস্তাঘাট, আমনের বীজতলা, বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মুরগি ও মাছের খামারের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
×